দুঃখকে গ্রহণ করতে হবে তপস্যা বলে। দুঃখ, কষ্ট, অত্যাচার সহ্য করা খুবই দুরূহ তপস্যা। তবে সহনশক্তি বাড়াতে বাড়াতে এমন একটি অবস্থা আসে যখন কষ্টসহিষ্ণুতা অতি সহজ স্বাভাবিক হয়ে যায়।—তপস্যার প্রথম কথাই ইন্দ্রিয়সংযম। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও মন প্রভৃতি একাদশ ইন্দ্রিয়কে সম্পূর্ণ রূপে বশে আনার প্রচেষ্টা অশেষ সহ্যশক্তি ভিন্ন সফল হয় না। ইন্দ্রিয়গুলি একপ্রকার বস্তুর আস্বাদনে তৃপ্তি বোধ করতে চায়, কিন্তু সে আস্বাদ উপভোগে লিপ্ত থাকলে ঈশ্বরস্বাদন হয় না। কাজেই সংযমের পথে পা বাড়াতে হবে সাধককে। তখন সাধারণ সহ্যশক্তিতে কাজ হয় না, অসাধারণ সহিষ্ণুতা প্রয়োজন হয়। বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলেছেন— “তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা”। তৃণের চেয়ে দীন এবং বৃক্ষের ন্যায় সহিষ্ণু হতে হবে। গীতায় শ্রীভগবান বললেন—“আপূর্য্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ”... যেমন পরিপূরিত প্রশান্ত সমুদ্রে অপর জলরাশি এসে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি যাঁর মধ্যে বিষয় সকল প্রবেশ করেও কোনও চিত্ত বিক্ষেপ সৃষ্টি করে না তিনিই শান্তি লাভ করেন। যিনি সকল বিষয়েই মমত্বশূন্য, শুভ বিষয়ের প্রাপ্তিতে সন্তোষ আর অশুভ প্রাপ্তিতে অসন্তোষ ব্যক্ত করেন না, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। এই স্থিতপ্রজ্ঞ অবস্থা লাভ করতে প্রয়োজন সীমাহীন সহিষ্ণুতা। নিজেকে সর্বভাবে গুটিয়ে নিতে হবে নিজের মধ্যে, যেখানে বাইরের ঘাত অভিঘাত কোনও দাগ কাটতে পারবে না। “যথা সংহরতে চায়ং কুর্ম্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ”—কচ্ছপ যেমন তার অঙ্গ সকল সংহরণ করে তেমনি ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে সংহরণ করতে হবে। যিনি পারেন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ। প্রত্যেক মানুষের স্বতন্ত্রভাবে সুখ ও দুঃখের অনুভূতির একটা ব্যাপকতা আছে। সুখের শুরু একটা বিশেষ ভিত্তিভূমি থেকে এবং সুখ আর সুখ থাকে না একটা সীমার পরে। যে কোন ভোগোপকরণের ক্ষেত্রেই এটি দেখা যায়। আবার দুঃখের দিক থেকেও তেমনি সহ্যশক্তির পৃথক ভিত্তি ভূমি থাকে। এই সুখ দুঃখের ব্যবধান কমিয়ে আনা যায় সহ্যশক্তিকে বাড়িয়ে। আমাদের ঠাকুর বলেছেন— “সুখের সবচেয়ে ঊর্ধ্ব রেখাকে নামিয়ে আনতে হবে সর্বনিম্নে এবং দুঃখের সর্বনিম্ন রেখাকে নিয়ে যেতে হবে সর্ব উচ্চে। এইভাবে সুখের এবং দুঃখের ব্যবধানকে সমীকরণ করতে হবে। তখন একটি মাত্র অনুভূতি থাকবে অনুভূতি ব্রহ্ম।” সহ্যশক্তি বাড়িয়ে যাওয়ার এই প্রণালী অথবা সাধন পদ্ধতি ব্যক্তি বিশেষের আধার ও সংস্কার অনুসারে নির্ধারণ করে নিতে হবে।
সহ্যশক্তির তারতম্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে সাধারণ ব্যক্তি এবং মহৎ ব্যক্তির প্রভেদ। জগতে যে মহান্ হয়েছে দেখা যায় তার সহন শক্তি সাগর-গভীর, বুকের প্রসারতা আকাশতুল্য। স্থিতপ্রজ্ঞের একটি বিশেষ গুণ এই উদারতা। স্বামিজীর ‘বুক বড় হয়ে যাওয়ার’ পাশাপাশি দেখা যায় অশেষ ক্লেশ সহ্য করার ক্ষমতা। মানুষ তাঁকেও ছাড়েনি। স্বামিজী একটা গভীর উপেক্ষার মন নিয়েই বলতেন— “কেহ বা তাহারে মালা পরাইবে/কেহ বা উহারে পদ প্রহারিবে। চিত্তের প্রশান্তি ভেঙো না কখন/সদাই আনন্দে রহিবে মগন।” সহজ কথায় বলতে গেলে বলা যায়—গায়ে মেখো না। Ignore করা বা উপেক্ষা করাটা একটা মহা অস্ত্র। আমরা যা চাই, তা পাই না; আবার যা পাই, তা চাই না। রবীন্দ্রনাথের মতে জগতে আমাদের দুঃখের একটা পাওনা আছে। কিন্তু শুধু সুখ চাইতে গিয়ে আমরা সে কথা ভুলে যাই। আমাদের ঠাকুর বলতেন,— “সুখের দিনে যেন বলতে পারি—ঠাকুর দুঃখের দিন একদিন আসবে, সেদিনকেও যেন তোমার দান বলে নিতে পারি।”
স্বামী মৃগানন্দের “সাধনার পথে” (১ম খণ্ড) থেকে