উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
গরিব ঘরের অনাথ বালক কেষ্ট মায়ের মৃত্যুর পর বাধ্য হয়ে এসে উঠেছে দিদি কাদম্বিনীর বাড়ি। বৈমাত্রেয় ভাই-এর হঠাৎ এসে হাজির হওয়াটা দিদির কাছে উপদ্রব বলেই মনে হয়েছে। উশুল করতে কাদম্বিনী ওস্তাদ। দুবেলা খাবার দেওয়ার বদলে সারাদিন খাটিয়ে খাটিয়ে মেরেছেন দিদি। পাশের দোতলা বাড়িতে থাকেন কাদম্বিনীর জা হেমাঙ্গিনী। এঁরা অবস্থাসম্পন্ন। সঙ্গে আছেন স্বামী বিপিন, ছেলে মেয়ে। নিজে সামনে থেকে যেদিন কেষ্টকে দেখলেন, তার শুকনো মুখ দেখেই ভেতরটা আনচান করে ওঠে হেমাঙ্গিনীর। কেষ্টকে নিয়ে হেমাঙ্গিনীর সোহাগা আর আদর সহ্য করতে পারেন না কাদম্বিনী। কেষ্টকে কেন্দ্র করে দুই জা-এর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ নিত্যদিনে পরিণত হয়। হেমাঙ্গিনীর প্রচণ্ড জ্বর ছাড়ছে না দেখে কেষ্ট তাদের গাঁয়ের বিশালাক্ষী দেবীর মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ায়, নিজের দিদি জামাইবাবুর হাতে প্রচণ্ড মারধর জোটে কপালে। হেমাঙ্গিনী স্বামীর কাছে দাবি করেন কেষ্টকে তার চাই। নিজের কাছে রাখতে চান। স্বামীর হেলদোল নেই দেখে কেষ্টকে নিয়ে তিনি গোরুর গাড়িতে করে কেষ্টর গ্রামের দিকে রওনা দিলেন। পথের মধ্যে থেকে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনলেন স্বামী। তিনি কেষ্টকে বললেন, ‘তোর মেজদিকে তুই বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আয় ভাই। শপথ করছি আমি বেঁচে থাকতে তোদের দুই ভাই-বোনকে আজ থেকে কেউ পৃথক করতে পারবে না। আয় ভাই তোর মেজদিকে নিয়ে আয়।’ যে ছবির গল্পটা তোমাদের বললাম সেই গল্পের নাম ‘মেজদিদি’। তোমাদের প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্প নিয়ে সবচেয়ে বেশি সিনেমা তৈরি হয়েছে নানান সময়ে। কোনও কোনওটা আবার একাধিকবার। যেমন মেজদিদি দুবার তৈরি হয়েছে। প্রথমবারটি তোমাদের মন জয় করেছিল বেশি করে। হবে নাই বা কেন? সেখানে মেজদিদি যে কানন দেবী। বাংলা ছবির সবাক যুগের গোড়ার দিকের সেরা নায়িকা গায়িকা ছিলেন তিনি। কেষ্ট চরিত্রের জন্য নতুন একটি মুখকে আবিষ্কার করেছিলেন কানন দেবীর স্বামী পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। এ সম্পর্কে কানন দেবী জীবনী গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘এই মেজদিদিতেই তিনি একটি অবাঙালি মুসলমান ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে কেষ্টর ভূমিকায় নামান। তার চলা বলা ও এক্সপ্রেশনে যে কে বলবে সে শরৎচন্দ্রের মানবসন্তান কেষ্ট নয়।’ ১৯৫০ সালে মুক্তি পাওয়া এই সুপারহিট ছবির রিমেক হল ১৯৯১ সালে। এবারে মেজদিদি চরিত্রে দেবশ্রী রায়। স্বামী বিপিনের চরিত্রে রঞ্জিত মল্লিক। একই গল্প, তবে কি জানো তো উপস্থাপনা ঠিকঠাক না হলে সেই ছবি দর্শকরা দেখতে চান না। যেমনটি ঘটেছে মেজদিদি ছবির রিমেক-এর বেলায়।
শরৎচন্দ্রের আরেক সাড়া জাগানো ছোটগল্প ‘রামের সুমতি’। শ্যামলাল রামলাল দুই বৈমাত্রেয় ভাই। রামলালকে বড্ড ভালোবাসতেন তার বৌদি নারায়ণী। মায়ের স্নেহ ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন দেওরের জন্য। রামের দুষ্টবুদ্ধি কিছু কম ছিল না। গ্রামের লোক তাকে ভয় করত। সুন্দর কাটছিল নারায়ণীর সংসার। হঠাৎ হাজির হলেন নারায়ণীর বিধবা মা দিগম্বরী কন্যা সুরধুনি কে সঙ্গে নিয়ে। দিগম্বরী দু’চোখে দেখতে পারতেন না রামকে। বৌদি দেওরের এই মধুর সম্পর্ক তার কাছে অসহ্য ঠেকত। প্রচণ্ড গোল বাধল যেদিন দিগম্বরী পুকুর থেকে বড় একটা রুই মাছ জেলেকে দিয়ে ধরালেন। রাম ওই পুকুরে দুটো ঢাউস মাছ বড় করছিল। তাদের নাম দিয়েছিল কার্তিক গণেশ। তার একটা এই মাছ। রাম ক্রোধের মাথাতেই বলে ‘ডাইনি বুড়ি আমাদের সব খেতে এসেছে’। বৌদি দেওরের এই অটুট বন্ধন দেখে দিগম্বরী চলে যেতে চাইলে নারায়ণী সম্মতি দেন। শেষমেশ রাম বৌদিকে বলে ‘না বৌদি উনি থাকুন। আমি ভালো হয়েছি। আমার সুমতি হয়েছে।’ মায়া মমতা ভরা রামের সুমতি গল্প নিয়ে ছবি হলে ছোট-বড় সবার যে মন টানবে তাতে আশ্চর্যের কী? সেই রামের সুমতি প্রথমবার নির্মিত হয় ১৯৪৭ সালে। নিউ থিয়েটার্সের এই ছবির পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। মলিনা দেবী হয়েছিলেন নারায়ণী। তাঁকে দেখলেই মনে হয় মমতাময়ী। দজ্জাল দিগম্বরী হয়েছিলেন রাজলক্ষ্মী দেবী। রামের চরিত্রে মাস্টার সুগত। এই ছবির রিমেক তৈরি হল ১৯৭৭ সালে। এবারে নারায়ণীর ভূমিকায় মাধবী মুখোপাধ্যায়। মাস্টার দীপঙ্কর রামের চরিত্রে। সীতা মুখোপাধ্যায় হয়েছিলেন দিগম্বরী। আগের ছবির সঙ্গে তুলনা করা না গেলেও এ ছবিও সবার ভালো লেগেছিল। পরিচালক গুরু বাগচী।
‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পটি শরৎচন্দ্রের আরেক স্মরণীয় সৃষ্টি। যাদব, তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা, ভাই মাধব আর তার স্ত্রী বিন্দুবাসিনী। এই গল্পের প্রধান চারটি চরিত্র। অন্নপূর্ণা তাদের দেড় বছরের ছেলে অমূল্যকে তুলে দিয়েছিলেন বিন্দুর কোলে। সেই থেকেই অমূল্য বিন্দুর ছেলে। হঠাৎই হাজির হলেন এদের পিসতুতো বোন এলোকেশী নিজের পুত্র নরেনকে সঙ্গে নিয়ে। এলোকেশী এসেই সুখের সংসারে ঝড় তোলে। এমন পর্যায়ে সব ঘটনা পৌঁছল যে বিন্দু চলে গেলেন বাপের বাড়ি। মূর্ছা যাওয়ার ব্যামো আছে বিন্দুর। সেই সব নিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঢলতে থাকেন বিন্দু। কিন্তু শেষে ভাশুর আর জা নিজেরা এলেন বিন্দুকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আবারও বিন্দুর কোলে অন্নপূর্ণা তুলে দেন অমূল্যকে। চোখের জলে ভাসানো এমন গল্প ‘বিন্দুর ছেলে’ প্রথমবার তৈরি হয় ১৯৫২সালে। পরিচালক চিত্ত বসু। অন্নপূর্ণা মলিনা দেবী। বিন্দু সন্ধ্যারানি। এলোকেশী রেণুকা রায়। ছবির রিমেক তৈরি হল ১৯৭৩ সালে। এবার সন্ধ্যারানি হলেন অন্নপূর্ণা আর বিন্দু হলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। নীলিমাদাস এলোকেশীর চরিত্রে। সন্ধ্যারানি ও মাধবী দুজনের মুখশ্রী আর অভিনয়ের আন্তরিকতা শরৎচন্দ্র ঘরানার। তাই দর্শকদের ভালো লাগবেই। পরিচালক গুরু বাগচী।
শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের জনপ্রিয়তা কোনওদিন ফুরোবার নয়। সেই শ্রীকান্তের প্রথম পর্বের দুই কিশোর ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত পাঠকদের মনে স্থায়ী দাগ কেটে রেখেছে। সঙ্গে রয়েছেন অন্নদাদিদি। ইন্দ্রনাথ বেপরোয়া নির্ভীক ডানপিটে হলেও শ্রীকান্তের প্রতি দুর্বলতা গোড়া থেকেই তার মধ্যে ছিল। এদের ভালোবাসার ঠাঁই জুটেছে অন্নদাদিদির কাছে। অন্নদা দিদিকে দেখে ইন্দ্রনাথের মনে হয়েছে ছাইচাপা আগুন। কত রকম বিপদ সংকুল অ্যাডভেঞ্চার করেছে ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তকে সঙ্গে নিয়ে। সাহিত্যের এই তিনটি স্মরণীয় চরিত্র নিয়ে তৈরি হয়েছিল ছবি ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত অন্নদা দিদি’। ইন্দ্রনাথের চরিত্রে পার্থপ্রতিম চৌধুরী। শ্রীকান্ত সজল ঘোষ। অন্নদা দিদির চরিত্রে কানন দেবী। ছবিটিতে সকলেই প্রাণবন্ত। পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। গল্প পড়ার মজাটা ছবিটিতে পাওয়া গিয়েছে ষোলো আনা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে এমন কিছু স্মরণীয় চরিত্র এঁকে গেছেন যেখানে তার পিতৃহৃদয় যেন ধরা পড়েছে। ছোট্ট মিনি আর তার কাণ্ডকারখানাকে চমৎকারভাবে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছিলেন ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে। কাবুলিওয়ালা ও মিনির খুনসুটির ব্যাপারে মুগ্ধ পাঠকেরা। সেই গল্পকে বড় পর্দায় তুলে ধরলেন বিখ্যাত পরিচালক তপন সিংহ। এই গল্পের চিত্ররূপ দিতে যখন প্রযোজক অনুরোধ করেছেন তপন সিংহকে তিনি মুহূর্ত বিলম্ব না করে সম্মত হয়েছিলেন। ছবিটি তৈরি হয় ১৯৫৭ সালে। ছবি বিশ্বাস নাম ভূমিকায়। ছোট্ট মিনি চরিত্রে নিয়ে আসা হল ঠাকুরবাড়ির টিঙ্কু ঠাকুরকে। তার আধো-আধো শব্দ উচ্চারণ, বিস্ফারিত চোখ দুটি দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। ছবি সুপারহিট।
‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ পাঠকমাত্রই প্রিয়। নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে অতিথি গল্প নিয়ে ছবি করলেন তপন সিংহ। বালক তারাপদ ভবঘুরে। ঘর তাকে টানে না, পথ তাকে টানে। মাঝে মাঝে জিরোবার জন্য কোথাও হয়তো থামে। আবার শুরু হয় পথ চলা। তেমন চলতে গিয়ে জমিদারকন্যা চারুশশীর সঙ্গে বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল তারাপদ। কিন্তু বিধাতা পুরুষ তার জীবন অন্যভাবে গড়ে দিয়েছিলেন। তারাপদকে জীবন্ত করে তুললেন পরিচালক। পার্থ মুখোপাধ্যায় সেই চরিত্রের শিল্পী। চারুশশীর চরিত্রে বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে তৈরি ছবিতে অতিথি অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে।
বিদেশ থেকে প্রথম যে বাংলা ছবি পুরস্কার নিয়ে এসেছিল তার নাম ‘বাবলা’। ১৯৫১ সালে নির্মিত এ ছবি এক দরিদ্র বালকের গল্প নিয়ে। গল্পকার সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। মাস্টার বীরেন নাম ভূমিকায়। সঙ্গে ছিলেন শোভা সেন, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, যমুনা সিংহ প্রমুখ শিল্পী। পরিচালক অগ্রদূত। ১৯৫২ সালে কার্লোভিভ্যারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সামাজিক উন্নতির জন্য নিবেদিত ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয় ‘বাবলা’।
হরিহর সর্বজয়ার কন্যাসন্তান দুর্গা, পুত্রসন্তান অপু। এই দুই বালক বালিকা সাহিত্যের পাতায় অমর হয়ে আছে। উপন্যাসের নাম ‘পথের পাঁচালী’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসের মাধ্যমে ছবির জগতে প্রবেশ করেন বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায়। কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি তৈরি করেছিলেন ১৯৫৫ সালে। গল্পে বর্ণিত গ্রামকে জীবন্ত করে তুললেন বড় পর্দায়। বালক-বালিকার জন্য নতুন মুখ আবিষ্কার করলেন তিনি। অপুর চরিত্রে সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গা চরিত্রে উমা দাশগুপ্ত। এঁদের প্রথম অভিনয় এই ছবিতে। শেষ অভিনয়ও এই ছবিতে। কিন্তু এই ছবির সুবাদে তাঁরা হয়ে গেলেন স্মরণীয়। ছবিটি বিদেশ থেকে রাশি রাশি পুরস্কার নিয়ে এসেছিল। বাংলা ছবির মাইলস্টোন হয়ে গেল ‘পথের পাঁচালী’।
ঘর থেকে পালিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল একটি বালক। তাকে নিয়েই শিবরাম চক্রবর্তীর বহুপঠিত কাহিনী ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। কাঞ্চন নামের বালকটি কলকাতায় এসে বহু রকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। সেগুলি উঠে এসেছে এই গল্পে। সেটাই দেখলাম ছবিতে। কাঞ্চনের ভূমিকায় পরম ভট্টারক লাহিড়ী। এটিই তার প্রথম ও শেষ অভিনীত ছবি। এই গল্পের চিত্ররূপ দিলেন বিখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ১৯৫৯ সালে।
বইয়ে পড়া শিশু চরিত্রগুলি বড় পর্দায় উঠলে ভালো লাগে বইকি। ফলে যে ছবিগুলির কথা তোমাদের বললাম তা ছবি হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আপাতত সাহিত্যের স্মরণীয় তেমন বালক বালিকার গল্প নিয়ে ছবি করায় ভাটা নেমেছে। আশা করব জোয়ার আসবে খুব তাড়াতাড়ি।
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে