প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ততা বৃদ্ধি। গৃহে কোনও শুভানুষ্ঠান উপলক্ষে অতিথি সমাগমে আনন্দ। দেহে আঘাত ... বিশদ
‘যাবেন কোথায়?’
‘ডিএফও-র বাংলোয়।’
‘ও তাহলে তো আমরা একই পথের যাত্রী। ওখানেই আমার বাড়ি। কিন্তু আপনি এই ফাঁকা স্টেশনে মশাই একা বসে থাকবেন? আমার বাস ছেড়ে দিচ্ছে। আপনি যদি আপনার জিপে আমায় লিফ্ট দেন তো আমি থেকে যেতে পারি।’ বিভূতিবাবু ইতস্তত করছিলেন। লোকটা বলল, ‘আপত্তি থাকলে চলে যাচ্ছি। আপনি একা বসে থাকবেন। জিপে গেলে আমার জার্নিটা একটু আরামের হতো। অনেকটা পথ তো। তাই বলছিলাম।’ বিভূতিবাবু ভাবলেন, সত্যিই তো তিনি একা হয়ে যাবেন। তাই বললেন, ‘ঠিক আছে। তাই হবে। চলুন আমার সঙ্গে।’ লোকটা বলল, ‘আমি বাসে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু, এই নির্জন স্টেশনে অফিসের জিপ আসার অপেক্ষায় আপনি কতক্ষণ একা বসে থাকবেন, ভেবে খারাপ লাগল তাই বললাম।’
‘সেটা ঠিকই। জিপের অপেক্ষায় ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে একা বসে থাকা আমি তো কল্পনাই করতে পারছি না। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি বরং উল্টে আমার উপকারই করলেন।’ লোকটা বলল, ‘আজকের দিনে মানুষ চেনা দায় মশাই। কে যে কী মতলবে ঘোরে কে বলতে পারে?’ বিভূতিবাবু বললেন, ‘কেন? আপনার মতো পরোপকারী মানুষও তো আছে।’ লোকটা বলল, ‘লজ্জা দেবেন না। এতে আর উপকারের
কী আছে।’
বিভূতিবাবু আবারও ঘড়ি দেখলেন। বললেন, ‘দু’ঘণ্টা হয়ে গেল। জিপ তো এখনও এল না। ফোন করছি, ফোন ধরছে না।’ লোকটা বলল, ‘ওই জিপের আশা ছাড়ুন মশাই। কাল সকালে এখান থেকে লাক্সারি বাস পেয়ে যাবেন। ডিএফও-র বাংলোয় আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব আপনাকে।’ বিভূতিবাবু বললেন, ‘তাহলে তো খুবই উপকার হয়। সত্যি, ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে দেখা হল। আরও কতক্ষণ লাগাবে কে জানে! লোকটা বলল, ‘পাহাড়ি রাস্তা, হয়তো জিপটা বিগড়েছে। কিংবা হয়তো তেল ফুরিয়ে গেছে। হতেও তো পারে। তাহলে তো সেই ড্রাইভারেরও দুর্ভোগের একশেষ।’ বিভূতিবাবু বললেন, ‘সেরকমই কিছু একটা গল্প
শোনাবে এসে।’
লোকটা বলল, ‘ওয়েটিং রুম তো আছে। তবে নাম কা ওয়াস্তে। তালায় জং পড়ে আছে। মনে হচ্ছে স্টেশনেই রাতটা কাটাতে হবে, এখানেই একটা ব্যবস্থা করে ফেলুন। অভ্যেস আছে তো নাকি? আমার আবার মশাই যেখানেই কাত সেখানেই রাত। সবেতেই অভ্যস্ত আমি।’
‘আমার জন্য আপনারও ভোগান্তি হচ্ছে।’
‘ভোগান্তি কপালে থাকলে খণ্ডাবে কে? শীতকাল হলে ভোগান্তি কাকে বলে মালুম হতো।’
বিভূতিবাবুর মনে পড়ল, কিটব্যাগে কিছু স্ন্যাকস, বিস্কুট রয়েছে। চটপট সেগুলোর সদগতি করলেন। লোকটাকেও ভাগ দিয়ে ভদ্রতা করলেন। লোকটা বলল, ‘ফার্স্ট ক্লাস। একটু খিদে খিদে পাচ্ছিল। তাই আর লজ্জা করব না মশাই।’ বিভূতিবাবুও ওই হাতের পাঁচ স্ন্যাকস দিয়েই বলতে গেলে ডিনার সেরে নিলেন। ঢকঢক করে বোতল উপুড় করে একপেট জল খেলেন। ব্যাগ থেকে একটা পলিথিনের শিট বের করে পেতে নিলেন বিভূতিবাবু। তারপর ক্লান্ত শরীরটাকে দিব্যি গড়িয়ে দিলেন। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিল। খানিক চোখ বুজে শুয়ে রইলেন বিভূতিবাবু। লোকটা বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি তো আছি আপনার মাথার কাছে। ঘুম পেলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন।’ বিভূতিবাবু মনে মনে বললেন, মানুষ চেনা দায় বলে তো লেকচার দিলেন মশাই। আপনি নিজেও যে সেই দলেরই না, তার প্রমাণ কী? এখন আমি ঘুমিয়ে পড়লে আপনার কাজের সুবিধা হয় তাই তো?
লোকটা বলল, ‘আমার রাত জাগা অভ্যেস আছে?’
