সাপ্তাহিক বর্তমান

জাতিস্মর কারা হয়?
তাঁরা কেন রহস্যময়?

জাতিস্মর কারা হয়? এখানেই যত বিস্ময়! এদের পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। তেমনই তাদের কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল সেই বিবরণও দেয়। একমাত্র তারাই মৃত্যুর অভিজ্ঞতা কিংবা স্মৃতির প্রত্যক্ষ বিবরণ দেওয়ার অধিকারী। জাতিস্মরদের নিয়ে যখনই গবেষকরা রিসার্চ করেন, তখনই প্রশ্ন করা হয়েছে মৃত্যু কীভাবে হল? তাঁর পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশি-বন্ধু কেমন ছিল? মানুষ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জানতে পারে না যে, ঠিক মৃত্যুর মুহূর্তটি কেমন হবে! কীভাবে পলকের মধ্যে মৃত্যু এসে জীবনকে স্তব্ধ করে দেয়! তখন কেমন বোধ হয়? মৃত্যুকে কেমন দেখেছে সে? এটাই যুগ যুগ ধরে জানতে চায় নশ্বর মানুষ! এর উত্তর জানে জাতিস্মররাই। কিন্তু সত্যিই কি উত্তর মেলে? এই চির রহস্যের কথা শোনালেন সমৃদ্ধ দত্ত।
 
মাত্র ১০ মাস বয়সে স্পষ্ট কথা উচ্চারণ করা যায়? তাও আবার মা নয়, বাপু নয়, একটি অব্যক্ত অক্ষরও নয়। সরাসরি বর! আসলে উচ্চারিত কথাটি ছিল, ‘পতি’। অর্থাৎ স্বামী। ১০ মাসের শিশু বহু ক্ষেত্রেই দ্রুত কথা শিখে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে কথা বলতে দেরি হয়। কিন্তু তার সামনে পতি কথাটা তেমনভাবে কখনও তো উচ্চারিত হয়নি! তাহলে আর কোনও শব্দ নয়, বারংবার ওই শব্দটি কেন এল মুখে? যদিও মেয়েটি যে পতিই বলছে, এটা প্রাথমিকভাবে বাবা মা বোঝেনি। গুরুত্বও দেয়নি। জন্মের কিছু মাস পর থেকে যতই বড় হবে, ততই নানারকম বোধ্য ও অবোধ্য শব্দ শিশুদের মুখে শোনাই যায়। এও তেমনই হয়তো। 
সন্দেহটা হল আরও পরে। যখন দেড় বছর বয়সের পর থেকে সে মাঝেমধ্যেই বিছানার একদিকে অথবা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণের অভিনয় করত। অর্থাৎ হঠাৎ শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস বন্ধ করে ফেলা। কিছুক্ষণ পর শ্বাসকষ্ট হলে আবার চোখ মেলে উঠে পড়ত। বিভ্রান্ত দেখাত চোখমুখ। হিন্দি পত্রিকা এসেছে বাড়িতে। যেমন আসে প্রতি মাসে। সেই পত্রিকার পাতা উল্টে যাচ্ছে ১৪ মাসের মেয়ে। আচমকা একটি পৃষ্ঠায় এসে সে থমকে গেল। এক নবদম্পতির ছবি ছাপা হয়েছে। বিবাহ সংক্রান্ত কোনও রচনা অথবা গল্প কিছু একটা বিষয় নিয়ে লেখা। ছবিতে হাত বোলায় শিশুকন্যা। তার চোখ থেকে জল পড়ে। ছবির পুরুষকে দেখিয়ে বলে সেই চেনা শব্দটি, পতি...পতি...পতি..। আর নববধূর দিকে অঙ্গুলিহেলন করে বারংবার দেখায় সোনার মঙ্গলসূত্রটি। 
চিন্তিত কৃপাশংকর কুলশ্রেষ্ঠ। তাঁর স্ত্রী মঙ্গলাদেবীও। ১৯৭৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এই কন্যার জন্ম হয়েছে তাঁদের সংসারে। বাকি সন্তানদের থেকে এই কন্যা অনেক ছোট। সবথেকে বড় যে কন্যা সে এই কনিষ্ঠার থেকে ২০ বছরের বড়। বস্তুত চার ভাইবোন আগে থেকেই আছে। কৃপাশংকর ও মঙ্গলাকে ডাক্তারও আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, আর সন্তান প্রয়োজন নেই এবং হবেও না। কিন্তু এই কন্যার জন্ম হল। নাম দেওয়া হয়েছে রীণা। রীণা কুলশ্রেষ্ঠ। 
ঠিক কখন মৃত্যু হওয়ার অভিনয় করে রীণা? সাধারণত যেদিন ঝড়বৃষ্টি হয়, সেদিন যেন বেশি করে। জানালার দিকে তাকায়। হাত দেখায় বৃষ্টির দিকে। তারপর চোখ বুজে সেই মৃত্যুবরণের অভিনয়। এই ঝড়বৃষ্টি, এই  মৃত্যুবরণের অভিনয়, এই পতি নামক শব্দের প্রতি আগ্রহ এই সবকিছু বিচ্ছিন্ন কোনও মনস্তত্ত্ব? নাকি একটি অদৃশ্য সেতু রয়েছে আচরণভঙ্গিগুলির মধ্যে? স্বাভাবিকভাবেই নিজের সন্তান এবং মাত্র দেড় বছরের কন্যার খামখেয়ালি বহিরঙ্গ নিয়ে এতসব ভাববে না কোনও পিতামাতা। পিতামাতাদের অন্তরে বরং শিশুসন্তানদের নানাবিধ পরিণতমনস্ক আচরণ দেখলে চর্চা হয়, কী পাকা হয়েছে! দু’বছর বয়স হল না, অথচ যেন পাকা বুড়ি...ইত্যাদি। 
রেডিওতে একটি গান হচ্ছে। কৃষ্ণভজন। চমকে চমকে উঠছে রীণা। ২ বছর বয়স। কী ব্যাপার? প্রথমে বোঝা যায়নি। বোঝা গেল হঠাৎ সে যখন বলল, শ্যাম...আমার পতি। আমার পতির নাম শ্যাম। এবং কী আশ্চর্য! ২ বছর বয়সে একটি মেয়ে মাকে আরও বলছে, তুমি আর বাবা কেন একসঙ্গে ঘুমাও, আমি জানি! 
