চলতি বিষয় না পড়লে চাকরি বা আয়ের সুযোগ কেমন? তা নিয়েই চলছে এই বিভাগ। মতামত জানালেন বিশেষজ্ঞরা।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসা
আচ্ছা, নিজের সময়ের বা শ্রমের মালিকানা যদি সম্পূর্ণই নিজের থাকে? কেমন হয় তাহলে? এককথায় ‘দারুণ’ বলে দেওয়ার আগে জিনিসটার ভালো-মন্দ বিচার করা চাই। আপনার শ্রম, আপনার অধিকার— কথাটা শুনতে বেশ ভালো লাগলেও এ পথে ঝুঁকিও কম নয়। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো জিনিস খেয়াল রাখতে হয়। প্রথমত কী বিষয়ে ব্যবসা করবেন। সেই জিনিসটার চাহিদা কেমন? ব্যবসায় যতটা লগ্নি করলেন তা সুদে আসলে উঠে আসার পর লাভের মুখ দেখতে কতদিন? এইসবের হিসেব করাটা জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই হাতেকলমে ব্যবসা করতে এসে দেখা যায়, হিসেবে গণ্ডগোল। ফলে ব্যবসা লাটে। তাহলে উপায়? ফ্র্যাঞ্চাইজি বিজনেস বিষয়ে ভাবতে পারেন।
ব্যবসার ধরন
কোনও একটা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির একটি শাখার মালিক হলেন আপনি। এরই নাম ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসা। অতএব পরিচিতিটাও রইল আবার ষোলো আনা অধিকারও আপনারই। এবার আপনি ভাবছেন তো? প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা তো অনেকই রয়েছে, কোনটা বাছবেন বা সেই বাছাটা সঠিক হল কি না বুঝবেন কী করে? ফ্র্যাঞ্চাইজি ট্রেনিং এক্সপার্ট অভিষেক মিশ্র বললেন, খানিকটা অবশ্যই ভাগ্য। কিন্তু অনেকটাই বিশদ পড়াশোনার উপর নির্ভর করে। আপনাকে এমন ব্যবসার কথা ভাবতে হবে যে বিষয়টা আপনি বোঝেন। না বুঝলে কিন্তু অতি বড় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার ফ্র্যাঞ্চাইজি নিলেও তা ডুবে যেতে পারে। প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের পাশাপাশি চেনা ব্যবসার দিকে হাত বাড়ানোটাও তাই সমান জরুরি।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসা শুরু করার সময় কয়েকটা জিনিস মনে রাখতে হবে: যে ব্র্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিচ্ছেন সেই বিষয়ে আপনার জ্ঞান কতটা। ব্র্যান্ডের পরিচিতি কতটা। আপনি যে অঞ্চলে ব্যবসাটা শুরু করবেন সেখানে ওই ব্র্যান্ডের জিনিসের চাহিদা আদৌ আছে কি না।
খাবার দোকানের ফ্র্যাঞ্চাইজি
একটু নামকরা ব্র্যান্ড বাছতে হবে। তাতে হয়তো আপনার লগ্নির মূল্য একটু বেশিই পড়বে, কিন্তু লাভের অঙ্কটাও সেই অনুপাতেই হবে। খাবারের মানের সঙ্গে কিন্তু আপস করা চলবে না। খদ্দের একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে তাঁদের বিশ্বাস আবার করে তৈরি করা মুশকিল। জিনিসের দাম অবশ্যই ব্যবসার অঞ্চলের উপর নির্ভর করবে। তবে একটু কমের দিকে দাম থাকলে তার বিক্রি বেশি হবে তা বলাই বাহুল্য। অঞ্চলটা কেমন, পাড়ায় কী ধরনের লোকের বাস এগুলো মাথায় রেখে ব্যবসা শুরু করুন। যেমন অবাঙালি পাড়া হলে খাবারের সিংহভাগই নিরামিষ রাখতে হবে। আবার বাঙালি পাড়ায় একটু আমিষ ঘেঁষা মেনু চাই। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা আসবে এমন খাবার রাখতে হবে। একটু স্ন্যাক্স গোছের মেনু থাকলে দামটা পকেটসই হয় বলে খদ্দেরও বেশি আসে। সেদিকটা ভেবে নেবেন। তবে পাড়া অনুযায়ী, লোক অনুযায়ী খাবারের ফ্র্যাঞ্চাইজি নির্বাচন করুন।
পোশাকের ফ্র্যাঞ্চাইজি
এক্ষেত্রে ভ্যারাইটি খুবই জরুরি, জানালেন অভিষেক মিশ্র। তাঁর কথায় কোয়ালিটি সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নিজেকে একটা গণ্ডিতে বেঁধে ফেলবেন না। বস্ত্র বিপণির ক্ষেত্রে সব বয়সের সকলের চাহিদা মেটে এমন ব্র্যান্ড বাছাই ভালো। তবে এর পাশাপাশি একটা কথা ঠিক, মহিলারা পোশাক কেনেন বেশি। ফলে যদি এমন গারমেন্ট ফ্র্যাঞ্চাইজি বাছেন, যেখানে মহিলা ও শিশুদের পোশাক পাওয়া যায় তাহলে সেটাও মন্দ চলবে না। অনেকে শুধুই শিশুদের পোশাকের ফ্র্যাঞ্চাইজি চান। সেক্ষেত্রে এই বিষয়টা নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করে তবেই ফ্র্যাঞ্চাইজি নিন। সকলেই কিন্তু বাচ্চার ব্যাপারে একটু অতিরিক্ত সচেতন। ফলে পোশাকের থ্রেড কাউন্ট, ফিল, ফ্যাব্রিক (ব্রিদেবল কিনা) এই সবই জেনে বুঝে তবেই এই ধরনের ব্যবসা শুরু করুন।
গয়নার ফ্র্যাঞ্চাইজি
‘এর আবার প্রচুর ধরন আছে। কস্টিউম, সেমি প্রেশাস, সিলভার ইত্যাদি।’ বললেন অভিষেক মিশ্র। তাঁর কথায়, ‘প্রতিটি গয়নার ধরন জেনে তবেই এই ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়া উচিত। এই ফিল্ডে প্রতিদিন নতুন ডিজাইন, নতুন মেটিরিয়াল উঠে আসছে। কাগজ, কাপড়, বিডস, স্টোন, কী নেই এই ব্যবসায়? অতএব সবটা জেনে নিন।’ নতুনত্বের সঙ্গে আপনার পছন্দের ব্র্যান্ডটি পাল্লা দিতে পারবে কি না সে বিষয়ে ভেবেচিন্তে তবেই ব্র্যান্ড নির্বাচন করুন। অনেকে অবশ্য স্পেশালাইজ করতে চান। অর্থাৎ রুপোর গয়নার ব্যবসা করবেন। তাহলেও সেই গয়নার নকশা, তার মান ইত্যাদি সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান ও পড়াশোনা থাকা চাই। তাছাড়া এক্ষেত্রে দামটা একটু বেশিই রাখতে হবে, সেটা আপনার দোকান যে অঞ্চলে সেখানে চলবে কি না, তাও জানতে হবে। এই ধরনের খুঁটিনাটিগুলো খুব ভালো করে বুঝে নিয়ে তবেই এই ব্যবসায় নামবেন।
ব্যবসার ভালো মন্দ
ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড। নামটা লোকের কাছে পরিচিত। ফলে নতুন করে প্রচারের প্রয়োজন নেই। এছাড়াও ফ্র্যাঞ্চাইজি হেডের সঙ্গে কথা বলে জিনিসপত্র অনেক ক্ষেত্রেই একটু সুলভে পাওয়া যায়। স্টকের দিকটাও নিশ্চিন্ত। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় প্রতিদিনের স্টক নতুন করে সাজাতে হবে না। মালপত্র নিজে থেকেই এসে যাবে। লোকের বিশ্বাস বা আস্থা অর্জনও নতুন করে করার প্রয়োজন নেই। ফলে প্রচার, বিজ্ঞাপনের খরচের দিকটা কিছুটা হলেও কম হয়।
আবার ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে পুঁজি একটু বেশিই লাগে। কারণ যে ব্র্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি, তাদের টাকা দিতে হয়। পাশাপাশি দোকানের স্পেস, সেটআপ, সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদির পিছনেও যথেষ্ট খরচ হয়। ফলে ব্যাঙ্ক লোন নিন কিংবা নিজের জমানো টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করুন— তার পরিমাণ একটু বেশিই প্রয়োজন। এবং ব্যবসা না চললে ক্ষতির আশঙ্কাও বেশি।
তবে ঝুঁকি না নিলে কোনওদিন কিছু শুরু করাই সম্ভব নয়, ফলে এইটুকু রিস্ক নিতেই হবে, জানালেন অভিষেক।
খুব ভেবেচিন্তে সবটা দেখেশুনে তবেই এই ধরনের ব্যবসায় নামতে হবে। অন্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছেন যেহেতু, তাই দায়িত্ব কিন্তু কমল না, বরং সচেতনতা একটু অতিরিক্ত বেশিই রাখা দরকার। অর্থাৎ এগ্রিমেন্ট খুব খুঁটিয়ে পড়ে তবেই তা সই করুন। আপনি কতটা দিচ্ছেন এবং বিনিময়ে কী পাচ্ছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নিয়ে তবেই এই ধরনের ব্যবসায় নামার কথা ভাবুন। অনেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়ে শুরু করে পরে তা ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসায় চলে যান। সেদিকটা যাতে খোলা থাকে সেটাও মাথায় রাখবেন। এগ্রিমেন্ট কনট্র্যাক্ট বাৎসরিক বা পাঁচ বছরের বেশি করবেন না। এই দিকগুলো খেয়াল রেখে ভালো মতো আঁটঘাট বেঁধে তবেই শুরু করুন ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসা।
কমলিনী চক্রবর্তী