কর্ম, বিদ্যা ক্ষেত্রে উন্নতির যোগ। আয় ব্যয় ক্ষেত্রে সমতার অভাব। স্বাস্থ্য ভালো থাকলেও আঘাতযোগ থাকায় ... বিশদ
হাওয়া বদলাচ্ছে। একের পর এক ভোট তার প্রমাণ। ২০২১ সালে বাংলা থেকে মোদি নামক সূর্যের অস্তাচলে যাওয়ার যে সূচনা হয়েছিল, তা এখন পূর্ণ মাত্রায় গোধূলির পথে। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী তিনি হয়েছেন। কিন্তু তাতে গরিমা নেই। বরং জোটের কাছে আত্মসমর্পণ রয়েছে। তিনি নিজেও সেটা জানেন। আর জানে সঙ্ঘ। তাই মোহন ভাগবত আবার অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। প্রতিটা পদক্ষেপ বুঝে ফেলাটাই এখন তাঁর লক্ষ্য। তাই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি পদ থেকে সরে যাননি জে পি নাড্ডা। সরানো হয়নি রাজ্য সভাপতিদেরও। প্রকাশ্যে একের পর এক ভোটের কথা বলা হলেও, অপেক্ষা চলছে সঠিক মুখের। আরএসএস জানে, এই কয়েকটি ভোট থেকেই আসল চিত্রটা সামনে আসবে। তারপর ঠিক হবে, বিজেপির সংগঠনের ব্যাটন যাবে কার হাতে। সংগঠন নিয়ে এখন যে মোদিজিকে খুব একটা মাথা গলাতে দেওয়া হচ্ছে না, এই খবর বিজেপির অন্দরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তা না হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ভোটের সময় তিনি বিদেশ সফরে চলে যেতেন না। বিজেপি সম্পূর্ণভাবে ক্যাডার নির্ভর পার্টি। প্রশাসনের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব তাদের কাছে রাজনীতির। তাহলে মরণ-বাঁচন লড়াইয়ে দলের মুখ নিজেই কীভাবে বিদেশি হাওয়া খেতে যেতে পারেন? হাওয়া বদল কি এখনও বোঝা যাচ্ছে না? প্রশাসন তিনি চালান, অসুবিধা নেই। কারণ, তাঁর একাগ্রতা এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন সঙ্ঘের অন্দরেও নেই। ৫৫ ঘণ্টার বিদেশ সফরে গিয়ে ৪০টা বৈঠক করতে পারেন মোদিজি। এই অমানুষিক ক্ষমতা খুব বেশি রাজনীতিকের নেই। কিন্তু সংগঠন? এখানে সব স্ট্র্যাটেজিই সঙ্ঘের। আগ্রাসনই এই সমীকরণের শেষ কথা। কোথাও সফল হবে। কোথাও হবে না। ঠিক যেমন ‘কাটেঙ্গে ইয়া বাঁটেঙ্গে’ উত্তরপ্রদেশে সুফল এনেছে, ঝাড়খণ্ডে আনেনি। তাতে সঙ্ঘের কিছু আসে যায় না। তারা জানে, শতবর্ষে পৌঁছে এজেন্ডার পূরণের আগে কিছু নেই। হিন্দুরাষ্ট্র, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, এক দেশ এক ভোট। তিনটি প্রায় অবাস্তব ভাবনাকেই তারা বাস্তব রূপ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। তার জন্য যদি প্রয়োজন হয়, সরকার এবং সংগঠনকে স্রেফ আলাদা করে দেওয়া হবে। এতে লাভ দু’টি। ১) নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা ধাক্কা খেয়ে থাকলেও খুব একটা প্রভাব ভোটে পড়বে না। কারণ, তাঁকে মুখ হিসেবে খাড়া করে এগলেই সেই সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু তিনি যদি ভোট প্রচারের আলোতেই না থাকেন? মানুষ স্থানীয় নেতা এবং স্থানীয় ইস্যুর উপর ভিত্তি করে ভোট দেবে। মহারাষ্ট্রেও কিন্তু এবার বিজেপি কার্যত আঞ্চলিক পার্টির মতোই লড়েছে। জাতীয় ইস্যু বা নেতাদের সামনে আনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু খুব বুঝেশুনে। জোটের মুখ হিসেবে থেকে গিয়েছেন একনাথ সিন্ধে ও দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। জয়ের পর কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, সেটা দেখে নেওয়া যাবে। আগে তো জয়! ২) বিরোধীদের বেসামাল হবে। কেন? কংগ্রেসের মতো জাতীয় স্তরের বিরোধী দলগুলির যাবতীয় আক্রমণ এবং প্রচারই নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরে। গত ১০ বছরে তিনি আধিপত্যের যে মিথ তৈরি করেছেন, তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে কংগ্রেসের প্রচার। লোকসভা ভোট ছিল মোদির। তাই সেখানে কংগ্রেস দাঁত ফোটাতে পেরেছে। রাহুল গান্ধীরা ভেবেছেন, বিজেপির জমানা শেষ। মানুষ আবার কংগ্রেসকেই ভরসা করতে শুরু করেছে। বাস্তবে কি তাই? মহারাষ্ট্র বা ঝাড়খণ্ড কিন্তু সে কথা বলল না। এই ভোটপর্ব দেখাল, মানুষ আঞ্চলিক শক্তির উপরই বেশি ভরসা করছে। কংগ্রেসের উপর নয়। আরএসএস সেটা বুঝতে শুরু করেছে। কিন্তু কংগ্রেস নয়। বিধানসভা ভোটে যে গেরুয়া বাহিনীর স্ট্র্যাটেজি বদলে গিয়েছে, সেটা কংগ্রেস বুঝতেই পারেনি। কারণ, ওভার কনফিডেন্স। লোকসভার ফল তাদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাই কংগ্রেসের আক্রমণ সবটাই ছিল মোদিজির বিরুদ্ধে। কিন্তু আসরে না থাকা একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা এবং প্রচারের টাকা খরচ পুরোটাই জলে গিয়েছে। এই ভোটের ফল আরও একবার দেখিয়ে দিয়েছে, সোনিয়া গান্ধী জমানার পরবর্তী কংগ্রেস সাবালক হওয়া তো দূর, এখনও হামাগুড়ি দেওয়ার পর্যায়েই রয়েছে। পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিতে হয়, অবস্থা বুঝে কীভাবে প্ল্যান বি ব্যবহার করতে হয়, সেটাই শেখেনি তারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা আগ্রাসী নেত্রী হিসেবে জানি। আর জি কর আন্দোলন কিন্তু একেবারে অচেনা মমতা হয়েই সামলেছেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়েছেন আন্দোলনকারীদের। তাঁদের ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জুগিয়েছেন। এটাই শাসকের এবং রাজনৈতিক দলের বিকল্প রণনীতি। আন্দোলনের নামে যারা রাজনীতির চাষ শুরু করেছিল, তারা উধাও হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেস কিন্তু আটকে আছে সেই মোদি বিরোধিতায়। হাওয়া যে বদলাচ্ছে, সেটা তারা বুঝছে না। বা বোঝার মতো রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের নেই।
ঝাড়খণ্ডের ফলাফলের ময়নাতদন্তের পর বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলছিলেন, ‘এখানে হারতে হয়েছে দুর্বল ইলেকশন ম্যানেজমেন্টের জন্য। এমন সব লোককে টিকিট দেওয়া হয়েছে, তারা একেবারেই জনপ্রিয় নয়। শুধু পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। ফল তো এমন হবেই!’ কার দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি? নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠরা নয় তো? হরিয়ানা ভোটের কথাও কিন্তু তিনি বলছিলেন। সেখানে প্রচারে মোদিজিকে খুব একটা দেখাই যায়নি। স্থানীয় ইস্যু সামনে রেখেই অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছিল বিজেপি। মহারাষ্ট্রের ফলের পর একটা বিষয় নিশ্চিত, ধীরে ধীরে এই ফর্মুলাতেই শিফ্ট করে যাবে তারা। আর কর্তৃত্বের দখল পুরোটাই তুলে নেবে সঙ্ঘ। সংগঠনের রাশ তো বটেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যতদিন আছেন... থাকুন। মেয়াদ না হোক, অবসর পর্যন্ত।