চমকে উঠলেন পিতা-মাতা! এ কী? এরকম হয় নাকি? ১৯৭৭ সাল। টেলিকম দপ্তরের কর্মী কৃপাশংকর কুলশ্রেষ্ঠ। তাঁর পোস্টিং লখনউতে। বাড়ি আগ্রায়। আগ্রাতেই পরিবার থাকে। মাঝেমধ্যে তিনি যাতায়াত করেন। কখনও সখনও স্ত্রী ও শিশুকন্যা আসে লখনউ। যে ব্যবস্থা ভারতের ঘরে ঘরেই পরিচিত। কিন্তু বিস্ময়কর হল, ২ বছরের শিশুর মধ্যে নারী পুরুষ তথা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ব্যাখ্যা আসবে কীভাবে? এটা যতটা লজ্জার, ততটা রাগের এবং ঩ঠিক সেরকমই উদ্বেগেরও। এবং ঠিক তখন থেকেই মাকে সেই কন্যা বলে, আমার পতি কোথায়? তাকে খুঁজে দাও! ওর নাম শ্যাম। 
কৃপাশংকর দিশেহারা। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলল, হয়তো অপদেবতার কারণ। পুরোহিতকে বলতে হবে। আবার কেউ কেউ বলল, পাগল নয় তো? ডাক্তার দেখাবে? কিন্তু এরকম অসংলগ্ন কথা বলা কিংবা পরিণতমনস্ক আচরণ করাকে ঠিক কোন অসুস্থতার পর্যায়ে ফেলা হবে? কী বলা হবে ডাক্তারকে? আর আগ্রার মতো শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখানোর কথা মাথাতেই আসবে না। অদৌ এরকম কোনও ডাক্তার আছে কি না সেটাই তো জানা নেই কারও সেই পাড়ায়। তাছাড়া সবথেকে বড় কথা হল, বিষয়টা মোটেই জানাজানি হতে দেওয়া যায় না। একবার এটা প্রকাশ হয়ে গেলে গোটা পরিবারকেই তো সন্দেহের চোখে দেখা হবে। তাহলে কি ছোট মেয়ে উন্মাদ? পরিবারে পাগলের রোগ আছে? এই বছরেই তো বড় মেয়ের বিবাহ। সুতরাং এসব সামাজিক চর্চার কেন্দ্র হয়ে গেলে সেই বিবাহে যে আঁচ পড়বে না, কে বলতে পারে? 
একটি পুতুল আছে। সেই পুতুলকে পায়ে নিয়ে ঘুমায় রীণা। আড়াই বছর বয়সে। মাঝেমধ্যেই পুতুলকে চাদর দিয়ে ঢেকে বলে, আমার ছেলেটার জ্বর এসেছে। আজ ওকে শুধুই দুধ হলদি দেব! আর বার্লি। বার্লি ব্যাপারটা রীণা জানল কীভাবে? বার্লি খাওয়াতে হয় জ্বর হলে এটা তো জানার কথা নয়? ওকে খাওয়ানো হয়নি কখনও। এত বাচ্চা অবস্থায় বার্লি দেওয়া হয়নি। কিন্তু সে জেনে গিয়েছে। 
যে শহরের কাছে যে বিখ্যাত দ্রষ্টব্য অথবা জনপ্রিয় স্থান, সেখানে ছুটির দিনে কিংবা আত্মীয়স্বজন এলে যাওয়াই দস্তুর। আগ্রা শহরের মানুষ তাহলে কোথায় যাবে তাদের আত্মীয় পরিজন এলে? হ্যাঁ। অবশ্যই তাজমহল। একবার। দু’বার। এই আড়াই বছর বয়সে দু’বার তাজমহলে যাওয়া হয়েছে রীণার। মা ও দিদির কোলে চেপে। দুবারই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একবার শরীরে কালো কালো দাগ বেরিয়েছে। অ্যালার্জি? কিন্তু কালো কেন? 
তৃতীয়বার যখন আবার যাওয়ার কথা উঠল, তখন বয়স ৩  বছর। সে তাজমহল কথাটা শুনে কুঁকড়ে গেল। তার যেন ইচ্ছা নেই যাওয়ার। ভয় পাচ্ছে। এত ছোট শিশুর মতামত এবং আচরণের গুরুত্ব কী? অতএব তাকে নিয়ে যাওয়া হল। 
কোল থেকে ছিটকে পড়ে গেল প্রবেশদ্বারের পাশে। পড়ে গিয়েই স্থির। এ আবার কী? শ্বাস পড়ছে? হ্যাঁ পড়ছে! কিন্তু ছটফট করছে সে। আর কান্না। মায়ের কোলে দেওয়া হল। যদি শান্ত হয়। কোনও একদিকে হাত দেখিয়ে কী যেন বলছে। সেদিন রাতে ধুম জ্বর। জ্বরের ঘোরে মাকে রীণা বলল, যেখানে গিয়েছিলাম, সেখানেই সে মারা গিয়েছে। এখানেই তাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে? মানে? চকিতে কৃপাশংকরের মনে এল, তাজমহলের নিকটেই তো একটা শ্মশান আছে। অনেক পুরনো। শোনা যাচ্ছে অনেকদিন ধরেই সেটা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যমুনার তীরে বলে সেখানেই হিন্দু সৎকার সম্পন্ন হয়। সেদিকে হাত দেখিয়ে কী বলছিল রীণা? জ্বালিয়ে দিয়েছিল মানে কি তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল? কৃপাশংকরের মনে প্রথম মেয়ের জন্মান্তর সম্ভবনা প্রবেশ করাল সহকর্মী অতুল বশিষ্ঠ। লখনউতে। গোটা ঘটনা শুনে অতুল বলেছে, ও সমস্ত আগের জন্মের কথা বলছে না তো? এরকম নাকি হয়! কানপুরে আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় এরকম ঘটনা শুনেছিলাম। সেই মেয়েটি বাচ্চা বয়স থেকে এরকম বলত। এমনকী সে রাস্তাও দেখিয়ে দিয়েছিল যে, কোন পথে গেলে তার আগের বাড়ি যাওয়া যায়। সেই রুটে গিয়ে সত্যিই দেখা গিয়েছিল তার বিবরণ সব হুবহু মিলে গিয়েছে। 
চমকে যায় শুনে কৃপাশংকর। কারণ আগ্রায় তার বাড়ির ছাদে উঠলেই মেয়ে রীণা সামনের রাস্তার দিকে হাত দেখায় আর কান্নাকাটি করে। ছাদ থেকে নেমে এলে সেই কান্না আর থাকে না। তাহলে কী..? 
কৃপাশংকরের সংসার আর পরিবারে একটি স্থায়ী অস্বস্তির সৃষ্টি হল। এভাবে আর কতদিন চলবে? সামনেই মেয়ের বিয়ে। তাই আগে বিয়েটা ঠিকভাবে হয়ে যাক। তারপর একটা বিহিত করতে হবে। লখনউতে বড় ডাক্তার আছে। দেখানো দরকার। 
 দিদির বিয়েতে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে রীণাকে। হঠাৎ সে অস্থির হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গেল। কেন? একজনকে দেখে। শ্যামবাবু যাদব। শ্যামবাবু আগ্রায় থাকেন। এই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকদিনের। তিনিও টেলিকম দপ্তরের কর্মী। আগ্রায়। তবে পাশাপাশি আর একটি কাজও করেন। চা পাতার প্যাকেট বিক্রি। অর্থাৎ যাকে বলা হয় সরকারি চাকরির পাশাপাশি একটি অতিরিক্ত আয়ের ব্যবস্থা। ঘটনাচক্রে কৃপাশংকরের বাড়িতেও তিনি দিয়ে থাকেন এই চায়ের প্যাকেট। 
বিবাহ আসরে শ্যামকে দেখে তাড়াতাড়ি রীণা জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে রইল। যেন লজ্জাশীলা বধূ।  শ্যাম খেয়ালই করেনি। অন্যরাও নয়। শুধু মেজদিদি ব্যাপারটা দেখেছে। এবং পরে মাকে বলেছে। মায়ের মনে পড়ে গেল সেই কথাটা। আমার পতির নাম শ্যাম। ওকে খুঁজে এনে দাও। রীণাকে এবার বসিয়ে প্রশ্ন করা হল। মা ও বাবা ছাড়া কেউ নেই। রীণা বলল, তার স্বামীই ওই শ্যাম। হাতে খুব ব্যথা পেয়ে সে মারা গিয়েছে কোনও একসময়। তার আর কিছু মনে নেই। শুধু যেন দেখতে পায় যে, কোথায় তার গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গাটা ওই তাজমহলের কাছে। 
ঘটনা হল, শ্যামবাবু যাদবের সত্যিই আগের পক্ষের এক স্ত্রী ছিল। এবং তার মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসার সময় ভুল ইনজেকশন দিয়ে। নাম ছিল গোম্পতি দেবী। এক ছেলে এবং দুই মেয়ে রেখে গোম্পতি দেবীর মৃত্যু হয়েছিল। গোম্পতি দেবী অনেকটাই সময় থাকতেন আগ্রা থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরের তিলতিলা গ্রামে। সেখানে থাকেন গোম্পতি দেবীর মা ফুলবন্তী। রীণা তার বাবা ও মাকে বারংবার বলেছিল আমাকে বাইরে নিয়ে চল। আমি বলে দিচ্ছি কীভাবে যেতে হবে। ঠিক সেই বিবরণ ধরেই যাওয়া হয়েছিল যে পাড়ায়, সেখানেই শ্যামবাবুর বাড়ি। ততদিনে শ্যামবাবুও জানে যে তাকে এই শিশু মনে করে পূর্বজন্মের স্বামী। এরকম হয় নাকি? গোম্পতি দেবী মারা যাওয়ার বেশ কয়েকবছর পর শ্যাম আবার বিয়ে করে। ঊর্মিলাকে। গোটা ঘটনায় সবথেকে বেশি অস্বস্তি ঊর্মিলার। এসব কী হচ্ছে! অস্বস্তির কারণ হল, ধীরে ধীরে শ্যাম তাকে বলেছে যে, মেয়েটি নাকি এমন অনেক কথাই বলছে, যা সত্যি। অর্থাৎ একটি সোনার মঙ্গলসূত্র। সেটা কিনে দিয়েছিল শ্যাম। সেটার কথা বলেছে তাকে। মিলেও গিয়েছে। এই বাড়িতে নেই সেই মঙ্গলসূত্র আর অন্য গয়না। সেটা এ বাড়ি এসে বলে গিয়েছে রীণা। কোথায় আছে? তিলতিলা গ্রামে। বিস্মিত হয়ে শ্যাম স্ত্রীকে বলেছে, তুমি তো জানোই যে, সত্যিই তার সব গয়না মায়ের কাছে রাখা। তুমিই সেই গয়না পরতে চাওনি। আমিও চাই না। কিন্তু সেটা এই শিশু কীভাবে জানবে? ওর বাবা মাও জানে না। ওদের সঙ্গে আমার তো এত কিছু ঘনিষ্ঠতা নয়! এসব কী হচ্ছে!