থাকবেই তো। নইলে কাজ হাসিল করবে কীভাবে? হু হু বাওয়া, গায়ে পড়ে উপকার করার মতলবটা বুঝি। তুমি যতই বল না কেন, আমি তোমার ট্র্যাপে পা দিচ্ছি না। মনে মনে এসব ভেবে নিয়েই মনস্থির করলেন, তিনি ঘুমোবেন না। কিন্তু কপালের ফের। কখন ঘুমে দু’চোখ জুড়িয়ে এল! তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিল। আচমকা ঘুমের ঘোর কাটতেই হুড়মুড় করে উঠে বসলেন বিভূতিবাবু। হ্যাঁ, ঠিক তাই। যা ভেবেছেন তাই।
লোকটা কখন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। বিভূতিবাবুর ট্রলি সুটকেস, কিটব্যাগ পুরো লাগেজই হাপিস করে দিয়েছে লোকটা। বিভূতিবাবুর বোঝা উচিত ছিল। তিনি বুঝেওছিলেন ঠিকই। কিন্তু ওই যে গ্রহের ফের? তাই বুঝেও না বোঝার খেসারত দিতে হল।
যদিও পকেটে রেস্তো ভালোই আছে, কিন্তু কিটব্যাগেও অনেক টাকাকড়ি ছিল। আর ট্রলি সুটকেসটায় তো বিভূতিবাবুর বলতে গেলে গোটা সংসারটাই ছিল। প্ল্যাটফর্মে দু’দণ্ডের আলাপে কেউ কাউকে এতটা বিশ্বাস করে? লোকে শুনলে তো ছ্যা ছ্যা করবে। ফালতু লোকজন গায়ে পড়ে জ্ঞান দেবে। কিন্তু, বিভূতিবাবু তো লোকটাকে একেবারেই বিশ্বাস করেননি। বরং সন্দেহই করেছিলেন। কিন্তু চোখ দুটো কেন যে এত বিট্রে করল, তা ভেবে পাচ্ছেন না বিভূতিবাবু।
এই নির্জন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লোকটা তবু মন্দের ভালো ছিল। আফটার অল একজন সঙ্গী তো ছিল। এখন বিভূতিবাবুর আমও গেল ছালাও গেল। শুনশান স্টেশন। এখানে আবার তেনাদের বাসও রয়েছে কি না কে জানে? ভূত-প্রেত যদি না-ও থাকে, স্টেশনের ওপারে ঘন বন জঙ্গল। সেই জঙ্গল থেকে যদি কোনও জংলি জানোয়ার এসে চড়াও হয়! তবে? ভেবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল বিভূতিবাবুর। বোতলের জলটুকু তখনই শেষ করে রেখেছেন। এখন চোখের জল ফেললেও গলা ভিজবে না। ঠিক তখনই বিভূতিবাবুর অফিসের জিপটা এসে দাঁড়াল। তার চওড়া হেডলাইটের আলো এসে ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে। বিভূতিবাবু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। সর্বস্ব গিয়েছে যাক। জানটা যে বেঘোরে যায়নি, এই রক্ষে। ওই লোকটা তো বিভূতিবাবুর মাথায় ডাণ্ডা মেরে সব নিয়ে পালাতে পারত। কিন্তু, তা যে করেনি লোকটা, সেটাই বহুজন্মের পুণ্যের ফল। লোকটা ভদ্রলোকের মতো ঘুম পাড়িয়ে মাল নিয়ে সটকে পড়েছে।
ড্রাইভার তড়িঘড়ি এসে বলল, ‘স্যার, মাঝপথে গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেছিল স্যার। বলব কী, সাত সাত চোদ্দো কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে যাওয়া আসা। পেট্রল পাম্প থেকে তেল এনে তেল ভরে তবে আসছি স্যার। আমার নাম বিপিনবিহারী ঘোষ দস্তিদার। আমি আপনার ডিপার্টমেন্টের সবেধন নীলমণি। একমাত্র ড্রাইভার। স্টেশনে কি আপনি একা ছিলেন?’ ড্রাইভারের কথা শুনে গা চিড়বিড় করে জ্বলে গেল বিভূতিবাবুর। বললেন, ‘আমি কি এখানে বরযাত্রী এসেছি যে দলবল থাকবে আমার সঙ্গে?’
‘রাগ করবেন না স্যার। আপনার লাগেজ কোথায় রেখেছেন বলুন। অনেকটা পথ যেতে হবে জলদি জলদি চলুন।’ লাগেজের কথায় বিভূতিবাবুর মাথায় চড়াত করে রক্ত চড়ে গেল। তবু রাগটা কোনওমতে সামলে নিয়ে বললেন, ‘লাগেজটা এক পরোপকারীকে গিফ্ট দিয়েছি আমি।’
‘তাহলে তো পরোপকারীকেও পেয়েছিলেন বলুন। একা থাকতে হয়নি আপনাকে।’ ড্রাইভারের এধরনের রসিকতা শুনে গা রি রি করে জ্বলে গেল বিভূতিবাবুর। তবুও তিনি নিজেকে সংযত করলেন। আর কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ গিয়ে জিপে উঠে বসলেন। কিন্তু জিপে উঠে বসতেই জবর ধাক্কা খেলেন বিভূতিবাবু। জিপের ভেতরে তাঁর লাগেজ সবই সাজানো রয়েছে। তখনই জিপের পেছনের সিটে উঠে বসল সেই লোকটা। লোকটা বলল, ‘আমি বনবিহারী। বিপিনবিহারী আমার ভাই। জিপেই আসছিলাম। তেল ফুরিয়ে গেল। আমি বাস ধরে নিলাম। আপনাকে রিসিভ করতে হবে তো।’
‘কিন্তু, আপনি না বলে আমার লাগেজ নিয়ে কোথায় চলে গেছিলেন?’
‘ওই দূরে ওই মৌসির চায়ের দোকানে। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন। তাই আপনাকে আর ডাকিনি। ট্রলি টানতে টানতে গেলাম আর চলে এলাম। চুরি হতো না। তবু সাবধানের তো মার নেই। জানেন তো?’