মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
বাবাকে সস্তা ফ্রেমের একটা চশমা বানিয়ে দিয়েছিল সেবার। তুতুলকে একটা বার্বি এনে দিয়েছিল। সেটা পেয়ে তুতুলের সে কি আনন্দ! আর চুমকির জন্য এনেছিল সিটি গোল্ডের একটা মালা কানের দুলের সেট। চুমকিও খুব খুশি হয়েছিল। সেটা সবার জন্যেই ছিল সারপ্রাইজ গিফট। কিন্তু এবারে এরিয়ার পাওয়ার খবরটা বেঁফাস বলে ফেলে সারপ্রাইজ দেবার সু্যোগটা বেমালুম উধাও করে দিয়ে নিজের ওপরই বেশ রাগ হচ্ছিল বিনায়কের। এতক্ষণ চুমকি উল্টো দিকে ফিরে ফোনে খুটখুট করছিল। হঠাৎ সে বিনায়কের গা ঘেঁষে বসল।
—এই শোনো না...
বিনায়ক প্রমাদ গুনল। না চাইতেই এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে আসা আর তার সঙ্গে আদুরে গলার স্বর— এই দুটো ঘটনা একসঙ্গে ঘটা মানেই বিনায়কের জন্যে তা নিতান্তই অশুভ ইঙ্গিত। নির্ঘাত দামি কোনও জামাকাপড় চাইবে! কিন্তু বিনায়ককে যারপরনাই অবাক করে দিয়ে চুমকি ঘোষণা করল-
—এই দেখো, এই নাইট ক্রিমটার কথা তোমায় বলেছিলাম।
—নাইট ক্রিম!
শুকিয়ে আসা গলায় একটু আর্দ্রতা মাখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল বিনায়ক। নাইট ক্রিম খায় না মাথায় দেয়, যেন সেটাই সে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না।
—কবে? কবে বলেছিলে?
বিনায়কের গলায় একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা।
—উফ! তোমায় নিয়ে আর পারি না! যেদিন তানিয়ার বিবাহবার্ষিকীতে গেলাম, মনে পড়ছে না? ওর ড্রেসিং টেবিলে সাজিয়ে রাখা ছিল! তোমায় দেখিয়ে বললাম, আমাকেও একটা কিনে দিতে! তুমিই তো তখন আমায় প্রমিস করেছিলে সামনে কোনও এরিয়ার পেলে কিনে দেবে। কি গো! মনে পড়েছে এবার! বাব্বা! যা ভুলোমন হয়েছ না!
নাহ! বিনায়ক কিছুই মনে করতে পারল না। গত মাসে চুমকির অন্তরঙ্গ বন্ধু তানিয়ার অ্যানিভার্সারিতে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কোনও নাইট ক্রিম সম্পর্কে কোনও কথা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না তার। যা হোক। সেকথা বলে চুমকির ভেতর থেকে বেরতে থাকা ভালোবাসার, আবেগের লাভা স্রোতের বেগকে রুদ্ধ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। সে চুপ করে আছে দেখে চুমকি বলল, ‘তাহলে অর্ডার করে দিচ্ছি। কেমন!’
বিনায়ক জানে তার হ্যাঁ বা নাতে আসলে কিছুই যায় আসে না চুমকির। ও যখন ডিসাইড করেই ফেলেছে, তখন ও নেবেই।
বিনায়ক আমতা আমতা করে বলল, ‘তা দাম কত? বাবা, মা, তুতুল...’
তার পুরো কথা শেষ করার প্রয়োজন রইল না আর। কারণ তার আগেই চুমকি বলে উঠল, ‘দাম! না মানে দামটা একটু বেশিই পড়বে বুঝলে! আসলে হবে নাই বা কেন! পঁয়ত্রিশের পরে মেয়েদের স্কিনে যেসব প্রবলেম আসে সেগুলোকে দূর করে দেয় এই ক্রিম। দাম তো একটু বেশি হওয়াই উচিত! দেখছ না তানিয়া তিন মাসের বড় হয়েও আমার চেয়ে কত বেশি ইয়াং! কী গ্লো করে!’
বিনায়ক মনে মনে গজরাল। —তা কী শুধু ওইসব ছাইপাঁশ নাইট ক্রিমের গুণে? ও রীতিমতো জিম করে, ডায়েটিং করে। শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। যদিও মুখে সেসব বলার সাহস দেখাল না।
আবারও একটু মিনমিন করল বিনায়ক।
—কই দামটা কত বললে না তো?
—তেমন কিছুই না। তোমার বাজেটে কুলিয়ে যাবে। চার হাজার তিনশো টাকা।
—কী!
না চাইতেও আঁতকে ওঠার আওয়াজটা ছিটকে বেরিয়ে এল বিনায়কের মুখ থেকে। সাড়ে চার হাজার টাকার একটা ক্রিম কিনবে! তাও কি না যা মেখে দিনের বেলা বেরবে না! ভাবতেই পারছে না সে! নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে এসব বিলাসিতা মানায়! কিন্তু মুখে এসব কথা বলতে গেলেই গোঁসা হবে চুমকির। সামনের দু’-একমাস হয়তো ঠিকঠাক কথাও বলবে না। নিম পাতা খাওয়া মুখে বিনায়ক বলল, ‘একটু কম দামের মধ্যে নিলে হয় না গো! বুঝতেই পারছ তুতুলটা আশা করে রয়েছে একটা ব্যাগের জন্যে। সেই কবে বলে রেখেছিল মেয়েটা! মা একটা গরদের শাড়ি চেয়েছে সেই কবে! আজও দিয়ে উঠতে পারিনি। আর বাবার জুতোটাও...!’
কপাল কুঁচকাল চুমকি।
—আমার ক্রিম কেনার পরেও কড়কড়ে সাতশো টাকা থাকবে। ওই দিয়ে যা করার কোরো।
—সাতশো টাকা দিয়ে এতজনকে উপহার দেব!
মনে মনে বিড়বিড় করল বিনায়ক।
চুমকির অবশ্য সেসব দিকে কোনও লক্ষই নেই। সে কয়েক মিনিট পরে ফোনটা খাটে শুইয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘যাক বাবা! আমিই পেলাম শেষ পর্যন্ত! স্টকে একটাই পড়ে ছিল বুঝলে! পুরো দুধে ঠাসা ক্রিম! উফ! কালই ডেলিভারি দেবে।’
—দুধে ঠাসা মানে? তুমি কী কন্ডেনসড মিল্ক কিনছ নাকি?
ভ্রুর ভাঁজ গভীর হল চুমকির।
—কী যে বল তুমি! এটা হল মিল্ক ক্রিম। খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি।
—দুধ দিয়ে তৈরি! তা দুধের জিনিসের জন্যে কেউ শুধুমুধু এতগুলো টাকা নষ্ট করে! কুড়ি টাকার দুধের প্যাকেট আনলেই তো কতদিন খাঁটি দুধ লাগাতে পারতে মুখে!
—হা হা হা। এ কি শুধুই দুধ গো! তারমধ্যে জাফরান সহ বহু জানা অজানা জিনিস মেশানো রয়েছে। তবু দেখ না আমার লাকটা কী ভালো। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার ক্রিমটা এত সস্তায় পেয়ে গেলাম।
সস্তায় পেয়ে গেল! মাই গড! বলে কী মহিলা! এই যদি সস্তা হয়, তবে দামি ক্রিম কাকে বলে! যদিও মুখে কিছুই না বলে তুতুলকে পাশের ঘর থেকে আনতে চলে গেল বিনায়ক। গিয়েই শুনল, তুতুল বকম বকম করে ঠাম্মা দাদুকে তার পাঁচ হাজার টাকা এরিয়ার পাওয়ার গল্প বলছে। তুতুলকে বাইরে থেকে ডেকে এনে তখনকার মতো বাঁচল সে।
সকালে ভাত বাড়তে বাড়তে মা প্রথম কথাটা তুলল।
—বাবু, আমার গরদের শাড়িটার পাড় বেশি চওড়া নিস না কেমন! একটু সরু পাড়ই আমার ভালো লাগে। আর তোর বাবাকে জুতোর জন্য গড়িয়াহাটে একবার নিয়ে যাস। মানুষটা আজ কত দিন ধরে জুতোর অভাবে হাঁটতে পারছে না।
বিনায়ক অন্য দিনের মতো খেতে পারল না আজ। অর্ধেক খেয়েই দেরি হয়ে যাওয়ার অজুহাতে উঠে পড়ল। মাকে কোনও উত্তরই দিতে পারেনি সে।
ওদিকে সকাল থেকেই চুমকি হাওয়ায় ভাসছে। আজই তার নাইট ক্রিম ডেলিভারি হবে। মনের ভেতরে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছে বিনায়কের। সারাটা দিন চোঁয়া ঢেকুর আর অস্বস্তি নিয়েই কাটাল। মা যখন জানবে চুমকির নাইট ক্রিমের জন্যে এবারেও তাকে গরদের শাড়ি দেওয়া হল না, কতটা কষ্ট পাবে! আর বাবা! নরম জুতো না পরলে বাবার পায়ের গোড়ালিতে যে ব্যথা হয়! আজ কতদিন হাঁটতে পারছে না ভালো করে। না হাঁটলে ওদিকে সুগার বাড়বে চড়চড় করে!
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরেই বিনায়ক বুঝল এতক্ষণে তুতুলের কাছ থেকে সব সত্যি জেনে ফেলেছে মা-বাবা! মা মুখে কিছুই প্রকাশ করল না। বাবা বেশি সোজাসাপ্টা মানুষ হওয়ায় বলেই ফেললেন, ‘বাবু, আজও হাঁটতে যেতে পারলাম না রে! গোড়ালিতে বড় ব্যথা!’ বিনায়কের চোখ দুটো জ্বালা করছে কেন জানি!
রাতে শুতে এসে বিনায়ক দেখল ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে অনেকক্ষণ ধরে ঘষে ঘষে একটা বেগুনি রঙের চকচকে কৌটো থেকে ক্রিম মাখছে চুমকি। চোখমুখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, ওর স্থির বিশ্বাস এই ক্রিম মাখলে ম্যাজিক করেই হঠাৎ এক আশ্চর্য সুন্দরী হয়ে উঠবে সে।
মিনিট পনেরো পরেও আয়নার সামনে থেকে উঠছে না দেখে তুতুলই ফুট কাটল।
—ও মা! আজ সারারাত তুমি কি মুখ দেখেই চলবে? শোবে না?
এবারে বোধহয় চুমকি একটু লজ্জাই পেল। সে তৎক্ষণাৎ উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। তুতুল তৈরি হয়েই ছিল। মা উঠতেই সেও তড়িৎগতিতে বড় লাইটটা নিভিয়ে জিরো ওয়াটের আলো জ্বেলে দিয়ে চুমকির ক্রিমটা হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ঠাম্মা এই মহার্ঘ ক্রিমটা একবার ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই নাচতে নাচতে নিষ্পাপ মুখে তুতুল ফিরে এসে শুয়ে পড়ল। যেন কিছুই করেনি সে!
নীলা দেবীর হাতে তুতুলের দিয়ে যাওয়া সেই ক্রিমটা রয়েছে। অন্ধকারে হাতের মুঠোয় নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। বেশ মসৃণ কৌটোটা। তার স্বামী অর্থাৎ বিনায়কের বাবা ঘুমিয়ে পড়তেই সে গুটিগুটি পায়ে ডাইনিংয়ে এসে একটা চেয়ারে নিঃশব্দে বসল। এবারে চোখ বড় বড় করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন কৌটোটা। তাদের যৌবনেও কী এমন ক্রিম ছিল! এত দামি ক্রিম! কী জানি! হয়তো ছিল! সামান্য কেরানির বউ বলেই হয়তো তার এই ক্রিম চোখে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি! কী সুন্দর রং কৌটোটার! দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এবারে আস্তে আস্তে কৌটোর মুখটা খুলে ফেলল। ভেতরে থাকা ক্রিম সাদা রঙের। কী সুন্দর একটা গন্ধ! দুধের একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ। নাহ! এত ভালো গন্ধ সে জীবনেও পায়নি।
চোখ বন্ধ করে নাকের সামনে কৌটোটা ধরে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপরই হঠাৎ বিনায়কদের ঘরের দরজায় খুট করে আওয়াজ হতেই ক্রিমের কৌটোটা ডাইনিং টেবিলের ওপর ফেলে রেখেই ঘরে ঢুকে গেল। বউমার হাতে ধরা পড়ে গেলে সে এক লজ্জার বিষয় হবে!
সকালে মৃন্ময়বাবু অর্থাৎ বিনায়কের বাবাই প্রথম ওঠেন ঘুম থেকে। উঠেই চা করে খাওয়া তার বরাবরের অভ্যেস। তিনি উঠে ডাইনিংয়ে আসতেই দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। একটা বেগুনি রঙের কৌটোর মধ্যে একটা হুলো জিভ ঢুকিয়ে কী যেন খাচ্ছে। তাকে দেখেই হুলোটা পালিয়ে গেল।
মৃন্ময়বাবু কৌটোটা তুলে দেখলেন কৌটো ফাঁকা। চেটেপুটে বিড়ালটা খেয়ে নিয়েছে ভেতরের মাল-মশলা। তিনি নীচে গড়াতে থাকা ঢাকনা দিয়ে কৌটোটা বন্ধ করে সেটা টেবিলের উপর রেখে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।