আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! সত্যি অনেক কিছুই জানি না। মাহেশের জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা কে করেছিলেন এবং কীভাবে করেছিলেন তাও কি জানতাম? জানা গেল শ্রীরামপুর বইমেলায় শ্রীমৎ ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর শিষ্যদের দ্বারা প্রচারিত একটি লিফলেট হাতে পেয়ে। যেখানে ফলাও করে বলা হয়েছে চতুর্দশ শতকে ধর্মপ্রাণ ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী শ্রীরামপুর মাহেশের জগন্নাথ ঘাটের দক্ষিণ দিকে একটি পর্ণকুঠীরে বাস করতেন। যদিও তাঁর অতীত জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। অর্থাৎ তাঁর আদি নিবাস কোথায় এবং তাঁর পিতা-মাতার নাম কী ছিল তাও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। যতদূর জানা যায়, সেই সন্ন্যাসী গঙ্গার তীরে নির্জনে একটি পর্ণকুঠীরে ঈশ্বরের আরাধনা করতেন। একনিষ্ঠ সাধক বলেই তিনি ঈশ্বরের সন্ধানে এক সময় বহু তীর্থ ভ্রমণ করে অবশেষে পুরীধামে গিয়ে উপস্থিত হন।
পুরীর মন্দিরে আরাধ্য দেবতা মহাপ্রভুকে দর্শন করে তিনি মহানন্দে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বিগলিত হন। প্রাণের দেবতাকে কাছে পেয়ে সন্ন্যাসী ধ্রুবানন্দ আর স্থির থাকতে পারেন না। আনন্দে দু’চোখ বেয়ে তাঁর অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মনে তার মহাপ্রভু জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে রান্না করা অন্নভোগ নিবেদনের বাসনা হয়। বাসনা চরিতার্থে তিনি পরদিন সযত্নে অন্নভোগ তৈরি করে এক বুক আশা নিয়ে মহাপ্রভুকে নিবেদনের উদ্দেশে মন্দিরে উপস্থিত হলে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হন। চাল-চুলোহীন সন্ন্যাসী বলে মন্দিরের পুরোহিতরা তাঁকে অপমান করে মন্দির থেকে তাড়িয়ে দেয়। এই ঘটনায় মনে ব্যথা পেয়ে ধ্রুবানন্দ ঈশ্বরের মন্দির থেকে বিতাড়িত হয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে নিভৃত স্থানে বসে তিন দিন তিন রাত্রি অনাহারে অনিদ্রায় কাটান। তিনি ভাবলেন, ঈশ্বরের মন্দিরে যখন তাঁর ঠাঁই নেই তখন এ জীবন বৃথা। বৃথা মানব জনম। মনে মনে স্থির করলেন, আত্মহত্যা করে সকল জ্বালা জুড়োবেন। ভক্তের মনের কথা ভগবান ঠিক টের পান। ভগবানকে ঠিক মতো ভক্তিভরে ডাকতে পারলে তিনি স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে ভক্তের মনের ইচ্ছা পূর্ণ করেন। তৃতীয় দিনের শেষে দয়ার অবতার শ্রী জগন্নাথদেব তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন, ‘ভক্ত ধ্রুবানন্দ চোখের জল মোছো। জেনে রাখো আত্মহত্যা মহাপাপ। তুমি এখন মাহেশে ফিরে যাও। সেখানে গঙ্গার তীরে গিয়ে বসলে দেখতে পাবে ভাসমান একটি নিমগাছের গুঁড়ি। সেই নিমকাঠ দিয়ে আমার বলরাম আর সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করে পুজো করো। আমি সেখানে সদা জাগ্রত থাকব’। ভগবান জগন্নাথদেবের দর্শন আর তাঁর কথা শুনে ধ্রুবানন্দ সমস্ত দুঃখ ভুলে গিয়ে আনন্দে পুলকিত হয়ে পুরীধাম ত্যাগ করে শ্রীরামপুরে মাহেশে ফিরে আসেন।
মাহেশে ফিরে আসার পর আরাধ্য দেবতা জগন্নাথের কথা মতো গঙ্গার তীরে দিন-রাত বসে অপেক্ষা করতে থাকেন নিমগাছের গুঁড়ি পাওয়ার আশায়। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, তিনি সেখানে তীর্থের কাকের মতো ঠায় বসে থাকেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ঈশ্বরের বাণী কখনও মিথ্যে হয় না। সে কারণে বহুদিন অপেক্ষা করেও তিনি কখনওই হতাশ হননি। তাই তো কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
অবশেষে তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হল। এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে বিদ্যুৎ ঝলকের আলোয় ধ্রুবানন্দ দেখলেন, গঙ্গার জলে একটি বিরাট কাঠের গুঁড়ি ভাসছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পাগলের মতো তিনি গঙ্গার জলে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে অনেক কষ্টে নিমগাছের গুঁড়িটিকে পারে তুলে আনেন। পরদিন সকালে অভ্যাসবশত স্নান ও পূজাপর্ব সেরে কুটিরের বাইরে আসতেই তিনি অবাক বিস্ময়ে জগন্নাথদেব প্রেরিত তিনজন কাঠের মিস্ত্রির দেখা পেলেন। তিনি ইষ্টদেবতাকে করজোড়ে প্রণাম করে তাদের তাঁর পর্ণকুঠীরে নিয়ে এসে বসান। তারপর তিনি সেই তিনজন কাঠের মিস্ত্রির দ্বারা নিমগাছের গুঁড়ির কাঠ দিয়ে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি তৈরি করে ভক্তিভরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
চতুর্দশ শতাব্দীতে সন্ন্যাসী ধ্রুবানন্দর প্রতিষ্ঠিত সেই তিনটি বিগ্রহ জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামের পুজো আজও শ্রীরামপুরে মাহেশের মন্দিরে হয়ে আসছে। বহুযুগ ধরেই ওই একই বিগ্রহ পুজো হয়। বলা বাহুল্য, ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী হলেন সেই সিদ্ধপুরুষ যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গভূমিতে ভগবান শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের পুজোর প্রবর্তন করেন।
মাহেশের জগন্নাথদেবের অলৌকিক কাহিনী শুনে ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপের মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব পুরী যাত্রার আগে ধ্রুবানন্দের প্রতিষ্ঠিত মন্দির দর্শনে আসেন। তিনি মাহেশের মন্দিরের ইষ্টদেবতা জগন্নাথদেবকে দেখে জ্ঞান হারান এবং তৎক্ষণাৎ গভীর সমাধিতে নিমগ্ন হন। সমাধি ভঙ্গ হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন মাহেশের মন্দিরের শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব খুবই জাগ্রত। তাই তিনি এই পুণ্যভূমিতে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের নামকরণ করেন— নব নীলাচল।
ইতিহাস প্রসিদ্ধ মাহেশের রথের মেলায় প্রতি বছর বহু দুর থেকে হাজার হাজার ভক্ত আসে জগন্নাথদেব দর্শন করে নিজেদের জীবন সার্থক করতে।