শ্যামবাবু কৃপাশংকরকে বললেন, স্যর, আমার মনে হয় এসব থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়ার একটা উপায় আছে। আমি আর আপনাদের বাড়িতে কোনওদিন যাব না। আপনারাও আসবেন না। আমরা যেন সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। এটা আপনারাও পালন করবেন। আমার যাতায়াত এভাবেই চলতে থাকলে, এই প্রবণতাও বাড়তে থাকবে। এই সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হল, তখন রীণার বয়স ৮ বছর। 
ঠিক ১০ বছর বয়সে রীণা যখন লখনউতে স্কুলে পড়ছে তখন থেকেই সে আর ১০ বছরের কিশোরী অথবা বালিকা নয়। তার আচার আচরণ মনোভাব কথা বলার ধরন এবং সাংসারিক ব্যবহার সবই যেন বড়সড় কোনও যুবতী। মনে রাখতে হবে যে পূর্বজন্মের কথা সে বলছে, সেই পূর্বজন্মের গোম্পতির যখন মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর। অতএব ঠিক ওই ৩০ বছর বয়সেই যেন আটকে গিয়েছে। 
একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে সে বলল, শ্যামবাবু খুব কষ্টে আছে। তার দাদা মারা গিয়েছে। 
মঙ্গলা এবং কৃপাশংকর এবার আরও বিস্মিত। কারণ এতদিন ছিল শ্যামবাবু আমার স্বামী। তিলতিলা গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়ি। এমনকী শ্যামের প্রতিবেশী কৈলাস কুমারীও রীণাকে দেখে এবং আচার আচরণ কথা শুনে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, দেখেশুনে কিন্তু মনে হচ্ছে সেই গোম্পতিই ফিরেছে। সেসব তাও একটা কিছু অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। কিন্তু এবার তো সরাসরি যে অনেক দূরের ঘটনা দেখতে পাওয়ার দাবি। তাও আবার দিব্যচক্ষে। 
লখনউ অফিস থেকে আগ্রার অফিসে ফোন করে শ্যামকে চেয়ে নিয়ে কৃপাশংকর সেকথা বলায়, শ্যাম বিস্মিত। সে বলল, স্যর, কালই দাদার মৃত্যুর খবর এসেছে! 
ঠিক এখান থেকে প্রশ্ন উঠছে, এতক্ষণ না হয় বোঝা যাচ্ছিল যে, হতে পারে জাতিস্মর রীণা। কিন্তু হঠাৎ সে এই জন্মে সর্বজ্ঞ হয়ে উঠল কেন? তার বিশেষ শক্তি কোথা থেকে এল? এসব তো তান্ত্রিক কিংবা সাধু সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে শোনা যায়। এখানে সেই প্রশ্ন আসছে কোথায়? 
সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ এবং চমকপ্রদ ঘটনা হল, ১৯৮৮ সালের আগস্টে ১২ বছরের রীণা স্কুল থেকে ফিরে এসে বলল, শ্যামের বড়সড় অপারেশন হয়েছে। বাঁচবে তো! কান্নাকাটি করছে সে। আর বারংবার বলছে আমাকে নিয়ে চল তার কাছে।
সেটা কীভাবে হয়? কৃপাশংকর শ্যামকে কথা দিয়েছে যে ভিতরে ভিতরে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখলেও প্রকাশ্যে পারিবারিক সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু উপায় নেই। ছটফট করছে। কাঁদছে। অসুস্থ হওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু আগে তো জানতে হবে সত্যিই কী ঘটেছে! অতএব কৃপাশংকর ফোন করলেন। টেলিকম অফিস আগ্রা জানাচ্ছে, একমাস ধরে  ছুটিতে আছে শ্যাম। কারণ তার গুরুতর অসুখ। কী হয়েছে? ক্ষুদ্রান্ত্রের কিছু সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয় হাসপাতালে। এমনকী অপারেশন করতে হয়েছে। আর সাতদিন ধরে অচেতন ছিল। কোথায় এখন? এটাওয়া হাসপাতালে। বাধ্য হয়ে সেখানেই গেল রীণা। দেখতে পেল শ্যামবাবুর মাথার কাছে বসে আছে ঊর্মিলা। সে মাথায় হাত বোলাচ্ছে। চোখ বন্ধ শ্যামবাবুর। 
রীণা এল হাসপাতালের বেডের কাছে। স্পর্শ করল না। সে একটা ওড়না নিয়ে এসেছে। গোটা মুখ ওড়নায় ঢাকা। হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, এই শেষ। আমি বলে যাচ্ছি, আর কোনওদিন কোনও অসুখ করবে না তোমার। আর আমি তোমার কাছে আসব না। এভাবে হঠাৎ নিজেকে প্রত্যাহার করে নিল কেন রীণা! কৃপাশংকর এবং মঙ্গলাদেবী, শ্যামবাবু যাদব, ঊর্মিলা সকলের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলেছে সমাজতাত্ত্বিক এবং মনস্তত্ত্ববিদদের টিম। জার্নাল অব সায়েন্টিফিক এক্সপ্লোরেশনের ১৯৮৯ সালের ভলিউমে এই ঘটনার বিস্তারিত কেস স্টাডি লেখা হয়েছিল। 
সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল, সেখানে কোনও নিশ্চিত উপসংহারে আসা হয়নি যে, রীণা মিথ্যা বলছে। অথবা সে জাতিস্মর হতেই পারে না। সে ওই গবেষকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়নি অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু তার বাবা, মা, শ্যাম, ফুলবন্তী, ঊর্মিলার সঙ্গে কথা বলে গবেষকরা উপলব্ধি করেছেন যে, বহু তথ্যই বিস্ময়করভাবে রীণা মিলিয়ে দিয়েছে। আবার বেশ কিছু দাবি মেলেনি। অন্যতম রহস্য হল, রীণা দাবি করেছে যে, তার পূর্বজন্ম ছিল গোম্পতি দেবী। শ্যামবাবুর স্ত্রী। কিন্তু সেই গোম্পতি দেবীর পুত্রকে শ্যামবাবুর বাড়িতে গিয়ে সে চিনতে পারেনি। আবার এই রীণাই শ্যামের গ্রামের বাড়ি সেই তিলতিলার কোন ঘরে কী কী আছে, কোন গয়না কেমন দেখতে সেসব হুবহু বলে দিয়েছিল! তবে যে রহস্য এসবের থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ সেটি হল, এই নবজন্মে তথা নতুন জীবনে সে আগে থেকেই কী ঘটবে অথবা অনেক দূরে কী ঘটেছে, এসব জানল কীভাবে? ১৯৭৯ সালে সে কীভাবে বলেছিল, বাবা অফিস থেকে প্রাইজ পাবে। কৃপাশংকর একটি প্রমোশন এবং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। আবার শ্যামের বড়দাদার মৃত্যু কিংবা শ্যামের অসুস্থতা এসবই বা কীভাবে জানা সম্ভব? জাতিস্মর হওয়ার দাবি করা একরকম। আবার তার সঙ্গে ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও এরকম নজির খুব বেশি পাওয়া যায়নি। 
রীণা কুলশ্রেষ্ঠ উত্তরপ্রদেশ থেকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের একটি রহস্যময় কেস স্টাডি হয়ে রয়ে গিয়েছে আজও! সত্যিই কি সে জাতিস্মর ছিল? 
