কিছুদিন হল নবনীতা দেবসেন আমাদের ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর তৈরি করে যাওয়া অনেক কিছুই আজও আমাদের আশ্রয়। অসাধারণ সাহিত্য ভাণ্ডারের জন্ম যেমন দিয়েছেন, তেমনই আজীবন কাল মেয়েদের কথা ভেবেছেন, মেয়েদের নিয়ে লিখেছেন এবং মেয়েদের কথা খুঁজে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর নানা দেশে। তাঁর এই অনন্ত সৃষ্টি সৌকর্যের মধ্যে আছে ‘সই’। তাঁর নিজের হাতে গঠন করা পত্রিকা। যা মহিলা সাহিত্যিক এবং আরও নানা প্রতিভাদের একত্র করে তৈরি। এ তো শুধু পত্রিকা নয়, এ যেন এক সংগঠন, যেখানে মেয়েরা আলাদা করে সাহস পায় রোজ। মেয়েদের নিজেদের কথা বলার জায়গা। প্রতি মাসে একবার করে ‘ভালোবাসা’-য় সবাই মিলে জড়ো হয়ে গল্পগাছা কিংবা লেখালেখি নিয়ে আড্ডাটুকু চিনিয়ে দেয় মেয়েদের একান্ত নিজেদের জায়গা, যেখানে প্রবেশাধিকার হয়তো সবার আছে কিন্তু কারও ওপর জোর করার অধিকার নেই, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করানোর অধিকার নেই কিংবা অনিচ্ছে নিয়ে হেঁশেল ঠেলার দায় নেই। সম্প্রতি ‘সই’- একুশে পা দিল। নবনীতা দেবসেনের মা রাধারানি দেবীর আবির্ভাব দিবসেই ‘সই’-এরও আবির্ভাব। কিন্তু এবার যেন একটু বড় করেই অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে ছিল নবনীতা দেবসেনের। আর তাই বলেও ছিলেন সে কথা, সঙ্গে জানিয়েছিলেন তিনি হয়তো সেদিন নাও থাকতে পারেন। তিনি নেই। কিন্তু সইয়ের শক্তি এতটুকু কমেনি। নবনীতা দেবসেনের ইচ্ছেমতো আয়োজন হয়েছিল অ্যাকাডেমি সভাঘর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমিতে। ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, বাণী বসু, অমিয় দেব। অমিয় দেব এবং নবনীতা দেবসেন কলেজবেলার বন্ধু। দুজনেই যাদবপুর তুলনামূলক সাহিত্যের পড়ুয়া আর তাই ছোটবেলার নানা স্মৃতি কথা বেশ সুন্দরভাবে তুলে ধরলেন তিনি। বাণী বসু জানালেন তাঁদের ‘সই’ -এর জন্ম বৃত্তান্ত। কীভাবে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুর সঙ্গে সদলবলে সবাই দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেই মজার দিনগুলোই সম্পদ। এরপর গান। মৌসুমী ভৌমিকের সেই যাদবপুর-কাল থেকেই নবনীতাদির সঙ্গে আলাপ। নবনীতা দেবসেন নিজে একসময় ভারতের নানা জায়গায় ঘুরে চন্দ্রাবতীর রামায়ণের নানা লৌকিক গল্পকথা এবং গান জোগাড় করেছিলেন। মৌসুমী ভৌমিক নিজেও সেই কাজ করেন বলে নবনীতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আরও গাঢ় হয়। গবেষণার নানা কাগজ নিয়ে আলোচনা চলত তাঁদের। পূর্ব-অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতেই সুর ধরছিলেন মৌসুমী। তারপর ছিল একটি আলোচনাসভা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী, জয়া মিত্র, অন্তরা দেবসেন (নবনীতার দেবসেনের কন্যা এবং সূত্রধর) এবং সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য। বিষয় ছিল অবরুদ্ধ সময়ের লেখা । সাংবাদিকতা বা সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গনে কীভাবে স্বাধীন লেখালেখির জায়গা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং মানুষ এই পরাধীন যুগে কতটা বিপন্ন তাই ছিল এই আলোচনার বিষয়। সব শেষে ছিল সইদের স্মৃতিচারণ। সেখানে পড়া হল নবনীতার ভ্রমণ, প্রবন্ধ, গল্প এবং কবিতা থেকে কিছু অংশ। এদিন পুরনো কিছু সাহিত্যের সংকলন করে প্রকাশিত হল ‘নির্বাচিত সই-সাবুদ ৩০ নভেম্বর, ২০১৯’।
—কৌশানী মিত্র