পেশাদারি কাজকর্মে উন্নতি ও আয় বৃদ্ধির যোগ। জ্ঞাতি শত্রুদের থেকে সতর্ক থাকবেন। স্বাস্থ্য খুব একটা ... বিশদ
সেই ’৭১ সালে জন্মের শুরু থেকেই অশান্তি ও বিতর্ক দেশটার পিছু ছাড়েনি এক মুহূর্তের জন্য। ভূমিষ্ঠ হওয়ার চার বছরের ব্যবধানে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এক অর্থে তিনিও ছিলেন জাতির জনক। ঐতিহাসিকরা বলেন বঙ্গবন্ধুর নিধন এবং তারও ২৭ বছর আগে এপারে মহাত্মা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড বিশাল এই উপমহাদেশের ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিরই অনিবার্য বিষময় ফল। আমরা আজও তা বহন করে চলেছি নির্মমভাবে। সেইসঙ্গে এক আশ্চর্য ঐতিহাসিক সমাপতনেরও মোক্ষম উদাহরণ! কারণ, দু’টি ঘটনাই ঘটেছে ধর্মীয় কারণে এবং দু’দেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারির গান্ধী হত্যা থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুর নিকেশ এবং হালের ৫ আগস্ট ২০২৪’এ মুজিব কন্যার প্রাণ বাঁচাতে আকস্মিক দেশত্যাগ, সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ কোথাও যেন একই সুরে বাঁধা। এই বিভাজন থেকেই পাবনা, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনায় হিন্দুরা আজ চূড়ান্ত বিপন্ন। মঠ-মন্দির আক্রান্ত, অকুতোভয় সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাস অন্যায়ভাবে হাজতে। অবিলম্বে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। আসল অসুখটার নাম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, যার কোনও ওষুধ আবিষ্কার হয়নি বিশ্বচরাচরে। এই রোগ আজন্ম অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। কাজ হয় না স্টেরয়েডেও! শুধু ধূসর বইয়ের পাতায় লেখা থাকে, একই বৃন্তে দু’টি...। প্রার্থনা একটাই, ওই কুসুম ক্ষেপণাস্ত্র হয়ে যেন নিক্ষেপিত না হয় একে অপরের দিকে!
প্রতিবেশী বাংলাদেশে হালে ৫৩ বছর আগের অশান্তিরই অবিকল পুনরাবৃত্তি। হাসিনাকে দেশছাড়া করেই সমস্যার সমাধান হয়নি। ক্ষান্ত হয়নি মৌলবাদীরা। উল্টে যতদিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের পক্ষে। তাদের বাড়িঘর, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুর্গাপুজোয় বাধা দেওয়া হয়েছে। বিগ্রহ ভেঙে ফেলা হচ্ছে অতর্কিতে। একের পর এক ঘটনায় অকারণে সাধু সন্তরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। সবচেয়ে বড় বিতর্ক চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারি নিয়ে। তাঁর অপরাধ তিনি ভয়কে দূরে ঠেলে ঘুরে ঘুরে হিন্দুদের সংগঠিত করছিলেন। প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন। এতেই প্রমাণ হয়, ইউনুস সরকার জেনেবুঝে হিন্দুবিরোধীদের মদত দিচ্ছে। কিংবা তিনি পুতুল, ক্ষমতার রাশ অন্য কারও হাতে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা না দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দর্শক সেজে বসে আছে মাত্র। সরকারি সেই উদাসীনতার সুযোগেই নির্মম দমনপীড়ন নেমে আসছে হিন্দুদের উপর।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অশান্ত হলে হস্তক্ষেপ করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। তথাকথিত মুজিবরের মুক্তি ফৌজের পাশে দাঁড়িয়ে ছিনিয়ে এনেছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ইন্দিরা গান্ধীর নাম সেই সুবাদেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং সামনের একশো বছরও থাকবে উপমহাদেশের ইতিহাসে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আর ক’দিন পরই সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ৫৩ বছর পূর্তি। এক অর্থে ভারত ভেঙে আজ তিন টুকরো। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, দু’ভাগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়। আর ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা, তবু নিন্দুকেরা যাই বলুন, একমাত্র এই অংশই এখনও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঁকড়ে ধরে চলছে। রাজনৈতিক নানা মতভেদ সত্ত্বেও তার এখনও অন্যথা হয়নি। কিন্তু এটাও ঠিক, পথ ও মতের এই বিশাল পার্থক্যের দরুনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি হওয়া হল না আমাদের। জিন্নাকে ঘুঁটি করে ব্রিটিশ রাজশক্তির সক্রিয়তায় কার্যকর হওয়া ‘টু নেশন (পড়ুন, থ্রি নেশন!) থিয়োরি’ এখানেই সফল।
আজ আবার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান, যা অধুনা বাংলাদেশ নামে পরিচিত, তা অগ্নিগর্ভ। চলছে হিন্দু নিধন। রাষ্ট্রের প্ররোচনায় এই ‘এথনিক ক্লিনজিং’ কার স্বার্থে এবং কাকে দুর্বল করতে? এর কোনও উত্তর নেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত কারও কাছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ শুধু কথার কথা হয়ে যেন শোভা না পায়। একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হওয়া না হয় আমাদের আর হয়ে ওঠে না কিছুতেই। কিন্তু তা বলে মানবিকতার মৃত্যু! হানাহানি করেই ক্ষয় হয় শক্তির। আবার বাংলাদেশে হিন্দুরা আক্রান্ত, এই উদাহরণ টেনে এদেশের পরিবেশকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা হয় মেরুকরণের স্বার্থে। গণ্ডগোল থামাতে আগ্রহ যতটা, তার চেয়ে বেশি ঝোঁক সেই আগুনে সেঁকে ভোটের কড়ি ঘরে তোলার!
কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, নরেন্দ্র মোদি কি অর্ধশতাব্দীর আগের লৌহমানবী ইন্দিরা হতে পারবেন? বিশ্বগুরু শুধু স্লোগানে আর উচ্চকিত প্রচারে সীমাবদ্ধ থাকলে জনগণ একদিন দুয়ো দিতে বাধ্য। তাই বাংলাদেশে আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্মানজনক অবস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলাই নরেন্দ্র মোদির প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচিত সরকার নেই। যুযুধান বিএনপি’ও কিন্তু বেশ পিছিয়ে পড়েছে। রাশ এখন জামাতের হাতে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে ইউনুসকে পুতুল সাজিয়ে মজা লুটছে কোন বিদেশি শক্তি! তাই ভারতকে আবার প্রোঅ্যাক্টিভ ভূমিকা নিতেই হবে। কিছুদিনের মধ্যেই হোয়াইট হাউসে ফিরছেন বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাই হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজ্যপাট ফিরিয়ে দেওয়ার এই সুযোগ। মোদিজি বলতেই পারেন ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবারের একঝাঁক সদস্য সমেত বঙ্গবন্ধু নিজের ধানমণ্ডির বাড়িতেই যেদিন খুন হয়েছিলেন, তখন তদানীন্তন ভারত সরকার কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু তিনি হাসিনাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন। বাকি রয়েছে ঢাকায় নির্বাচিত সরকার গঠন। সেদিকেও নিশ্চিতভাবে কড়া নজর রয়েছে দিল্লির।
ভাবা যায়, বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমতে কমতে মাত্র ৭ শতাংশে নেমে এসেছে! ১৯৪৭-এ সমগ্র পাকিস্তানে হিন্দু ছিল ২৪ শতাংশ, ৩০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। সেন্সাস অনুসারে, ১৯৫১-তেও পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ শতাংশ, ১৯৭৪ সালে তাদের ১৪ শতাংশ টিকে ছিল। এখন সেই মুলুকে হিন্দু ২.১৪ শতাংশ আগামী তিন দশকে বাংলাদেশ ‘হিন্দুশূন্য’ এক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এটাকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ আখ্যা দেওয়া কি অতিরঞ্জন? রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ খারিজের দাবিও জোরদার হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। সেও কি হিন্দুপ্রীতির অপরাধে? প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে ভারতের রাজপথেও। নিরাপত্তার দাবিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মিছিল বেরচ্ছে বাংলাদেশেরও নানা স্থানে। দিল্লির সরকার জানিয়ে দিয়েছে, একাত্তরের পুনরাবৃত্তি তারা চায় না। ভারতের দরজা বাংলাদেশি শরণার্থীদের সামনে আর অবারিত নয়। বস্তুত খাঁচায় পড়া ইঁদুরের দশা এখন বাংলাদেশিদের! নিঃসন্দেহে এসব কোনও সভ্যসমাজের বিজ্ঞাপন নয়।
কিন্তু একইসঙ্গে এটাই মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে হিন্দু আক্রান্ত বলে এই বাংলায় সেই সুযোগে মেরুকরণের চেষ্টাও সমান অপরাধ। সাম্প্রদায়িক বিভাজন কখনও কোথাও উন্নয়নের পরিপূরক হতে পারে না। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ—এটাই আমাদের শক্তি এবং গর্বও। প্রতিশোধ কিংবা বদলা নয়, সহাবস্থানই এই দর্শনের মূল কথা। সেই শক্তির জোরেই পাকিস্তানকে সহস্র যোজন পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে ভারত। বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে এবং প্রাত্যহিক যাপনে। ধর্মের নামে যেখানেই সমাজকে টুকরো করার চেষ্টা হয়েছে সেখানেই বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের মতো থমকে গিয়েছে উন্নয়নের সূচক। ভারতে বিভাজনের বিষ ছড়াতে যাঁরা উদগ্রীব, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় দিয়ে শক্তিশালী হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকেই ধ্রুবতারা করে অগ্রসর হচ্ছেন, তাঁরা এই জ্বলন্ত উদাহরণটি যেন ভুলে না যান। তাহলে ভারতের অবস্থাও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতোই হবে। তাই সময় থাকতেই সাধু সাবধান! দাঙ্গা নয়, হানাহানি নয়, সহাবস্থান।