পারিবারিক ক্ষেত্রে বহু প্রচেষ্টার পর শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। সন্তানের কর্ম উন্নতিতে আনন্দ লাভ। অর্থকর্মে শুভ। ... বিশদ
এককালে কুম্ভমেলায় এসে দুই ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার অংশটা ছিল বলিউডি সিনেমার কমন পার্ট। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের শেষে ক্ল্যাইম্যাক্সে এসে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে একটা উল্কি বা পেনডেন্ট দেখে খুঁজে পেতেন বাবা-মা। ভাই ফিরে পেত ভাইকে। সবার চোখে জল। হ্যাপি এন্ডিং। মোবাইল ‘ইনভেশনে’ সেই ট্রেন্ড অনেকটাই অফ ট্র্যাক। কিন্তু তারপরেও মানুষ হারিয়ে যায়। যেমন হারিয়ে গিয়েছে নিশা নাইড়ুর ঠাকুমা। কাঁদো কাঁদো গলা আর ভাঙা হিন্দিতে চিত্তুরের নিশা জানাল, ‘ঠাকুমার সঙ্গে হাত ধরেই মেলায় ঘুরছিলাম। মাঝে হঠাৎ ভিড়ের চাপে হাত ফসকে যায়। তারপর এদিক ওদিক অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছি।’ নন্দী দ্বারের পরেই মহাকুম্ভের লোগো দেওয়া যে গ্লো-সাইন বোর্ডটা আছে, তার উপরেও উঠেছিল সে। তবু দেখা পায়নি। শুনেই ঠাকুমার মোবাইল নম্বর চাইলেন একজন। কিন্তু ঠাকুমার কাছে কোনও ফোন নেই। তাই সব ডিটেইলস নিয়ে শুরু হল মাইকে ঘোষণা।
কুম্ভমেলার মডেল অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনে তখন প্রায় ১২টি পরিবার বসে। প্রত্যেকেরই কেউ না কেউ হারিয়েছেন। মাইকে প্রিয়জনের নাম শুনলেই একটু উদগ্রীব হয়ে এদিক-ওদিক চাইছেন। দু’চোখে চঞ্চলতা। দেখা না পেলে নেমে আসা হতাশাও। ফের শুরু অপেক্ষা। অন্তহীন।
কুম্ভে সবচেয়ে বেশি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে স্নানের ঘাটে। আরও পিন পয়েন্ট করে বললে স্নান সেরে ওঠার পর। হয়তো কেউ ডুব দিল এখানে, স্রোতের টানে উঠল ২০ মিটার দূরে। এর মধ্যে মানুষের গাদাগাদি ভিড়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। এবার অবশ্য দুর্ঘটনা ও হারিয়ে যাওয়ায় রাশ টানতে নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। নদীর সামনের দিকের কিছুটা অংশ স্নানের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে প্লাস্টিকের ব্যারিকেড, দড়ি দিয়ে। এই অংশে জল কোনওমতে হাঁটু ছুঁয়েছে। ফলে ডুব দেওয়াই দায়। ভেসে যাওয়া তো দূর কি বাত। তার পরেও মানুষ হারাচ্ছেন। স্নান থেকে উঠে ডানদিকের বদলে বাঁ দিকে চলে যাচ্ছেন, কেউ আবার গুলিয়ে ফেলছেন কত নম্বর ল্যাম্পপোস্টকে তিনি ল্যান্ডমার্ক করেছিলেন। ব্যস, তার পরেই গন্তব্য খোয়া-পায়া কেন্দ্র। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে সেজন্য অনেকেই পরিবারের সামনের জনের চাদরের খুঁট বা শাড়ির আঁচল হাতে ধরে হাঁটছেন। অনেকটা ছোটবেলাকার রেলগাড়ির মতো করে।
নিশার অবশ্য ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই ঠাকুমাকে পাওয়া গিয়েছে। যাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের কী হবে? কেন্দ্রের এক কর্মী জানালেন সেকথা। বললেন, ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ খুঁজে পেলে আমাদের এই ক্যাম্পে এনে ছবি তুলে নাম-ঠিকানা জেনে রেজিস্ট্রেশন করে রাখা হয়। জানতে চাওয়া হয় বাড়ির সদস্যদের ফোন নম্বর। যাতে দ্রুত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। কখনও কখনও অনেকে চট করে নম্বর বলতে পারেন না। তখন খুঁজে পেতে দেরি। সেক্ষেত্রে অবশ্য ক্যাম্পে খাওয়াদাওয়া, এমনকী শোওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।’ এর মধ্যেই নিখোঁজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে বিকাশ পান্ডের। বাঁ দিকের বদলে ভিডিও করতে করতে সোজা বড় হনুমান মন্দিরের দিকে চলে গিয়েছিল সে। ডিজিটাল ব্যবস্থা আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ক্যামেরায় ফেস রেকগনিশন তাকে ফিরিয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে গোটা বিষয়া যে অনেক সহজ হয়েছে, মেনেছেন অনুসন্ধান কেন্দ্রের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত মণীশ ঝা-ও।
শুধু খোয়া-পায়া কেন্দ্র নয়, প্রতিটা পন্টুন ব্রিজের পাশেই রয়েছে একটা করে পুলিসি সহায়তা কেন্দ্র। ভিড় করছেন বহু মানুষ। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিড় সঙ্গম ঘাটের পুলিসি সহায়তা কেন্দ্রে। সেখানে আবার প্রিয়জনকে খুঁজে দেওয়ার আর্জি নিয়ে গেলে ঘোষণা করানো হচ্ছে তাঁকে দিয়েই। নানান ভাষায় মাইকে ঘোষণা চলছে।
সঙ্গম ঘাট থেকে কিলা ঘাটের দিকে যাওয়ার চোখে পড়ল, গঙ্গা জল নেওয়ার দুটো সদ্য কেনা পাত্র নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে এক নম্বর ওয়াচ টাওয়ারের দিকে দৌড়চ্ছে এক কিশোর। সে দৌড় মাকে হারিয়ে ফেলার? নাকি বকুনির ভয়ে? বোঝা গেল না। তবে গতি দেখলে চোখ বড় হতো উসেইন বোল্টেরও। কারণ তখন কানে আসছে একটা বাঙালি গলা। সুতীক্ষ্ণ কণ্ঠে এক মহিলা সুর সপ্তমে চড়িয়ে ছেলে তীর্থঙ্করের উদ্দেশে বলছেন, ‘যেখানে দাঁড়াতে বলেছিলাম, সেখানে তো এসে তোকে দেখতে পেলাম না! কোথায় ঘুরছিস? এক্ষুনি এক নম্বর ওয়াচ টাওয়ারের নীচে আয়।’