নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: বারোয়ারি পুজোর চাকচিক্য হয়তো নেই। কিন্তু সাবেকিয়ানা আর বাঙালিয়ানার মিশেলে শহরের বনেদি বাড়িগুলিতে শারদোৎসবের আমেজই আলাদা। এবারও কলকাতার প্রাচীন পরিবারগুলিতে পুজোকে ঘিরে জৌলুসের পরম্পরা অটুট।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে জায়গীর পাওয়ার পর লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ১৬১০ সালে দুর্গাপুজো শুরু করেন বড়িশা গ্রামে। সেই শুরু সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের পুজো। এখন মোট আট জায়গায় এই পরিবার শারদোৎসব পালন করে। বড়িশায় আটচালা বাড়ি, বড়বাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকী বাড়ি ও কালীকিঙ্কর ভবনের পাশাপাশি বিরাটি বাড়ি ও নিমতা পাঠানপুর বাড়িতে বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী তন্ত্রমতে পুজোপাঠ হয়। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পরিষদের সম্পাদক দেবর্ষি রায় চৌধুরীর কথায়, আমাদের পরিবারের পুজোগুলিতে শাক্ত, শৈব্য ও বৈষ্ণব মতে মিলেমিশে ত্রিধারা সঙ্গম পুজো হয়। ১৬৬০ সালে বিদ্যাধর রায় চৌধুরী একটি কষ্টিপাথর থেকে শ্যামরাই, বুড়ো শিব এবং সিদ্ধেশ্বরী কালী গড়েছিলেন। এরপর শুরু হয় ত্রিধারা সঙ্গম পুজো। যেমন বড়বাড়ি, মেজবাড়ি ও নিমতায় ঘোড়ামুখো সিংহ থাকে। সব ক্ষেত্রেই শিব ও রামের পুজো হয়। আবার নিমতায় শুধু নিরামিষ ভোগ হয়। বাকি সব বাড়িতে আমিষ ভোগ। তিন চালার প্রতিমার চালচিত্রে দশমহাবিদ্যা ও রাধা কৃষ্ণ থাকে। অষ্টমী ও নবমীতে উপদেবতা ও অপদেবতাদের জন্য মাসকলাই, ঘি আর দই দিয়ে বিশেষ ‘মাসভক্তবলি’ ভোগ দেওয়া হয়। এই সব অর্চনার পাশাপাশি আমরা প্রতি বছর পরিবারের নিজস্ব শারদ সংখ্যা প্রকাশ করি, যার নাম ‘সাবর্ণবার্তা’। এই রীতি কিন্তু অন্য কোথাও নেই।
রাজা নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজার রাজবাড়িতে যে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন, এবছর তার ২৬৭তম বর্ষ। এই বাড়িতে এসেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেনের মতো ব্যক্তিত্বরা। এসেছেন ওয়ারেন হেস্টিংস, লর্ড ক্লাইভও। পরিবারের সদস্য তাপস বসুর কথায়, আমাদের কাঠামো পুজো হয় রথযাত্রার দিন। এতবছরেও একচালার প্রতিমার উচ্চতায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। মা দুর্গা, সরস্বতী এবং লক্ষ্মীর মুখের ছাঁচ রয়েছে রাজবাড়ির অন্দরে। এখানে বোধন শুরু হয় পুজোর ১৪ দিন আগে। এই ক’দিন ঠাকুরদালানে বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হয়। এখানে মা দুর্গাকে ব্রাহ্মণী রূপে পুজো করা হয়। ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় আতপ চাল, কাঁচা দুধ এবং ফলমূল। রাতে হয় সাত-আট রকমের মিঠাই ভোগ। থাকে নিমকি, গজা সহ একাধিক শুকনো মিষ্টি। ঘট নাড়িয়ে দেওয়ার আগে বাড়ির কেউই প্রতিমা ছুঁতে পারেন না। পুজো চলাকালীন চারদিনই নিরামিষ খাবার খান বাড়ির সকলে। নবমীতে ছাঁচি কুমড়ো, আখ এবং দুটো মাগুর মাছ বলি হয়। শোভাবাজার রাজবাড়িতে করোনার সময় থেকে দর্শনার্থীরা দালানে প্রতিমার কাছাকাছি আসতে পারতেন না। সেই নিয়ম চালু থাকছে এবারও। তাঁদের পুজো দেখতে হবে দালানের নীচ থেকেই।
জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়িতে গোকুলচন্দ্র দাঁ দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। এবারও এখানে মাকে সকলের হয়ে প্রতিমাকে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করবেন শুধুমাত্র পূজারি। ভোগে অন্যান্য বারের মতোই লুচি, ক্ষীর, দই, মিষ্টি, নিমকি থাকবে। সব সামগ্রী তৈরি হবে বাড়িতেই। নৈবেদ্যে দেওয়া হবে গোটা ফল।
বাগবাজার হালদার বাড়ির পুজোর বিষয়ে কথিত আছে, ১৫৬০ সালে তৎকালীন চন্দননগর নিবাসী জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ হালদার এক স্বপ্নাদেশ পান, ওড়িশার সাহেবপুরে প্রায় ১৪ ফুট মাটির নীচে অধিষ্ঠান করছেন মহিষমর্দিনী দুর্গা। সঠিক স্থানে মাটি খুঁড়ে কষ্টি পাথরের মূর্তির সন্ধান মেলে। পাথরের এই মূর্তিটির উচ্চতা ২ ফুট। ওজন ২৫ কিলো। পরে ব্যবসায়িক কারণে চন্দননগর ছেড়ে বাগবাজারে চলে আসেন হালদাররা। পুজো শুরু হয় এখানে। পরিবারের কর্তা দেবাশিস হালদারের কথায়, সম্ভবত মূর্তিটি হাজার বছর আগে পাল যুগে নির্মিত। লন্ডন, কলকাতা এবং চন্দননগর মিউজিয়ামেও এই ধরণের দেবী মূর্তি রয়েছে। কিন্তু সেগুলি নিখুঁত নয়। মিথ আছে, মা দুর্গা যেমন কোনও বাড়িতে গয়না পরেন, কোথাও আবার গান শোনেন, আমাদের বাড়িতে তিনি আসেন পুজো নিতে ও আশীর্বাদ দিতে। পুজোর ষষ্ঠী এবং দশমী এই বাড়ির সকলে আমিষ খান। নিত্য ভোগে মাকে প্রথমে দেওয়া হয় লেবুর শরবত। ষষ্ঠীর দিন হয় পোলাও। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে হয় খিচুড়ি ভোগ। প্রতিদিন সকালে মায়ের ভোগের সঙ্গে থাকে পাঁচরকম ভাজা, পায়েস মিষ্টি। রাতে নানরকম ব্যাঞ্জন, সাথে ঘিয়ে
ভাজা লুচি। মহাষ্টমীর দিন থাকে বড় বড় চন্দ্রপুলী, গোটা ফল, শুকনো মিষ্টির পদ।