দুই
শান্তিকে সম্মোহিত করা হচ্ছে। তার চোখ তন্দ্রার মতো। কিন্তু চোখ যে সম্পূর্ণ বুজে রয়েছে, এমন নয়। হিপনোটিজম করছেন প্যারাসাইকোলজিস্ট জগদীশ মিত্র। স্থান দিল্লি। ১৯৩৬ সালের ১৩ এপ্রিল। সঙ্গে রয়েছেন ডক্টর ইন্দ্র সেন। 
 প্রশ্ন: কী দেখছ তুমি? কী দেখছ? এখন লুগড়ি কী করছে? 
শান্তি: এখন...এখন...এখন লুগড়ি এইমাত্র বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
প্রশ্ন: তারপর...তুমি কি ঠিক দেখতে পাচ্ছ? লুগড়ি উঠে দাঁড়াচ্ছে? লুগড়ি নি঩জেই? নাকি অস্পষ্ট অন্য কিছু? ছায়া ছায়া? নাকি স্পষ্ট? লুগড়ির আত্মা নয় তো? নাকি গোটা শরীর? ভালো করে দেখে বলো...
শান্তি: হ্যাঁ..হ্যাঁ..লুগড়ি বিছানায় শুয়ে। অন্য কেউ...তার আত্মা...ছায়া উঠে দাঁড়াচ্ছে। চারজন হলুদ প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে। তাদের মাথায় মুকুট। নীল..কালো আর সাদা কাপড় পরে তিনজন...তিনজন...না না চারজন সাধু। তারা পিছনে দাঁড়িয়ে। 
প্রশ্ন: এখন? এখন কী করছে?
শান্তি: এখন লুগড়ি ভগবানের কাছে গেল। হাতে একটা কাগজ। 
প্রশ্ন: কাগজ?
শান্তি: হ্যাঁ কাগজ। কাগজ সে দিল ভগবানকে। খারাপ খারাপ লোক কাঁদছে। 
প্রশ্ন: কোথায়? 
শান্তি: ভগবানের কাছে।
প্রশ্ন: এখন? এখন লুগড়ি কী করছে?
শান্তি: সোনা আর রুপোর সিঁড়ি দিয়েছে লুগড়ি নেমে আসছে। 
প্রশ্ন: তারপর?
শান্তি: তারপর অন্ধকার ..অন্ধকার...অন্ধকার...। 
কে এই শান্তি? 
১৯০২ সালের ১৮ জানুয়ারি মথুরায় জন্ম হয়েছিল লুগড়ি চৌবের। বাবা চতুর্ভূজ চৌবে এবং মা জাগতি দেবীর প্রিয় সন্তান লুগড়িকে ১০ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়া হল। পাত্রের নাম কেদারনাথ চৌবে। বিবাহের পর একাধিক সন্তানের পর আবার পুত্র সন্তানের জন্ম হল ১৯২৫ সালে। সেই যুগে আগ্রার হাসপাতালে শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে হয়েছিল প্রসব। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। সন্তান বেঁচে গেল। মায়ের ধরা পড়ল মারাত্মক রক্তশূন্যতা। সঙ্গে হয়তো আরও কিছু অসুস্থতা। ঠিক ৯ দিনের মধ্যে মায়ের মৃত্যু হল। 
১৯২৬ সালের ১১ ডিসেম্বর মথুরা থেকে অনেক দূরে দিল্লি শহরে জন্ম হওয়া এক কন্যার নাম শান্তি। জন্ম হওয়ার পর থেকে বয়স বাড়লেও বেশি কথা বলছে না। তার মানে রীণা কুলশ্রেষ্ঠর ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। রীণা ১০ মাস থেকে কথা স্পষ্ট ভাবে কথা বলেছে সেটা আমরা দেখেছি। আর বহু বছর আগে উত্তর ভারতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য জাতিস্মর কাহিনির প্রধান চরিত্র শান্তি কোনও কথাই বলেনি প্রথম মাসগুলিতে। ৪ বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই আচমকা বদলে গেল সব। শান্তি বলতে শুরু করল, এখানে কেন? আমার বাড়ি তো এরকম নয়। আমার বাড়ির চারপাশে যে গাছ ছিল সেসব কোথায়? কোথায় গেল নদী? খেলার মাঠ আর মন্দির ছিল বাড়ির সামনেই। সারাদিন তো মন্দিরেই থাকি। কোথায় গেল সেই মন্দির। আমার স্বামীকে দেখছি না তো? ছেলেটাই বা কোথায় গেল?
হঠাৎ যে মেয়ে প্রায় কথাই বলে না, সে যত বড় হচ্ছে ততই এরকম একঝাঁক বিস্ময়কর এবং চমকপ্রদ সব কথা বলায় বাবু রংবাহাদুর মাথুরের দিশাহারা দশা। কী করা উচিত? 
দিন মাস বছর যায়। শান্তির স্মৃতি আর বিবরণ আরও স্পষ্ট হচ্ছে। পরনের কাপড় নিয়ে সে বিরক্ত। তার কথায়, এটা কেমন জামাকাপড়? এত খারাপভাবে কেউ জামাকাপড় সেলাই করে? আমার মতো কেউ পারবে না। আমার স্বামীর মতো কেউ পারে না এখানে সেলাই করতে। কে তোর স্বামী? জানতে চান মা। জানতে চান বাবা। 
শান্তি জানায়, আমি মথুরার চৌবান। 
—চৌবান? তার মানে চৌবে পরিবারের? 
