আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
আসলে কি জানেন, অঞ্চলটি এখনও কিছুটা হলেও পিছিয়ে। এখানে রেজাল্ট করা মুখের কথা নয়। এক মেহনতি প্রক্রিয়া। শহরের ছেলেমেয়েরা যেখানে থাকে রাজপ্রাসাদে, সেখানে এখানকার পড়ুয়ারা থাকে রায়মঙ্গল হাতানিয়া-দোয়ানিয়াদের মতো ভয়ঙ্করদের পাশে। পড়তে পড়তে ওদের একটা মন পড়ে থাকে নদীর দিকে—কখন যে বাঁধটা ভেঙে যাবে। আর ভাঙলেই ওদের বইখাতা ভেসে যায়, উড়ে যায় পড়ার ঘরের চালাটাও। ঘোড়ামারা, জি-প্লট, মৌসুনির পড়ুয়াদের সর্বক্ষণ কাটে টেনশনে। শহর ও বাঁকুড়া-বীরভূমদের এসব হ্যাপা নেই। ওদের সাফল্যের রসায়নটাই আলাদা। পড়ো আর মার্কস তোলো। স্কুলে ল্যাব, লাইব্রেরি, সযত্ন ক্লাস, ইউনিট টেস্ট, মকটেস্ট। সাবজেক্ট পিছু অঢেল টিউশনি, হাতের কাছে ‘পাথ ফাইন্ডার’-ও। ওদের সঙ্গে পাল্লা দেবে সুন্দরবন? তাও দিচ্ছে। কখনও খালি পেটে, কখনও পান্তা খেয়ে। এদের বাবা মা’রা কেউ দিনমজুর, কেউ সেলসম্যান, কেউ ভ্যান চালায়, কারুর মুদির দোকান, তেলে ভাজার দোকান। কোথায় পাবে এরা টিউশনির টাকা! তবু সব কিছু ওভারকাম করে এরা তুলছে স্টার মার্কস, এমনকী ১০০-য় ১০০। ১৯ ব্লকের (মোট ১৯ ব্লক নিয়ে সুন্দরবন) সেরা ১৯ স্কুলসহ আরও ২১টি (মোট দাঁড়াচ্ছে ৪০টি) স্কুল নিয়ে তৈরি একটি সমীক্ষায় দেখা যায় এরা কতখানি উচ্চফলনশীল। ৯০ ছাপিয়েও মার্কস তুলছে অনিমেষ-সুমন (দেবনগর এম ডি হাই), পূর্ণিমা-রাখী (ট্যাংরাখালি পিজেপি হাই /ক্যানিং-১), কুণাল (শ্রীফলতলা সি কে হাই, মথুরাপুর-২), নীলেন্দু (খানসাহেব আবাদ হাই, সাগর) এবং আরও আরও অনেকেই। এখানে ১০০ তে ১০০ মার্কস তোলার প্রথম রেকর্ড করেছে সাহেবখালি নিত্যানন্দ হাইয়ের (হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক) সেদিনের (১৯৬১) পুঁচকে শুকদেব গায়েনের অঙ্কে ১০০। আমৃত্যু তার অঙ্ক চর্চা। লোকে বলত, সুন্দরবনের কে সি নাগ। পরে পরে ১০০ তুলল ভূদীপ্ত (ছোট সেহারা হাই), অমর (ছোট মোল্লাখালি এম সি বিদ্যাপীঠ), হালে পেয়েছে সাগির (ঈশ্বরীপুর মর্জিনা বিদ্যাপীঠ), তৌসিক (টাকি আর কে মিশন), সুচেতা (হাড়োয়া পিজি হাই), সৌরভ (হিঙ্গলগঞ্জ হাই) যথাক্রমে অঙ্কে জীবনবিজ্ঞানে। সেরা দশদের মতোই এদের কাজ। তাছাড়া একেই বলে দারিদ্র্যকে তুড়ি মারা। মেধাতালিকার বাইরে থেকেও এদের এটা মেধারই পরিচয়। দুলদুলি মঠবাড়ি ডিএন হাইয়ের সুকান্ত রাজ্যে তুলল সেবার (১৯৯৫) ইতিহাসে সর্বোচ্চ মার্ক ৯২। এই স্কুলেরই আরেক উল্লেখ্য ক্যারেক্টর রবীন্দ্রনাথ গায়েন। সে দিনের (২০০১) এই কিশোর আজকের রবীন্দ্রনাথ গায়েন, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ সামলাচ্ছেন। দিনমজুর বাবার পয়সায় মানুষ। গাঙ পেরিয়ে স্কুলে যেতেন। পেলেন বিজ্ঞানী মণিলাল ভৌমিক মেধা অনুসন্ধান বৃত্তি। রেজাল্টের জোরে।
সুন্দরবনের কপাল খুলেছিল ১৯৫৮ সালে। স্কুল ফাইনালে টাকি রাষ্ট্রীয় হাই স্কুলের (হাসনাবাদ ব্লক) অজিত কুমার মণ্ডল সেবার রাজ্যে একাদশ স্থানে। এই প্রথম মেধাতালিকায় সুন্দরবন। ১৯৬২-তে এই স্কুলের রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত একাদশ শ্রেণীতে রাজ্যে ৭ম স্থানে। পরের বছর জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত মনোতোষ মিত্র। এছাড়া ললিত ঘোষ, চন্দন দাশগুপ্ত, তাপস চন্দ এখানকার কৃতী ছাত্র। ১৯৬৯ হিঙ্গল ব্লকের দুই কিশোর শ্যামল সরকার (যোগেশগঞ্জ হাই, ৪র্থ স্থান, ৭৫১), ও তপন ঘোষ (কনকনগর এসডি হাই, ৭ম স্থান, ৭০৭) কাদা জল ঘেঁটে স্কুলে আসতে আসতে কখনও কি ভেবেছিল যে, একজন হয়ে যাবে আই এ এস অফিসার, আরেকজন যাবে বেলুড় আর কে মিশনে ইকনমিক্স পড়াতে? রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে এখন ক্লাস নিচ্ছেন অতিথি অধ্যাপক হিমাংশু রাউত। কিশোর হিমাংশু পাথরপ্রতিমা কেদারনাথ রামানন্দ হাই-এ ক্লাস এইটেই ড্রপ আউট। সংসারে টানাটানি। অবশেষে সেরা দশে নবম (মার্কস ৬৮০)। ১৯৭২-এ। মশারি নেই, বিছানা নেই, গোটা তিনেক টাকা আর একজোড়া চপ্পল ধার করে পড়তে গেল বেলঘরিয়া আর কে মিশনে। দেখেছেন কি এমন জীবন? ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনে ‘সেরা দশে’ দাঁড়িয়ে মোট ১৯টি ব্লকের ৯টি—হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, ক্যানিং-২, পাথরপ্রতিমা, সাগর (মনসাদ্বীপ আর কে মিশন হাই, প্রবীর গোল দিগন্ত দাস), কাকদ্বীপ, জয়নগর-১ (দঃ বারাসাত আচার্য শিবদাস হাই, বিশ্বজিৎ দাস), জয়নগর ২ (নিমপীঠ আর কে হাই, তারাশঙ্কর-রামশঙ্কর), মথুরাপুর ২। অবশিষ্ট ব্লকের স্কুলগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অজস্র মেধা। যেমন, ক্যানিং ডেভিড সেগুন, বাসন্তী হাই, রাঙ্গাবেলিয়া হাই, গোসাবা আর আর আই, মথুরাপুরের কৃষ্ণচন্দ্র হাই, সন্দেশখালির কালীনগর হাই, কুলতলির জামতলা ভগবানচন্দ্র হাই, নামখানা এম ডি হাই, জয়গ্রাম হাই, বামনপুকুরিয়া হাই। জয়গ্রাম হাইয়ের এক মেধাবী (১৯৪২-এ উত্তীর্ণ) আজকের বিখ্যাত ডাক্তার অনুপম দাশগুপ্ত। নামখানা এম ডি হাই-এ হস্টেলে মেধাবীদের রেখে সকাল-বিকেল-রাতে কোচের ব্যবস্থা। মাসুম আদিত্যদের প্রধান শিক্ষক শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন যদিও শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাতটা ১:৪০ নয়। টাকি আর কে মিশনে পড়াশোনা যথেষ্ট ভালো। সেরা দশে এখানে এ পর্যন্ত তিনজন। সায়ন্তন-অনীশ (২০১৪), রমিত (২০১৫) এখানে যথাক্রমে পঞ্চম, ষষ্ঠ, দশম হয়েছে। স্কুলের নজর মেধা তৈরির দিকেই। আবুল কালাম (ক্যানিং-২, মেধাতালিকার শীর্ষে) নিজের স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। অর্থাৎ ১ম হওয়া এক মেধাবীর কাছে পড়ুয়ারা পাঠ নিতে পারছে।
অনেকটাই অতএব স্পষ্ট যে, মেধাতালিকায় অনেকখানি জুড়েই সুন্দরবন। সব শেষে বলি, এখানকার মেধাবীদের মেধা এবং ক্ষমতাকে কি সুন্দরবন উন্নয়নের কাজে লাগানো যায় না? এখানে তাঁরা একটা জুতসই প্রজেক্ট করতে পারেন। বিশেষ করে নদী-বাঁধের ওপর। সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদেও এঁদের রাখা যেতে পারে। তবেই এঁদের মেধার সার্থকতা।