উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
‘ঈশ্বরের দেওয়া শরীরটার অযত্ন কোরোনা, প্রাণপণ সাধনা করো...তোমার ঠাকুর্দার সঙ্কল্পকে রূপদান করবার চেষ্টা করতে ভুলো না।’
কথাগুলো বলেছিলেন ভারতবিখ্যাত কুস্তিগির অম্বিকাচরণ গুহর ছেলে কুস্তিগির রামচরণ গুহ তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কুস্তিগির ছেলে গোবর গোহকে তাঁর ছেলেবেলায়, তাঁকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে! গোবর গোহ হলেন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি বেঁচে থাকতেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন! আজ তোমাদের শোনাব বিশ্বের সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ মল্লবীরের কথা।
অম্বিকাচরণ গুহ ওরফে অম্বু গোহের (সাহেবদের উচ্চারণে ‘গুহ’ হয়ে গিয়েছিল ‘গোহ’) স্বপ্ন ছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শরীরচর্চাকেন্দ্র স্থাপন করে ‘বাঙালি দুর্বল জাতি’ এই মিথ্যে রটনাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া! তিনি ছিলেন বাংলার ‘আখড়া সংস্কৃতি’র পথিকৃৎ। স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও বাঘাযতীন আসতেন তাঁর আখড়ায় কুস্তি শিখতে।
গোবর গোহের জন্ম ১৮৯২ সালের ১৩ মার্চ কলকাতার মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের এই বিখ্যাত কুস্তিগির পরিবারে। আসল নাম ছিল যতীন্দ্রচরণ গুহ। শৈশবে তিনি এত মোটা ছিলেন যে ঠাকুর্দা অম্বু তাঁকে রসিকতা করে ‘গোবরের ড্যালা’ বলতেন। গোবরও ছিলেন জেদি। তিনিও ঠাকুর্দার কাছেই কুস্তির প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়া শুরু করেছিলেন। ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর জ্যাঠা ভারতবিখ্যাত কুস্তিগির ক্ষেত্রচরণ ওরফে খেতু গোহ, নিজের বাবা রামচরণ এবং তাঁদেরই আখড়ার নামী কুস্তিগির খোলসা চৌবে, রহমানি পালোয়ানের কাছেও তালিম নিয়েছিলেন।
১৯১০ সালে মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে গোবর এন্ট্রান্স পাশ করলেন ও ডাকযোগে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। আঠারো বছরের গোবরের উচ্চতা তখন ছয় ফুট এক ইঞ্চি, ছাতি আটচল্লিশ ইঞ্চি! সেই বয়সেই তিনি শুরু করলেন পেশাদার কুস্তিগিরের জীবন।
লন্ডনের জনবুল সোসাইটি কুস্তির এক বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সেখানে ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করলেন গোবর গোহ। সেইসঙ্গে ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ইতালির বিভিন্ন নামকরা কুস্তিগিরদের সঙ্গেও লড়লেন তিনি।
১৯১২ সালে তিনি আবার গেলেন বিলেতে। বিলেতের কাগজে তাঁর চেহারার বিশালত্বের বর্ণনা, মুগুরের বর্ণনা, ডায়েটচার্ট এমনকী তিনি যে বিলিতি খাবার -পানীয় খান না শুধু দিশি রাঁধুনিদের রান্না ও বাদামের সরবত খান সেই খবরও বিস্ময়ের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল!
