একসময় ছিল সাপে-নেউলে সম্পর্ক। ফিরে যেতে হয় বাহাত্তর-সাতাত্তর সালে। যখন অত্যাচারিত হচ্ছিল সিপিএম কর্মী সমর্থকরা। খুনোখুনির রাজনীতি। কংগ্রেস জমানার সেই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়া শুরু হল বাম জমানায়। শুধুমাত্র কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে বলে সন্দেহবশত হাত কেটে নেওয়া হল ভোটারের। সে সবই এখনও ইতিহাস। তবে, ওই দুই জমানায় ভুক্তভোগীদের সেই দগদগে ক্ষতটি থেকে গিয়েছে বহু কংগ্রেস বা সিপিএম কর্মী সমর্থক বা তাদের পরিবারের অন্তরে। তাই, ভোটের জন্য ‘ধান্দাবাজি’র রাজনীতিতে কংগ্রেস সিপিএমের সখ্যকে উভয় শিবিরের অনেকেই হয়তো স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। সেইসব অত্যাচারিত মানুষের অন্তরের ব্যথাকে গুরুত্ব না দিয়ে তৃণমূল জমানায় শুরু হয়ে যায় উভয় শিবিরের মধুচন্দ্রিমা। উদ্দেশ্য একটাই ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। তাই, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বাম এবং কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করার পর থেকেই প্রতিপক্ষ এই দুই রাজনৈতিক শিবির তালমিল রেখেই চলছিল। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্য্যুতে একযোগে প্রতিবাদে তাদের সরব হতেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু, যেখানে নিজেদের স্বার্থ রক্ষাটাই বড় ব্যাপার, নীতি আদর্শের কোনও বালাই নেই সেখানে এই সখ্য কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব? এই প্রশ্নটাই বড় আকারে দেখা দিল আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রত্যাশিতভাবেই ভোটের লড়াইয়ে আসন বণ্টন নিয়ে দুই শিবিরের আকচাআকচির পরিণতিতে সেই মধুচন্দ্রিমায় সম্ভবত ছেদ পড়তে চলছে। অন্তত রাজ্য বামফ্রন্টের বৈঠকে মোট ২৫ জন প্রার্থীর নাম একতরফাভাবে বাম নেতারা চূড়ান্ত করে ফেলার পর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেনি কংগ্রেস। এআইসিসি নির্বাচন কমিটির বৈঠকেও রাজ্যের ১১জন কংগ্রেস প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করে ঘোষণা করে দিয়েছে তারা। বাম-কংগ্রেসের মধ্যে জোট বা সমঝোতার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়ে এইভাবে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দেওয়ার বিষয়টি উভয় শিবিরের মধ্যে দূরত্ব যে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শেষ মুহূর্তে অবশ্য, বঙ্গ সিপিএম নেতারা সমঝোতার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যদিও, প্রার্থী ঘোষণার ঘটনায় তাঁদের সাংগঠনিক দুর্বলতাটি প্রকাশ হয়ে পড়ল। বরাবরই কংগ্রেসের সঙ্গে সখ্যের বিরুদ্ধে থাকা কট্টরপন্থী প্রকাশ কারাত লবির বক্তব্যকে আমল না দিয়ে, এমনকী সমঝোতার জন্য প্রার্থীদের নাম নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা না করেই একতরফাভাবে বামেরা ২৫টি আসনের জন্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে—দলের অন্দরে এবং কংগ্রেস শিবিরেও। প্রায় সাইন বোর্ডে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া বঙ্গ সিপিএমের মধ্যে দাদাগিরি করার প্রবণতাটি যে এখনও বহাল রয়েছে, এ ঘটনা তারই প্রমাণ।
রাজ্যের মোট ৪২ টি আসনের মধ্যে ১১টি লোকসভা আসনের জন্য কংগ্রেস প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করার পর এখন যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হল—ওই আসনগুলিতে অন্তত চতুর্মুখী লড়াই হতে চলেছে। বিরোধী ভোট ভাগাভাগির কারণে এর ফলে শাসক দল তৃণমূল বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। আর, কংগ্রেসের এই একলা চলার সিদ্ধান্তে বেকায়দায় পড়বে সিপিএম। যদিও সিপিএম এখনও হাল ছাড়তে নারাজ। লোকসভা নির্বাচনে এ-রাজ্যে বাম-কংগ্রেসের মধ্যে জোট দফারফার প্রশ্নটি সামনে এসে যাওয়ায় অন্য রাজ্যে জোট রাজনীতির ক্ষেত্রে তা কতটা প্রভাব ফেলবে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কারণ, আগে সিপিএম ঘোষণা করেছিল—পশ্চিমবঙ্গের মতোই তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, বিহার ও ওড়িশাতে কংগ্রেসের সঙ্গে রাজ্যভিত্তিক আসন সমঝোতার পথে তারা হাঁটবে। বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গে ধাক্কা খাওয়ায় এবং কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত এই রাজ্যে ‘একলা চলো’ নীতি গ্রহণ করায় তার প্রভাব অন্য রাজ্যে সমঝোতার ক্ষেত্রে পড়লে অবাক হওয়ার নয়। একটা আশঙ্কা তো থেকেই যায়। সেক্ষেত্রেও হয়তো এসে যাবে ভোট ভাগাভাগির প্রশ্নটিও। সিপিএমের আরও কোণঠাসা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
বাম-কংগ্রেস জোটের দফারফা হলে উভয় শিবিরের কে কতটা লাভবান হবে বা হবে না তা যথাসময়েই জানা যাবে। তবে, শাসক-বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হলে শাসক দল যে বাড়তি কিছুটা সুবিধা পেয়ে যায় সেটা জানা কথা। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মোদির দল বিজেপি অন্য কোনও কোনও রাজ্যে কিছুটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে চলে আসতে পারে। আর, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে একইভাবে সেই সুবিধা পেতে পারে তৃণমূল। অবশ্য, সবটাই নির্ভর করবে জনগণেশ কী চায় তার উপর। আসলে, নীতি আদর্শের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর দুই প্রতিপক্ষের জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে থাকে নানা প্রতিবন্ধকতা। এই রাজ্যে সিপিএম তার অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও সমঝোতার প্রশ্নে শেষরক্ষা করতে তারা বিফল হয়েছে। বঙ্গ বাম নেতাদের একাংশের ঔদ্ধত্যের কারণেই তাদের এই ব্যর্থতা। এতে মুখ তাদেরই বেশি পুড়ল।