শান্তি বলে, হ্যাঁ। 
মাথুর ঠিক বুঝতে পারছেন না, কী করা উচিত। একমাত্র পরামর্শ দেওয়ার মতো মানুষ মাস্টারসাব। শান্তির স্কুলের প্রধান শিক্ষক লালা কিষাণ চাঁদ। প্রধান শিক্ষক বললেন, আচ্ছা আমি একবার কথা বলে দেখছি। 
লালা কিষাণ চাঁদ শান্তির সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলেন যে, শান্তির কথায় তার স্বামীর নাম কেদারনাথ চৌবে। মথুরায় থাকে। মথুরায় কোথায়? এভাবে খুঁজে পাওয়া তো সম্ভব নয়। 
শান্তি ধীরে ধীরে কয়েকটি মন্দিরের নাম বলল। আর বলল, বটগাছ, নদী আর বড় একটা বাগানের কথা। 
না, এভাবেও সম্ভব নয়। তবু নিজের এক পরিচিত মানুষকে মথুরায় পাঠালেন তিনি। সঙ্গে দিলেন চিঠি। সেই চিঠি নিয়ে মথুরায় নদীর কাছে কোন কোন মন্দির আছে এবং কোথায় ওরকম বটগাছ আর বাগান রয়েছে, সেটা খুঁজবে সেই দূত। খুঁজল। তবে পেল না। তবে সে বুদ্ধি করে মথুরার গোকুল মন্দিরের নিকটবর্তী পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। তারপর জানাল এবার আপনার দায়িত্ব এই চিঠিটা ওই কেদারনাথ চৌবে নামে কোনও ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়া। যার বউয়ের নাম ছিল লুগড়ি চৌবে। এরকমই বলছে শান্তি। তার দাবি সে পূর্বজন্মে ছিল লুগড়ি। 
এভাবে তো সন্ধান পাওয়ার আশা কম। অথচ একমাসের মধ্যে কাজ হল। কেদারনাথ চৌবের কাছে চিঠি পৌঁছেছে। আর সেই চিঠি পেয়ে পাল্টা সে চিঠি লিখে বলেছে যে, আমি আসছি। 
দিনক্ষণ স্থির। আসছে কেদারনাথ। ৮ বছরের শান্তিকে বলা হয়েছে, আসছে তোর স্বামী। 
এলেন তিনি। কিন্তু এ কে? শান্তি পিছিয়ে এল? এক পূর্ণ যুবককে দেখে বলল, তুমি এখানে? উনি কোথায়?
তড়িঘড়ি সেই যুবক কিছুটা ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে বলল, উনি আসছেন...আসবেন। আমাকে আগে পাঠালেন। 
কে এই যুবক? 
জানা গেল কেদারনাথ নিজে না এসে ভাইপো কাঞ্জিলাল চৌবেকে পাঠিয়েছেন। পরীক্ষার জন্য। কারণ আদৌ যদি এই মেয়ে তাঁর পূর্বপত্নী হয়, তাহলে এই ভাইপোকেও চেনার কথা। 
আশ্চর্য বিষয় হল, শান্তি এক লহমায় চিনে ফেলেছে। আর তার সঙ্গে কথা বলে চরম বিস্মিত খোদ সেই কাঞ্জিলাল চৌবে। কারণ, সত্যিই এই বালিকা যা বলছে, সেটা থেকে স্পষ্ট যে এই তার চাচি ছিল! যে চাচির সন্তান হওয়ার পরই মৃত্যু হয়েছে। 
১৯৩৫ সালের ১৩ নভেম্বর স্বয়ং কেদারনাথ চৌবে এলেন দিল্লি। সঙ্গে তৃতীয় স্ত্রী ও সন্তান। লুগড়িকে বিবাহ করার আগে তাঁর একটি বিবাহ ছিল। সেই পত্নী মৃত। তারপর বিবাহের পর লুগড়িও মৃতা। আর এই বালিকা এবার দাবি করছে সেই নাকি ছিল সেই লুগড়ি চৌবে। 
কেদারনাথ বাইরের ঘরে এলেন। একটু পর শান্তি প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর সে ধীরে ধীরে বসে পড়ল মেঝেতে। জল ঝরছে অবিরত চোখ থেকে। কিন্তু সেই নীরব কান্না প্রবল লাভা উদ্গীরণের মতো যেন বেরিয়ে এল যখন চোখ পড়ল একটি কিশোরের দিকে। যে কিশোর প্রায় তার বয়সি। অথবা হয়তো সামান্য বড়। তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আর উচ্চস্বরে কেঁদে বলল, আমার ছেলে...আমার ছেলে...আমার ছেলে...। 
কেদারনাথ বললেন, আমি ওর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলব। অন্য কোনও ঘরে। 
সকলেই রাজি হল। কারণ এই এখন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ই প্রমাণ হয়ে যাবে শান্তি যা বলছে সেটা কি সত্যি? নাকি সবটাই তার মনের ভ্রান্তি? 
কেদারনাথ একঘণ্টা কথা বললেন বন্ধ ঘরে। দু’জনে বেরিয়ে আসার পর মাথা নামিয়ে শুধু বললেন, মেয়েটি সব সত্যি বলছে। আমাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যা যা কথা হয়েছিল, যা যা ঘটনা ঘটেছিল বিয়ের আগে ও পরে সব বলে দিয়েছে। আমার তাই সন্দেহ নেই যে, আমার আগের পক্ষের মৃতা স্ত্রী এই মেয়েটিই ছিল! 
গোটা ঘরে তখন স্তব্ধতা। এরকম কোনও ঘটনা কেউ জীবনে শোনেনি। এমনকী এরকম হলে কী করতে হয়? তাও কেউ জানে না। শুধু লালা কিষাণ চাঁদ বললেন, মহাত্মাজির কাছে গেলে হয় না? 
তিনি কংগ্রেস করতেন। মহাত্মাজি বিড়লা হাউসে রয়েছেন। কিষাণ চাঁদ নিজেই গেলেন। বললেন সব ঘটনা। মহাত্মা গান্ধী উৎসূক এবং বিস্মিত। তিনি দেখতে চা‌ই঩লেন বালিকাকে। আনা হল। কথাও বললেন। তবে বিশেষ যে জেরা অথবা জিজ্ঞাসাবাদ করলেন এমন নয়। সামান্য কিছু কথা। আর যে কোনও বালিকার সঙ্গে যেভাবে এক গুরুজন কথা বলে, সেই স্বরেই স্নেহমিশ্রিত কথা বললেন বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
তবে ওইটুকুতেই মহাত্মা গান্ধীর নজর এড়ায়নি। সেটা হল, এই অল্প বয়সেই মেয়েটি মোটেই আট-নয় বছর বয়সের মতো ব্যবহার করছে না। তার কথাবার্তার ধরণ খুব অন্যরকম। স্পষ্ট। দৃপ্ত। এবং দিল্লির মেয়ে হয়েও সত্যিই মেয়েটির উচ্চারণ কেমন যেন মথুরা বৃন্দাবন ঘেঁষা। তিনি নিজে যেহেতু মথুরা বৃন্দাবন বহুবার যাতায়াত করেন, তিনি জানেন ওই বিশেষ ভাষার টান। 
গান্ধীজির সিদ্ধান্ত হল, এটা বেশ অদ্ভূত ব্যাপার। তবে বিহিত হওয়া দরকার বিজ্ঞানসম্মতভাবে। কোনও কুসংস্কার  যেন না ছড়ায়। মেয়েটিকে নিয়ে কোনও প্রচার যেন তার ক্ষতি না করে। আর সর্বোপরি ব্যবসা শুরু হয়ে না যায়। 
বেনজির ঘটনা! দিল্লির এক বালিকা আদৌ কি জাতিস্মর? সেটা জানতে শেষ পর্যন্ত একটি ১৫ জনের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি হবে। কী করবে এই কমিটি? তারা মনস্তত্ত্বগতভাবে, চিকিৎসকের চোখে এবং তদন্তমূলকভাবে মেয়েটিকে পরীক্ষা করবে। তার গতিবিধি লক্ষ্য রাখবে। আর গোটা ব্যাপার নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেবে। 
বহুদিন ধরেই শান্তির মনোবাসনা যে তাকে মথুরায় নিয়ে যাওয়া হোক। সেখানে সে নিজের বাড়িতে যাবে। ওহো! যেটা বলা হয়নি। এই কাহিনির মধ্যে একটি ঘটনা অনুল্লেখ্য থেকে গিয়েছে। দু’বছর আগে অর্থাৎ ৬ বছর বয়সে নাকি শান্তি একা একাই মথুরায় চলে যায়। আবার ফিরেও আসে। যদিও সেই ঘটনার বিবরণের সত্যতা সব রিপোর্ট স্বীকার করেনি। অসমর্থিত সূত্রের বক্তব্য হল, হ্যাঁ, সে গিয়েছিল। এমনকী খুঁজে খুঁজে নিজের সেই পূর্বজন্মের পাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু ওরকম বালিকাকে একা একা ঘুরতে দেখে তাকে নাকি আবার দিল্লিতে ফিরিয়ে আনে কয়েকজন। আর বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়ে একসময় পৌঁছেও দেয়। 
এবার মথুরায় তাকে নিয়ে যাবে ওই কমিটি। যাওয়া হল। শান্তি যেখানে যাচ্ছে, তার আচার আচরণ লক্ষ করা হচ্ছে। কেদারনাথ চৌবের বাড়ি সে নিজে সত্যিই চিনিয়ে নিয়ে গেল। নিজের পূর্বজন্মের ফেলে যাওয়া সংসারে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। একটি নীল বাক্স ধরে টানাটানি করল। সেই ব্যাগ সত্যিই ছিল লুগড়ির। 
এতকিছুর পর কিন্তু বালাচাঁদ নাহাতা এক নাস্তিক এবং কুপ্রথা বিরোধী সমাজ সংস্কারক, শান্তির সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার এবং কমিটির রিপোর্ট পড়ে, একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলেন। বইয়ের নাম ‘পুনর্জনম কা পর্যালোচনা’। সেই পুস্তিকায় তিনি কিন্তু স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, জাতিস্মর নামক সন্দেহটি অমূলক। আমি শান্তির সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক প্রশ্ন করেছি। কিছু কিছু সন্তোষজনক উত্তর পেয়েছি। কিন্তু এমন কিছু মনে হয়নি নিশ্চিতভাবে যে, সত্যিই লুগড়ি চৌবেই পরবর্তী জন্মে ফিরে এসেছে শান্তি মাথুর হয়ে। কিংবা শান্তি মাথুরই ছিল পূর্বজন্মে লুগড়ি চৌবে। 
চাঁদ নাহাতার এই তত্ত্ব কিন্তু নস্যাৎ করলেন ডক্টর ইন্দ্র সেন। তিনি বেশ ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়েই ১৯৩৯ সালে লিখলেন বিস্তারিত রিপোর্ট। বললেন, আমি নিজেই শান্তিকে সম্মোহনের মাধ্যমে অনেক প্রশ্ন করেছি। স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে নিয়ে গিয়েছিল মথুরায়। তার সঙ্গে থেকেছি তার বর্ণিত বিভিন্ন স্থানে। সম্মোহন চলাকালীন সে এমন কিছু উত্তর দিয়েছে, যেগুলি যথেষ্ট বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ। অথচ চাঁদ নাহাতা সামান্য কিছু উদাহরণ এবং কয়েকদিনের কথার ভিত্তিতে একটি আস্ত গ্রন্থ লিখে ফেলে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন যে শান্তির মধ্যে কোনওরকম অস্বাভাবিকত্ব নেই? আমার নিজের তো মনে হয়েছে, শান্তি এমন বহু তথ্য দিয়েছে, স্মৃতি থেকে অনেক বিবরণী দিয়েছে, যেগুলি এই জীবনে সে সংগ্রহ করেনি। কারণ তার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে আমরা দেখেছি যে, ওইসব তথ্য তার জানার কথাই নয়। 
১৯৩৯ সালে সুশীল বোস শান্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন শান্তির বয়স ১৩। 
প্রশ্ন: তোমার মনে আছে, মৃত্যুর সময় তোমার কীরকম মনে হচ্ছিল?
শান্তি: হ্যাঁ। মনে আছে। মৃত্যুর ঠিক আগে (তখনও জানি না যে আমি মরে যাচ্ছি, পরে বুঝেছি) হঠাৎ একটা অন্ধকার চলে এল চোখের সামনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র আলো। কতক্ষণ পরে, সেটা জানি না। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার কোনও শরীর নেই। শরীর ছেড়ে যেন আমি হালকা একটা বাতাসের মতো কোথাও একটা উড়ে যাচ্ছি। গেরুয়া কাপড় পরা চারজন সাধু আমাকে হঠাৎ ধরে ফেলল। তারপর একটা কাপের মতো দেখতে কিছুর ম঩ধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিল। তারপর আমাকে নিয়ে চলল কোথায় যেন! 
প্রশ্ন: তোমাকে নদীর কথা কিছু বলেনি তারা? 
শান্তি: তারা বলছিল, যারা জীবনে কিছু ভুল করেছে, তাদের নদীতে ডুব দিতে হয়। 
প্রশ্ন: তোমাকে কোথায় নিয়ে গেল? সেখানে কী আছে?
শান্তি: সেখানে শুধুই অনেক আলো। আর কিছু নেই। চারদিক ফাঁকা। চতুর্দিক শূন্য আর চারদিকেই আলোয় আলো। অনেকক্ষণ পর একটা জায়গায় দেখলাম যেন কিষাণজি বসে আছে। তারপর আবার আলো।
প্রশ্ন: সেখানে তুমি কতক্ষণ ছিলে? কিছু বুঝতে পারছিলে?
শান্তি: না। আমি জানি না। কতক্ষণ? একটা সিঁড়ির মতো জায়গায় বসিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেই সিঁড়ির মতো দেখতে জায়গাটাও কেমন যেন শূন্য। মনে হচ্ছে সিঁড়ি। আসলে সিঁড়ি না। 
প্রশ্ন: তারপর? 
শান্তি: আর কিছু মনে নেই।
প্রশ্ন: তুমি যখন মরে যাচ্ছো বলে ভাবছ, সেই সময় তোমার কোনও যন্ত্রণা, ব্যথা হয়েছে? 
শান্তি: না। কোনও যন্ত্রণা হয়নি। আমি আস্তে আস্তে চেতনাহীন হয়ে গেলাম। যখন যাচ্ছিলাম তখন যেন মনে হচ্ছিল একদিকে যেমন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই আলো ঢুকছে। আমি অন্ধকারে ঢুকে আবার আলোয় প্রবেশ করছিলাম। তারপর... তারপর... কেউ যেন আমাকে সেই সিঁড়ি থেকে নামিয়ে আনছিল... আর একটা নদী... নদীতে নৌকা। নৌকায় তোলা হল। শান্তি সম্পর্কে কৌতূহল শেষ হয়নি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। ১৯৮৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। বিবাহ করেনি। সারাজীবন অসংখ্যবার শুধু সাক্ষাৎকার আর পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রহস্যভেদ হয়নি। কারণ নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারেনি যে, তিনি জাতিস্মর নয়। তবে তাঁকে নিয়ে দু’রকম পরীক্ষা হয়েছিল। প্রথমত তিনি জাতিস্মর কি না। আর দ্বিতীয়ত বারংবার তাঁকে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল যে, মৃত্যুর মুহূর্তটি কেমন ছিল? 
খুব স্বাভাবিকভাবেই যে জাতিস্মর হবে, তার যেমন পূর্বজন্মের কথাও মনে পড়ে, তেমনই আবার সচরাচর দেশে ও বিদেশে দেখা গিয়েছে তাদের কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল সেই বিবরণও তারা দিয়েছে। ঠিক এই কারণেই একমাত্র তারাই সবথেকে বড় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তথা স্মৃতির প্রত্যক্ষ এক বিবরণ দেওয়ার অধিকারী। সেই কারণে বারংবার দেখা গিয়েছে এই জাতিস্মরদের নিয়ে যখনই দেশি ও বিদেশি গবেষকরা রিসার্চ করেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তখনই প্রশ্ন করা হয়েছে মৃত্যু কীভাবে হল? কারণ  এ এক সবথেকে অচেনা মুহূর্ত। মানুষ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জানতে পারে না যে, ঠিক মৃত্যুর মুহূর্তটি কেমন হবে! কীভাবে পলকের মধ্যে মৃত্যু এসে জীবনকে স্তব্ধ করে দিল। সেই সময়টি কেমন বোধ হয়? কোনও বিশেষ চেতনা, অনুভব অথবা বোধ কি ঘিরে ধরে চৈতন্যকে? সোজা কথায় মৃত্যুকে কেমন দেখতে? এটাই যুগ যুগ ধরে জানতে চায় নশ্বর মানুষ! আর তাই এই প্রশ্নের উত্তর সবথেকে বেশি পাওয়ার কথা জাতিস্মরের কাছেই! কিন্তু পাওয়া কি যায়? রহস্য আজও! 
তিন
এক বছর আগে সাংবাদিকতার চাকরি পেয়েছি। ১৯৯৩ সালে। বর্তমান সংবাদপত্রে। কিছু মাস কলকাতায় কাজ করার পর চাকরির অন্যতম শর্ত অনুযায়ী পোস্টিং হয়েছে নদীয়ায়। নিয়ম হল, জেলার সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতে হলে স
5d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

গৃহসুখ বৃদ্ধি ও সপরিবারে আনন্দ উপভোগ। অন্যের দোষের দায়বহন করতে হতে পারে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.০৭ টাকা৮৪.৮১ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৫ টাকা১১২.২০ টাকা
ইউরো৯১.৫৭ টাকা৯৪.৭৬ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
17th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা