পুজোর আগে কুল খেয়ে করলে ভুল? এবার কী হবে! বিদ্যার দেবীর পুজো ঘিরে রম্যরচনায় শ্যামল চক্রবর্তী।
সরস্বতী পুজোর আগে তুই কুল খেয়ে নিয়েছিস মিঠি, তোর অঙ্কে গোল্লা পাওয়া কে আটকায়!’ মহাশ্বেতা গার্লস স্কুলের ক্লাস এইটের বোনকে চোখ পাকিয়ে বলল ওর দাদা পলক।
‘তুইও খেয়েছিস দাদা, ইংরেজিতে গোল্লা পাবি’, পাল্টা দিতে গিয়ে রেগে বলে উঠল মিঠি।
‘এভাবে শাপ দিস না, ইংরেজি পরীক্ষা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। গোল্লায় গোল্লায় কাটাকুটি! তুই অঙ্কে ভালো নম্বর পাবি, আমি ইংরেজিতে’, বলে বোনের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিচ্ছে শিবশঙ্কর স্কুলের ক্লাস টেনের পলক।
কাল সরস্বতী পুজো। পলক ছুটছে স্কুলের দিকে। ক্লাস টেনই এবার পুজোটা করছে। স্কুলে স্কুলে পুজোর কার্ড দেওয়া। পুজোর আমন্ত্রণপত্র দেওয়ার জন্য পলক বেছে বেছে মেয়েদের স্কুলগুলোতে গিয়েছে। বীণাপাণি বিদ্যামন্দির, মানময়ী গার্লস, পরমাসুন্দরী মেমোরিয়াল, সীমন্তিনী বিদ্যাভবন, তুহিনা গার্লস। বীণাপাণি স্কুলে কার্ড দিতে গিয়ে এক ঝলক চোখ চলে গিয়েছে চূর্ণকুন্তলা, পটলচেরা চোখ, ক্লাস টেনের উজ্জ্বল চেহারার অলির দিকে। তারপর থেকেই দিনরাত প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে পলকের বুকে!
বেলা পড়তেই দশকর্মার বাজার করতে ছুটল ঋকরা তিনজন। প্যান্ডেল বাঁধার কাজ করছে স্পর্শরা ছ’জন মিলে। প্যান্ডেল বাঁধা শেষ হতে না হতেই সরস্বতীর প্রতিমা নিয়ে এসে হাজির হবে পরাগরা। পুজোর সব জোগাড়যন্ত্র শেষ করে একছুটে বাড়ি গিয়ে আবার স্কুলে। সারারাত পুজোর প্যান্ডেলের পিছনে সবাই মিলে রাত জাগা।
সারাদিন ঘুমিয়ে আজকের রাতটা সারারাত জেগে কাটাবেন প্রবল ফুলপ্রেমী হইচই বসাক। গত বছর পুজোর আগের রাতে হইচইবাবু ওরফে ফুলবাবু রাতে ঘুমের জন্য শাস্তি পেয়েছেন অনেক। ফুলবাবুর থোকা থোকা বিশাল সাইজের লাল আর হলুদ গাঁদাফুলের সব টব নিঃশব্দে তুলে নিয়ে এসে স্কুলের বিচ্ছু ছেলেরা প্যান্ডেল সাজিয়েছিল!
‘তোরা সবক’টা পরীক্ষায় ফেল করবি এবার’, ঘুম ভেঙে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এসেছিলেন হইচইবাবু।
‘টবগুলো যে আপনার তার কোনও প্রমাণ আছে?’ গম্ভীর গলায় জানতে চেয়েছিলেন পুজোর দায়িত্বে থাকা ভূগোলস্যার বলরামবাবু।
‘টিচার না হয়ে আপনার উকিল হওয়া উচিত ছিল।’
‘রেগে যাচ্ছেন কেন ফুলকাকু! আমরা স্কুলের ছাদে তিন মাস ধরে অনেক কষ্টে তৈরি করেছি। দেখছেন না, সব টবের বাইরে সাদা চুনকাম করা,’ বলেছিল স্মরণ।
‘টবে সাদা রঙের ওপর সংক্ষেপে স্কুলের নাম ‘শিব’ লেখা আছে তুলি দিয়ে,’ ভূগোল স্যারের ওকালতির ঠেলায় ফুলবাবু প্রায় কাঁদতে কাঁদতে দৌড় মেরেছিলেন বাড়ির দিকে!
ক্লাস টেনের দশজন ছাত্র রাতে জাগবে প্যান্ডেলের পিছনে। সবাই বাড়ি থেকে কম্বল নিয়ে এসেছে। মা সরস্বতীর কৃপায় মিলে যাওয়া এমন নৈশ স্বাধীনতার সবটুকু চেটেপুটে খাবে ওরা। ভূগোল স্যারের কড়া নির্দেশ, সঙ্গে মোবাইল ফোন আনা চলবে না। তাতেই বা কী! পলক ঠিক করেই রেখেছে, সিগারেটে প্রথম টানটা আজ রাতেই দেবে। গতবছর নাকি স্পর্শদা প্রথম টানটা মেরেই কাশতে কাশতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল! যা হয় হোক, আজ রাতেই পলকের প্রথম মুখেতামাক!
ওদিকে মিঠি বিকেলেই বন্ধু পৃথা আর কেয়ার সঙ্গে বসে ঠিক করে রেখেছে, কাল কোন বাসন্তীরঙা শাড়িটা পরে স্কুলে যাবে। পুজো শেষ হতেই অঞ্জলি দিয়ে দে ছুট। এপাড়া থেকে ওপাড়া। ইতিউতি চোখাচোখি। বেলায় স্কুলে ফিরে পুজোর লুচি আর আলুর দম।
গতবছর শেষপাতের মিহিদানা অনেকেই পায়নি। ক্লাস টেনের দিদিরা নাকি এক বালতি মিহিদানা আগেই সরিয়ে ফেলেছিল!
গত বছরের সরস্বতী পুজোর সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আজও মনে পড়ে গুন্ডার। গুন্ডারা পাঁচজন মিলে চাঁদা তুলতে বেরিয়েছে নবযুবক সংঘের পুজোর। বিপিন পালের বাড়িতে ঢুকতেই সাদর অভ্যর্থনা,
‘এসো, পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দেব, তার আগে সরস্বতীর দশটা নাম বলো দেখি!’
‘সরসত্যি, বীনাপানি, সেতা, মহাসেতা, বানি...’, বলে বসল ক্লাসের ফেলুবাবা দশরথ।
‘সরস্বতীর বানানটা বলো।’
‘দন্ত স য় ব, র, দন্ত স, তয় হস্যি।’
‘বাঃ! আর বীণাপাণি?’
‘ব য় হস্যি, দন্ত ন য় আকার, প য় আকার, দন্ত ন য় হস্যি।’
‘ওরে রঘু, আমার মোটা লাঠিটা একবার নিয়ে আয় দেখি, এই মূর্খগুলোর পিঠে লাঠি ভেঙে ওদের সরস্বতীর আরাধনা ঘুচিয়ে দিই,’ রাগে গড়গড় করছেন পালমশাই।
মিঠি কাল অঞ্জলি দেওয়ার পর সরস্বতীর কাছে শপথ নেবে, আর কোনওদিন পুজোর আগে কুল খাবে না। পলক কাল দুপুরে স্কুলে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে একছুটে চলে যাবে গঙ্গার পারে, যদি অপেক্ষায় থাকে অলি! মিঠি বাসন্তী শাড়ি পরে দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে যাবে দাদার স্কুলে। দাদার বন্ধু তন্ময়দাকে স্বপ্ন দেখেছে আজ ভোরে!