লোক সকল স্ব স্ব ভাগ্যবশে প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে এই মরুভূমে অস্থায়ী বস্তুর প্রলোভনে আকৃষ্ট হইয়া দেহ গেহ সমাজের দ্বারা সুখী দুঃখী ইত্যাদি বিদ্যা বুদ্ধি লাভ করিয়া ঐ প্রকৃতির গুণের দ্বারা পরিচালিত হইয়া থাকে। একেই কর্ম্মভোগ বলিয়া জানিবেন। এই ভোগই ভাগ্য অনুসারে হয়। এই ভোগদান করিলেই শান্তি পদ উপভোগের অধিকারী হয় ... মন হইতেই সুখ দুঃখ ভোগ হয়। এই জন্যই পতিসেবার মহত্ব নিয়োগ বিধান করিয়া স্বভাবেই দাসত্ব সেবা হইয়া থাকে। মনের দরকার হয় না। সকল প্রাণীর সত্যরূপ আত্মা একই হয়, ভিন্ন কেহই নয়, দেহই অবয়বই পৃথক পৃথক দেখা যায়। ভগবানের নামই সত্য, নামই শান্তি, নামই আনন্দ, নামেই আশ্রয় লইলে অপ্রাপ্তি কিছুই থাকে না। কোথাও তীর্থে যাইতে হয় না। বেদ পুরাণ গত সুখ দুঃখও থাকে না। সর্ব্বদা আনন্দ প্রকাশ করিয়া অহেতু ভক্তি নামের রুচি প্রদান করিয়া থাকেন। কর্ত্তাভিমানীর কর্ম্মাদির দ্বারা যাহা কিছু সুখ দুঃখাদি লাভ হয় তাহা সকলি অস্থায়ী, ভগবৎ পদ দিতে পারে না। অতএব সর্ব্বদা নাম করিবেন, মনের শান্তি অশান্তির দিকে লোভ রাখিবেন না, নামেই আপনাকে এই সুখ দুঃখ সংসার সাগরের তরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিবেন। এই সংসার মায়ামুগ্ধ বশতঃ বাসনা জালে চরাচর ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়। প্রয়োজন বিষয় জানিতে না দিয়া কেবল অনিত্য অভাবেরই সৃষ্টি করিয়া ফেলে। মনে যাহা ভালো বোধ করে তাহাই করিয়া থাকে। তজ্জন্য হিতাহিত বর্জ্জিত হইয়া কেবল বাসনায় বদ্ধ হয়, সংসার ক্ষয় যায় না। কেবল জন্ম মৃত্যুর দণ্ড লাভ করে। ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্রং। ভাগ্যই ফল দেয়, ফল দিবার অধিকার ত্রিজগতে (আর) কাহারো নাই। ভাগ্যবশে যাহার যাহা পাওনা দেনা রহিয়াছে তাহা যথাসময়ে ঘটিবেই। দৃঢ় বিশ্বাস থাকিলে জীবের দুরবস্থা ঘটে না। ... জগতই চিত্রপট ছায়াস্বরূপ। হৃদয়ে যদি চিত্রপট থাকে তবে তাহা নষ্ট হয় কি? সত্যকে কেহই ছেদন ভেদন অবগুণ্ঠন করিতে পারে না। তিনি—‘‘অচ্ছেদ্যেহয়-মদাহ্যোহয়ম-ক্লেদ্যোহশোয্য এব চ।/ নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।’’
... চিত্রপট সঙ্গেই থাকে, বিচ্ছেদ হয় না জানিবেন।
ভগবানের দাসত্ব লাভের জন্য নামের শরণ নিয়া পড়িয়া থাকুন, মনের দাস হইতে নাই। যেহেতু মন বুদ্ধি, প্রকৃতির গুণের জাত, এই মন বুদ্ধি হইতে সুখ দুঃখময় অনিত্য অস্থায়ী ক্ষোভকর শক্তি সঞ্চারিত থাকে। প্রারব্ধ দণ্ড ক্ষয় করিতে পারে না বলিয়াই রুচি অরুচি দ্বারাই নানান বিশৃঙ্খলা ঘটাইয়া নানান উপাধী গ্রস্থ লাভ করিয়া ব্যাধিময় হয়। অতএব সর্ব্বদা নাম নিয়া নামের দাস হইয়া থাকিবেন, নামেই আপনাকে কালে উদ্ধার করিয়া, যেমন কুরুকুলের তরঙ্গ হইতে পাণ্ডবগণ এবং হিরণ্যকৈশিপুর তরঙ্গ হইতে প্রহ্লাদকে উদ্ধার করিয়াছিল, যেরূপ সীতাদেবীকে মায়ামৃগ হইতে রাবণের শাসন হইতে উদ্ধার করিয়াছিল সেইরূপ নামে আপনাকে উদ্ধার (করিয়া) লইবে। যেই নাম সেই ভগবান। ভগবৎ সমীপে প্রকৃতির প্রারব্ধ শক্তি কেবল গুণের জাত বুদ্ধি মনের উপরই দেহেতে সম্বন্ধ করিয়া চালিত করিয়া থাকে, নামের নিকট যাইতে পারে না। ... এ জগতে যত কিছু আয় ব্যয় এবং লাভ লোকসান, পাওয়া না পাওয়া সকলি প্রাক্তন (ভাগ্যফল) জানিবেন। সর্ব্বদা নাম করিয়া নামের কার্য্য করিয়া যাইবেন। প্রাক্তনে (ভাগ্যে) যাহা ঘটিবে সহ্য করিয়া লইতে চেষ্টা করিবেন।
শ্রীশ্রীরাম ঠাকুরের ‘বেদবাণী’ (দ্বিতীয় খণ্ড) থেকে