বিদেশে তাঁর প্রথম সাফল্য আসে ১৯১৩ সালের ২৭ আগস্ট স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কুস্তিগির ক্যাম্পবেলকে হারিয়ে ‘স্কটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ’ লাভের মধ্যে দিয়ে! এই বছরেরই ৩ সেপ্টেম্বর গোবরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এডিনবরার ওলিম্পিকজয়ী কুস্তিগির জিমি এসেনের সঙ্গে। বিজয়ী গোবর লাভ করেন ‘চ্যাম্পিয়নশিপ অফ ইউনাইটেড কিংডম’ পদক! এর আগে মুষ্টিযোদ্ধা কার্পেন্টিয়ার ছাড়া এত অল্প বয়সে এই সম্মান আর কেউ পাননি! এরপর তিনি অংশ নেন ইউরোপের ‘নোভো সার্ক ট্যুর্নামেন্ট’-এ, যেখানে ইউরোপের বহু বিখ্যাত পালোয়ানদের তিনি পরাজিত করেন।
দেশে ফিরে কয়েক বছর দেশের নানা প্রান্তের কুস্তিগিরদের সঙ্গে লড়াই করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করলেন, যাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কোলাপুরের গণপু পালোয়ান।
১৯২০ সালে আমেরিকায় গেলেন গোবর। ভারতীয় কুস্তিগিরদের মধ্যে গোবরই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সরকারি ভাবে আমেরিকায় গৃহীত হয়েছিলেন। ১৯২১ সালের ২৪ আগস্ট সানফ্রান্সিসকোতে অ্যাডস্যান্টেলকে পরাজিত করে তিনি ‘লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ’ পেয়ে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করলেন! পরাধীন ভারতবর্ষের এক তথাকথিত ‘দুর্বল বাঙালি’র এই জয়ের মূল্য কিন্তু অপরিসীম ছিল যা ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা আছে!
হল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন পালোয়ান হকি ড্রাককেও আমেরিকার মাটিতে হারিয়ে ছিলেন গোবর গোহ ১৯২১ সালের ১৯ এপ্রিল। উনত্রিশ বছরের গোবরের মনে ছিল দুর্জয় সাহস! লড়াইয়ের দিন সারা দুপুর তিনি স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়ে কাটিয়ে ছিলেন। সন্ধেবেলা ঘরে তৈরি লেমনেড খেয়ে রওনা হলেন ব্রডওয়ে অডিটোরিয়ামের দিকে। গোবরের নিজের আবিষ্কার করা কিছু মোক্ষম কুস্তির প্যাঁচ ছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ধোঁকা’, ‘টিব্বি’, ‘গাধানোট’, ‘ঢাক’, ‘টাং’, ‘পাট’, ‘ধোবাপাট’, ‘কুল্লা’, ‘রদ্দা’ ও ‘নেলসান’। এই ‘নেলসান’ প্যাঁচেই শেষ মুহূর্তে তিনি ড্রাককে তুলে এমন আছাড় মারলেন যে অনেকক্ষণ তাঁর আর উঠবার ক্ষমতা থাকল না! সমস্ত ব্রডওয়ে অডিটোরিয়ামের দর্শক পরাধীন ভারতবর্ষের এই বীর বঙ্গসন্তান গোবর গোহকে উল্লাসে ফেটে পড়ে অভিনন্দন জানালেন!
দেশে ফিরে গোবর ব্রতী হলেন ঠাকুর্দার স্বপ্নপূরণে। ১৯৩৬ সালে মসজিদবাড়ি স্ট্রিট থেকে আখড়া উঠিয়ে নিয়ে এলেন হেদুয়ার কাছে গোয়াবাগানে। গড়ে তুললেন দেশের ছেলেদের মধ্যে শরীরচর্চার অভ্যাস, শুরু হল মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে কুস্তি শেখার প্রচলন। কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে এখানে কুস্তি শিখতেন। বিখ্যাত ব্যায়ামবীর মনোহর আইচ, মনোতোষ রায়, বিষ্ণুচরণ ঘোষ, খাশাবা দাদাসাহেব যাদব (১৯৫২ সালের ওলিম্পিক ব্রোঞ্জজয়ী) এখানে কুস্তির পাঠ নিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি তাঁর জীবনাবসানের পর গোয়াবাগান স্ট্রিটের নামকরণ হয় ‘গোবর গোহ সরণি’ ও কলকাতার আজাদহিন্দ বাগে ১৯৯৬ সালে স্থাপিত হয় গোবর গোহের আবক্ষমূর্তি।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে