নিত্য—সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ। লীলা—ঈশ্বরলীলা, দেবলীলা, নরলীলা, আর জগৎলীলা। যাঁরই নিত্য—তাঁরই লীলা; যাঁরই লীলা—তাঁরই নিত্য। যিনি ঈশ্বর বলে গোচর হন, তিনিই এই সমস্ত জীবজগৎ ইত্যাদি হয়েছেন। লীলা অবলম্বন না করলে ঈশ্বরের নিত্য ভাব বোঝবার কোনও উপায় নাই। নিত্য থেকেই লীলা, আবার লীলা থেকেই নিত্য। লীলা ধরে স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ ও মহাকারণে যেতে হয়। মহাকারণে এলেই লয়—অর্থাৎ সব চুপ, আর কোনও কথা চলে না। আবার সেখান থেকে ক্রমে, কারণ, সূক্ষ্ম ও স্থূলে আসতে হয়। জীবের যেমন জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয় অবস্থা। তুরীয় অবস্থায় পৌঁছিলে আর কোনও হুঁস নাই—তথায় লয় হয়। তুরীয় থেকে আবার ক্রমে ক্রমে জাগ্রত অবস্থায় এসে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউ যেমন সমুদ্রেই উঠে, আবার তাতেই লয় পায়, অনন্ত চিৎসাগরে সেই রকম এই সমস্ত লীলা উঠছে, আবার তাতেই লয় হচ্ছে। যতক্ষণ ঈশ্বরকে না পাওয়া যায়, ততক্ষণ নেতি নেতি ক’রে বিচার দ্বারা তাঁকে ধরতে হয়, তাঁকে পেলে তখন দেখতে পাওয়া যায় যে, তিনিই সব হয়েছেন। ঈশ্বর, মায়া, জীব, জগৎ, ভাল, মন্দ, শুচি, অশুচি, সকলই তিনি।একটা বেলের খোলা, শাঁস, বিচি, এ সব যদি আলাদা করা যায়, আর পরে যদি একজন জানতে চায়, যে বেলটা ওজনে কত, তা হলে শুধু শাঁসটি ওজন করলে চলবে না, খোলা, বিচিও নিতে হবে। বিচার করলে, শাঁসটিই সার, খোলা বিচি অসার; কিন্তু যে সত্ত্বায় শাঁস, সেই সত্ত্বাতেই খোলা ও বিচির উৎপত্তি। সম্পূর্ণ বেল বুঝতে হলে, খোলা ও বিচি ফেলবার যো নাই। সেইরূপ ঈশ্বরই সার বস্তু, কিন্তু তাঁকে পূর্ণরূপে বুঝতে হলে—সৃষ্টি, জীব, জগৎও তাঁর সঙ্গে নিতে হবে।
কলাগাছের খোলা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে মাঝে যেতে হয়, আবার মাঝ থেকে ক্রমে খোলার পর খোলায় এলে সম্পূর্ণ গাছের জ্ঞান উপলব্ধি হয়। সেইরূপ নেতি নেতি ক’রে উঠে গেলেই ব্রহ্ম, আবার ব্রহ্ম থেকে নেমে এলেই জগৎ। ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল। যদি ঘোল থাকে তবে মাখনও থাকবে, যদি মাখন থাকে, তবে ঘোলও থাকবে। সেইরূপ জগৎ থাকলে ঈশ্বর, এবং ঈশ্বর থাকলে জগৎ থাকবেই থাকবে। নিত্যে উঠে যে আনন্দ বিলাসের জন্য লীলায় থাকে, তারই ঠিক ঠিক জ্ঞান হয়েছে। বিলাতে গিয়ে কুইনকে (Queen Victoria) দেখে এসে, যদি কেউ কুইনের কথা বলে, তবে তার ঠিক ঠিক বলা হয়। ঋষিরা রামকে স্তব করবার সময় বলেছিলেন, হে রাম! তুমিই সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, তবে লীলা করবার জন্য মায়া আশ্রয় করেছ ব’লে, তোমাকে মানুষের মত দেখাচ্ছে। এই নিত্য ও লীলাভাব যে বুঝতে পারে, সেই ঠিক জ্ঞানী।তাঁকে যে জেনেছে, সে দেখচে—তিনিই সব হয়েছেন। বাপ, মা, ছেলে, প্রতিবাসী, জীব, জন্তু, ভাল, মন্দ, শুচি, অশুচি—এ সমস্তই তিনি।
‘শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণগীতা’ থেকে