পরিবারের কারও স্বাস্থ্য অবনতিতে মানসিক চিন্তা। অপ্রিয় সত্য কথার জন্য সামাজিক ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে পারেন। ... বিশদ
ঘটনা দুই: ঘন অন্ধকারে করুণ আর্তির কাঁপা আওয়াজ মেলাতে না মেলাতেই ভারি বুটের শব্দ। ধেয়ে আসা একাধিক টর্চের আলো। সবার পিঠে ইনসাস রাইফেল। কনকনে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সকলেই!
দু’টি ঘটনাই যুগপৎ ঘটে যায় বরণবেড়িয়া ঝোড়পাড়া গ্রামে। গ্রামটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া রানাঘাট ২ ব্লকের অন্তর্গত। যাঁর বাড়ির টিনের দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল কে বা কারা, তিনি সুপর্ণা মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত)। রাত-আগুন্তুকের করুণ আর্তিতেও তাঁর মন গলেনি। তাই দরজা খোলেননি। খুললেই বাইরে ওঁত পেতে বিপদ! ভারি বুটের আওয়াজ আছড়ে পড়বে তাঁরই উঠোনে। অনুপ্রবেশকারীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে শুরু হবে টানাহ্যাঁচড়া। সে এক বিস্তর আতঙ্কের! অতঃপর, ঘরের ভিতর কাঁথামুড়ি দিয়ে রাত জেগে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ খেয়াল রাখাই সুষ্ঠু জীবন-যাপনের শ্রেষ্ঠ উপায়। ঠিক যেভাবে কাশ্মীরের জঙ্গি প্রভাবিত এলাকার সাধারণ মানুষ রাতের জীবন অতিবাহিত করেন!
বাংলাদেশে অস্থির পরিস্থিতির পর শুধু ঝোড়পাড়াই নয়, জিরো পয়েন্ট ঘেঁষা প্রায় প্রতিটি গ্রামে রাতের ছবি কমবেশি একই। গ্রামবাসীদের অভিজ্ঞতাও সুপর্ণাদেবীর মতোই। সূর্য ডুবলে যে যাঁর ঘরে ঢুকে পড়েন। ভিতর থেকে দরজার খিল তুলে দেন। খাওয়া-দাওয়া, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া, বালতির জলে শৌচকর্ম সারা—সবই চলে চার দেওয়ালের মধ্যে। সাহস করে দুয়ারেও বের হন না কেউই। পাছে যদি অনুপ্রবেশকারী হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে! তাদের পিছু ধাওয়া করে বিএসএফ জওয়ানও! এ এক দুর্বিসহ জীবন। গ্রামবাসীদের কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমাদের গ্রামগুলি এখন যেন একখণ্ড কাশ্মীর! রাত নামলেই বড্ড ভয় হয়। ওরা তো রাতেই আসে।’
‘ওরা’ বলতে অনুপ্রবেশকারীরা। বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে ওদের সীমান্ত পেরোনোর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ঝোড়পাড়া গ্রাম কার্যত ট্রানজিট পয়েন্ট। কাঁটাতার নেই। আন্তর্জাতিক সীমানা বলতে গ্রামের সামনে রাস্তার উপর দিয়ে চলে যাওয়া ৬ ফুট উঁচু বাঁশের বেড়া। কোনওরকম সেই বেড়া ডিঙোতে পারলেই ভারতে প্রবেশ। তারপর কারও বাড়িতে আশ্রয় চেয়ে আর্জি। সেটাই বিপদে ফেলছে গ্রামবাসীদের। স্বাভাবিকভাবেই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিএসএফ অতি সক্রিয়। ফলে, সাঁড়াশি চাপে জীবনের মানেটাই বদলে গিয়েছে কাঁটাতারহীন সীমান্ত লাগোয়া গ্রামবাসীদের।
অথচ, কয়েকমাস আগেও পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল ন। দীর্ঘদিন অন্তর দু’একটা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটত। ইদানীং হামেশাই ঘটছে। তাতেই বিপত্তি বেড়েছে। সুপর্ণাদেবী বলছিলেন, ‘আমি বাড়িতে একা থাকি। উঠোনে সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ি। হাতমুখ ধোয়া থেকে শুরু করে শৌচকর্ম—সবই বাড়ির ভিতর বালতি রেখে করি। অস্বাস্থ্যকর হলেও কিছু করার নেই। সকাল না হওয়া পর্যন্ত বেরতে ভয় হয়।’
কথা হচ্ছিল প্রৌঢ় আমলকান্তি বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনিও বলছিলেন, ‘শীতের রাতে গায়ে চাদর চড়িয়ে বাথরুমে গেলে দূর থেকে কেউ অনুপ্রবেশকারী ভেবে ভুল করে। বিএসএফের কর্মীরাও বুঝতে না পেরে তেড়ে আসেন। তাই বাধ্য হয়েই বাথরুমের এই বিশেষ পন্থা। ওরা এসে আশ্রয়ের আবদার করে। আমরা দরজা খুলি না।’