উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
‘হারে বান এসেছে মরা গাঙে
খুলতে হবে নাও, তোমরা এখনো ঘুমাও।’
চারণকবি মুকুন্দদাস একদিন নিজের সৃষ্ট এই গান গেয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন পরাধীন ভারতবাসীকে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে ঘিরে তখন তোলপাড় সারা দেশ। এই বিপর্যয় মোকাবিলা করতে তখন এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রমুখরা। এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেমন করে গাঁয়ের ছেলে মুকুন্দদাস একার প্রচেষ্টায় ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, সেই বিস্ময়কর কাহিনিই আজ বলব তোমাদের।
১৮৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিক্রমপুরের বানারি গ্রামে বাবা গুরুদয়াল ও মা শ্যামসুন্দরীর ঘরে জন্ম হয়েছিল যজ্ঞেশ্বর দের। ঠাকুর্দা ছিলেন নৌকার মাঝি। বাবার ছিল মুদির দোকান। তবে, তিনিও ভালো গান গাইতেন, যা শুনে মুগ্ধ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে আদালতে আর্দালির চাকরি দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাই দস্যি ছেলে যজ্ঞেশ্বরকে গানই টানত, লেখাপড়া নয়। কীর্তনের দল থেকে গান সংগ্রহ করা ছিল তাঁর নেশা। যে গান নিয়ে পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘কীর্তন -সঙ্গীত’ গ্রন্থটি।
চব্বিশ বছর বয়সে যজ্ঞেশ্বর হঠাৎই একদিন দেখা পেলেন ভক্তস্বামী রামানন্দ হরিবোলানন্দের। তিনি যজ্ঞেশ্বরের নতুন নাম দিলেন ‘মুকুন্দদাস’, দীক্ষা দিলেন বৈষ্ণবমন্ত্রে। বরিশালের অদ্বিতীয় জননায়ক অশ্বিনীকুমার দত্তের চোখে হঠাৎই একদিন পড়ে গেলেন দুরন্ত মুকুন্দদাস। অশ্বিনীকুমার বুঝলেন এই ছেলেটিই পারবে তার কণ্ঠের গান দিয়ে এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সার্থক করে তুলতে! তিনি চেয়েছিলেন তাঁদের বক্তৃতার বক্তব্যগুলোকে যাত্রাপালার আকারে তৈরি করে গ্রামে গ্রামে প্রচার করার গুরুভার যেন মুকুন্দদাস নিজের কাঁধে তুলে নেয়, পালন করে প্রকৃত ‘চারণকবি’র ভূমিকা! মুকুন্দদাস সে দায়িত্ব মাথা পেতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আন্দোলনে! একের পর এক রচনা করলেন তাঁর যাত্রাপালা ‘মাতৃপূজা’, ‘ব্রহ্মচারিণী’, ‘পথ’, ‘সাথী’, ‘কর্মক্ষেত্র’, ‘পল্লীসেবা’ প্রভৃতি। ইংরেজ সরকারের কোপদৃষ্টি পড়ল বরিশালের ওপর। বরিশাল হল ‘প্রোক্লেম্ড ডিস্ট্রিক্ট’ অর্থাৎ ‘আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী অঞ্চল’। নিরপরাধ মানুষ লাঞ্ছিত হলেন আসাম ও পূর্ববঙ্গের ছোটলাট ফুলার সাহেবের হুকুমে। গর্জে উঠলেন মুকুন্দদাস! গাইলেন, ‘বিদেশী আর কি দেখাও ভয়, দেহ তোমার অধীন বটে, মন তো স্বাধীন রয়’!
ব্রিটিশ সরকার ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র উচ্চারণে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। কিন্তু মুকুন্দদাস সে নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে সহস্র নরনারীর কানে পৌঁছে দিলেন তাঁর গান, ‘বন্দেমাতরম মন্ত্র কানে, বর্ম এঁটে দেহে মনে, রোধিতে কি পারবে রণে, তুমি কত শক্তিময়’!
ইংরেজ সরকারও দমবার পাত্র নয়। একদিকে লবণ মামলা, অন্যদিকে পুলিসের পিকেটিং, ট্যাক্স, লাঠি, কারাবরণ, কণ্ঠরোধের মধ্য দিয়ে সর্বত্র আতঙ্কের আবহ তৈরি হল। কিন্তু অকুতোভয় মুকুন্দদাস এরই মধ্যে দিয়ে তিন চারজন সঙ্গী নিয়ে কখনও ভিক্ষা করে, কখনও সামান্য দক্ষিণা নিয়ে, নিজে হাতে নৌকা চালিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে স্বদেশি যাত্রাগান শোনাতে লাগলেন দেশের মানুষকে। তাঁর লেখা গান ও যাত্রাপালা ‘বরিশাল হিতৈষী পত্রিকা’য় প্রকাশিতও হল। পাবনা ও মেদিনীপুরে গঠন করলেন ‘স্বদেশী যাত্রা পার্টি’। ইংরেজের শাসনদণ্ড তাড়া করে ফিরতে লাগল তাঁকে। পরপর ছত্রিশটি ইংজাংশন জারি হল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেবার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যেতে লাগলেন এবং প্রত্যেক স্থানেই নতুন উদ্যমে নতুন মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতে ছড়িয়ে দিলেন তাঁর গান! ‘মাতৃপূজা’ পালায় তিনি অত্যাচারী ব্রিটিশদের কটাক্ষ করে লিখলেন, ‘ছিল ধান গোলা ভরা, শ্বেত ইঁদুরে করল সারা’!
ইংরেজ সরকারের আর সহ্য হল না! বাজেয়াপ্ত হল তাঁর ‘মাতৃপূজা’, ‘পথ’, ‘সাথী’ যাত্রাপালা। বন্দি হলেন তিনি। তিনবছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা হল। জরিমানার টাকা মেটাতে পৈতৃক দোকানটিও খোয়া গেল। অকালমৃত্যু হল তাঁর স্ত্রীর। কিন্তু তিনি দমলেন না। অব্যাহত রইল তাঁর কাজ। বিদেশি পণ্য বর্জনে, তাঁর ‘কর্মক্ষেত্র’ পালায় ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি, বঙ্গনারী, কভু হাতে আর পরোনা’ গানের শেষে দর্শকাসনে বসা মেয়েরা হাতের কাচের চুড়ি সশব্দে ভেঙে ফেলতেন। পালাশেষে সেই স্তুপিকৃত চুড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হতো! খিলাফত আন্দোলনের সময় হিন্দু -মুসলমান ঐক্যের লক্ষ্যে তিনি গাইলেন, ‘ভাইরে ভাই, হিন্দু আর মুসলমান, এক মায়েরই দুটি সন্তান রে!’
কাজী নজরুল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান শুনে চমৎকৃত হয়েছিলেন!
১৯৬৮ সালে ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’ নামে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল, নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সবিতাব্রত দত্ত।
মুকুন্দদাস সারা জীবন সাতশো মেডেল ও বহু পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু,১৯৩৪ সালের ১৮ মে তাঁর জীবনাবসানের পরেও আজও মানুষের মনে যে ‘চারণকবি’ আখ্যা নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন তা বোধহয় লক্ষ মেডেলের চেয়েও বেশি মূল্যবান!