মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
কার আদেশ তা লেখা নেই। কিন্তু সবাই জানে ওটা পাঁচু বোসের ভদ্রাসন। লঞ্চঘাটের জেটিতে যাওয়ার কাঠের পুলের শেষপ্রান্তে এই তিন-চারখানা কাঠের তক্তা লাগানো ছিল, তাতে যাত্রী নিরাপত্তার কথা ভেবে এরকম সাবধানবাণী লেখা হয়েছিল। জেটি রিপেয়ারিংয়ের সময়ে তক্তাগুলো ঝেড়ে নিয়ে এসে নিজের ভদ্রাসন বানিয়েছে পাঁচু বোস। একেবারে সাবধানবাণী সমেত।
ক’দিন আগে বেপাড়ার এক প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি তাতে বসে গভীর ও গম্ভীর প্রেমালাপে ব্যস্ত ছিল। ব্যাচেলার পাঁচু বোস জীবনে প্রেম করেনি। সে কিছুটা রাগে, খানিক লোভে তাদের বার্তালাপ শোনার জন্য গাছটার আড়ালে বিড়ি টানছিল।
সে শুনল প্রেমিকটি বলছে, ‘এখন কী আর সে ভূত আছে! বাজারে উৎকৃষ্ট পেতনিই নেই, তাই ভূতের ভিত খুব নড়বড়ে, আজ এখানে তো কাল অন্য জায়গায়!’
প্রেমিকা বলল, ‘তা বলে আমি কোনও অ্যাকশন নেব না, ভয়ে চুপ করে থাকব!’
প্রেমিক বলল, ‘তোমাদের ছাদে মাঝ রাত্তিরে ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছে, যখন তখন দরজায় কড়া নাড়ছে, মানে এগুলো ক্যারেকটারলেস ভূত। না, ভূত ঠিক নয়, এরা হল অতৃপ্ত আতমা। বাড়িতে সুন্দরী কেউ থাকলে এর উপদ্রব বাড়ে।’
প্রেমিকা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘ভূতই বটে তো? তুমি নয়তো? মা কিন্তু তোমায় সন্দেহ করছে। সেদিন বলছিল, পাশের বাড়ির ছেলেটার ডাবল রোল—ভূতের মতো দেখতে ওঁচাটে ছেলে...।’
ছেলেটা কেবল বলতে পারল, ‘যাঃ বাবা!’
প্রেমিকা ফিসফিস করে বলল, ‘শুধু ছাদে নয় গো, ভূতেরা এইসব নদী-টদীর ধারে গাছতলাতেও থাকে! ঘন ঘন বিড়ি টানে, অকারণে আড়ি পাতে...।’
পাঁচু বোস হাঁ। একেই কী বলে প্রেমালাপ! সে আর দাঁড়ায়নি।
ওই তক্তাপোষের পাঁচজন অংশীদার। পাঁচু ছাড়া কালো মানিক, সাদা মানিক, সত্য মাস্টার এবং প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই বেচা ঘোষ। পুরো সিনিয়র সিটিজেন ব্যাচ। তবে, সাদা মানিকের বিশ্বাস, সে এখনও সিনিয়র সিটিজেন হয়নি। তার অফিসিয়াল বয়স পিতৃদেবের অসাবধানতার কারণে দু’বছর বেড়ে গিয়েছে। স্কুলে ভর্তির দিন মা গিয়েছিল মন্দিরে পুজো দিতে। বাবা ঠাকুরমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মানকেটা কবে যেন হয়েছিল?’
ঠাকুরমা একটুও না ভেবে জবাব দিয়েছিল, ‘ছিঃ ছিঃ, নিজের ছেলের জন্মদিন মনে নেই...একুশে শ্রাবণ।’
বাবা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ওঃ, সে তো ডেট হল। ইয়ার, মানে কোন বছর?’
ঠাকুরমা বলল, ‘এই তো সেদিন... যেবার তেরাত্রি টানা বৃষ্টি হল, আমাদের দোরের সামনে এক হাঁটু জল...।’
বাবা স্কুল যেতে যেতে রাস্তায় অন্তত তিনজনকে জিজ্ঞেস করেছিল ঠিক কোন বছরে বৃষ্টিটা হয়েছিল। প্রথমজন দিনু মিত্তির বদ্ধ কালা। কী শুনেছিল কে জানে, বলল, ‘তা সে বছর দশেক হবে।’ পাড়ার মুদির দোকানদার কার্তিক খানিক ভেবে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে... সেবারই নতুন ওজনদারিখানা কিনেছিলাম, তা প্রায় সাত বছর হল।’
এবং শেষ জন অঙ্কের কড়া মাস্টার রেবতীবাবু বললেন, ‘নাঃ, এরকম কোনও ঘটনা ঘটেইনি!’
বাবা বলল, ‘সে কী, মানকে জন্মায়নি!’
রেবতীবাবু একবার মানিকের দিকে তাকিয়ে নাকি বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘তার মানে বৃষ্টি ও জন্মানোর প্রক্রিয়া দুটি অসমান ও অসমান্তরাল সরলরেখা, যে কোন টাইমে একে অপরকে ক্র্যাস করে...কে জানে হতেও পারে!’
বাবা স্কুলে কার্তিকমুদির বলে দেওয়া বয়সই লিখিয়ে এল।
পরের সপ্তাহে মানিক হজমিগুলি কিনতে গিয়েছিল। কার্তিক বলল, ‘তোর বয়স সাত নয়, পাঁচ। ওজনদারির রসিদখানা খুঁজে পেয়েছি। বাবাকে বলে দিবি।’
মানিকও বাড়ি ফিরে সটান বলে বসল, ‘বাবা, আমার জন্মের রসিদ কার্তিককাকুর কাছে আছে।’
এখন দুপুর যাই যাই, ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। মাঝগঙ্গায় বালি ভর্তি সারি সারি অন্তত গোটা পাঁচেক নৌকো নোঙর করা। একটু পরেই জোয়ার আসবে। নোঙর তুলে দিলেই জোয়ারের এক ধাক্কায় নৌকাগুলো ফ্রিতে চলে যাবে অনেকটা দূর। পাঁচু বোসও নিজের তক্তাপোষে বসে আছে, বাকি চারজন এলে গুলতানির যে ঢেউ উঠবে তাতে পাঁচ সিনিয়র সিটিজেনও এক ধাক্কায় পিছিয়ে যাবে নিজেদের যৌবনে। কেবল দরকার একখানা জুতের সাবজেক্ট। সেখানেও অনেক রেস্ট্রিকশন, যে কেউ একটা বিষয় উত্থাপন করলেই হবে না, হতে হবে অ্যাজ পার সিরিয়াল। এ আড্ডার এই নিয়ম। আজ বিষয় বলবে পাঁচু বোস। গতকাল বেচা ঘোষ বলেছিল, ‘যে যার যৌবনের হিরোইজমের গপ্পো বলুন।’
তারপর আর কাউকে কিছু বলতে দেওয়া হয়নি। ঘণ্টা খানেক টাইম ধরে তিনি নিজেই সাতচল্লিশের স্বাধীনতা, ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলন, একাত্তরের নকশাল পিরিয়ড নিয়ে বলে গিয়েছেন। সবেতেই তিনি নাকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন ফোরফ্রন্টে। কালো মানিক কেবল একবার প্রশ্ন করেছিল, ‘এখন তো আপনার আশি, মানে সাতচল্লিশে ছিলেন পাঁচ কী ছয়। মানে বেচাদা, আপনি নিশ্চয়ই কারওর কোলে চেপে ফোরফ্রন্টে ছিলেন, কে সেই হিরো?’
সেদিন আড্ডার যেটুকু টাইম বেঁচেছিল তাতে বাকি কেবল সত্য মাস্টারই একমাত্র বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার যৌবনের সবচেয়ে হিরোগিরির ঘটনা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। সে বিবাহের পর পর, একবার তোমাদের বউদি পিত্রালয়ে গিয়েছে তো গিয়েছেই, ফেরার নাম নেই। আমি ট্রাঙ্ককল করে হুমকি দিলুম। তিন দিনের মধ্যে ফিরতে হবে, না হলে তোমার একদিন কী আমার একদিন...।’
পাঁচু বলল, ‘বাপ রে, বলতে পারলেন! তারপর?’
সত্য মাস্টার বললেন, ‘তারপর আবার কী, ফিরে এল সুরসুর করে। তবে ওই তিনদিন খুব টেনশনে ছিলুম, যদি না ফেরে!’
সাদা মানিক ফুট কাটল, ‘সে বউদি নেহাত আপনাকে স্নেহ করেন তাই...’
আজ বিষয় নির্বাচনের দায়িত্ব পাঁচু বোসের, তাই সে ভদ্রাসনে ধ্যানস্থ। সবাই এসে গিয়েছে। ধ্যানস্থ পাঁচু চোখ খুললেই সাবজেক্ট পাওয়া যাবে। এ যেন এগজামিনেশন সেন্টার, ঘণ্টা বেজেছে, এবার কোশ্চেন পেপার দেওয়া হবে।
পাঁচু বোস চোখ খুলে বলল, ‘পেয়েছি। যে যার নিজের প্রথম অভিজ্ঞতা বলুন। এনি ফিল্ডে। তবে সংক্ষেপে।’
কালো মানিক তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল, ‘সে আমার প্রথম বিয়ে...।’
তাকে থামিয়ে পাঁচু বোস বলল, ‘প্রথম মানে, আপনার তো একখানাই বিয়ে!’
কালো মানিক মাথা নেড়ে বলল, ‘ওই হল... বলতে চাইছি বিয়ের প্রথম অনুভূতি। আমার হাতের উপর ওর হাত রেখে পুরোহিত বলল বলুন, যদিদ্বং হৃদয়ং তব, তদস্তু..। আমি সংস্কৃতে পাঁচের বেশি কখনও পাইনি। ভাবলাম কী দরকার রিস্ক নিয়ে। মন্তরখানা বাংলায় বললাম, হৃদয় যদি দিই, তোমাকেই দেব।’
পুরোহিত বাকরুদ্ধ। পাশ থেকে কনে বিড়বিড় করে বলেছিল, ‘যদি মানে! দেখাচ্চি।’
এবার সত্য মাস্টার। তিনি খানিক ভেবে বললেন, ‘সে হল গিয়ে স্কুলে আমার প্রথম দিন। ফার্স্ট পিরিয়ড। ক্লাস থ্রি। আমি চেয়ারে বসতেই লাস্ট বেঞ্চ থেকে একটি ছাত্র বলল, ছার, পেচ্ছাপ করতে যাব—।
বললুম, এখন নয়, আগে রোল কল।
সে চুপ করে গেল, আমি নাম ডাকতে লাগলুম। রোল নম্বর পনেরো কী ষোলো পর্যন্ত ডেকেছি, ছেলেটি ফের বলে উঠল, খুব জোরে পেয়ে গেছে ছার—।
আমি ভাবলুম কড়া হতে হলে প্রথম দিনেই হওয়া দরকার। কড়া গলায় বললুম, চুপ করে বোস।
পঁয়ত্রিশ জন ছাত্র, ছেলেটার রোল পঁয়ত্রিশ। মানে একেবারে অপদার্থ। দেখলুম আগের তিনদিন সে অ্যাবসেন্ট। বোঝাই যাচ্ছে, এই জন্যই তার বাথরুমের তাড়া। বললাম, গার্জেনের চিঠি এনেছিস?'
সে চুপ করে রইল।
বললুম, তার মানে স্কুল পালিয়েছিলি?
সে মাথা চুলকোচ্ছে। ভাবলুম প্রথম দিন, যাক গে, মাপ করে দিই। বললুম, কী যেন বলছিলি?
—আজ্ঞে, পেচ্ছাপ...।
বললুম, ছিঃ, সর্বসমক্ষে পেচ্ছাব বলতে নেই।
অন্য বেঞ্চ থেকে একজন বলে উঠল, কী বলতে হয় আমি জানি ছার, ওটা ইয়ে পেয়েচে বলতে হয়।
বললুম, না, বলবে ছোট বাইরে যাব। যাও—।
ছেলেটি বলল, দেরি হয়ে গেল ছার... ছোট বাইরে, ছোট করে ভেতরেই হয়ে গেল যে!’
এতক্ষণ সাদা মানিক বলার জন্য উসখুস করছিল। সুযোগ পেয়েই বলল, ‘স্কুলের ক্রিকেট টিমের হয়ে প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেছিলুম।’
পাঁচু বোস জিজ্ঞেস করল, ‘তাই নাকি! পেশ না স্পিন বোলার ছিলেন আপনি?’
সাদা মানিক সবিস্তারে বলতে আরম্ভ করল একেবারে টস থেকে। দু’-চার মিনিট শুনে অধৈর্য সত্য মাস্টার অভ্যেস বশে বললেন, ‘হয়েচে, হয়েচে, কেবল হ্যাটট্রিক সম্পর্কে যাহা জান বল।’
সাদা মানিক থমকে গিয়ে বলল, ‘অ, শুধু ওটুকু!
তা বেশ। শুনুন... ফার্স্ট ম্যাচে পর পর তিন বলে তিনখানা ক্যাচ মিস করেছিলুম। ক্যাচ মিসের হ্যাটট্রিক। প্রথম দুটো মিস হবার পরে থার্ড ক্যাচখানা প্রায় ধরে ফেলেছিলুম, তারপর ভাবলুম ব্যাটে রান করেছি শূন্য, বল করতে জানি না। একটা হ্যাটট্রিক অন্তত থাক, তাই ওই ক্যাচখানাও ছেড়ে দিলুম।’
সে থামতেই আশি ছুঁই ছুঁই বেচা ঘোষ এবার বললেন, ‘শোন বাপু, আমি যা বলব, সেটা কিন্তু পাঁচ কান করা যাবে না। একখানা গোপন ব্যাপার... জীবনে ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট, এই একখানাই প্রেমপত্র পেয়েচি!’
কালো মানিক বলল, ‘বলেন কী! কে দিল? বেয়ান?’
বেচাবাবু বললেন, ‘ধুস! এ পাড়ার ওই নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির একজন।’
সাদা মানিক বলল, ‘একেবারে ডায়েরেক্ট প্রেম নিবেদন করে লেখা?’
বেচা ঘোষ বললেন, ‘ভয়ে এ কাগজখানা বাড়িতেও রাখতে পারিনি, সঙ্গে নিয়ে ঘুরচি।’
তারপর পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে গলাখাঁকারি দিয়ে পড়তে শুরু করলেন—
‘মাই ডিয়ার বেচাবাবু, আমি আপনার নাতি বিল্টুর বান্ধবী বুঁচির ঠাকুমা। অনেকদিন ধরে দূর থেকে ভাবি আপনার হাসিখানা কী সুন্দর। এত চমৎকার বাঁধানো দাঁত আমি দেখিনি। পান খেয়ে খেয়ে আমার দাঁতগুলো গেচে। আপনি কোথায় বাঁধিয়েচেন, একটু ঠিকানাটা দেবেন? আমি রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় মনিং ওয়াকে বের হই। আপনিও যদি আসেন গঙ্গার ধারে বকুল গাছের নীচে দেখা করেন, ঠিকানাটা নিতাম। আর হ্যাঁ, দয়া করে দাঁতগুলো পরবেন না, পকেটে করে নিয়ে আসবেন। আমি একবার হাত দিয়ে পরখ করতুম। ভবদীয়, বুঁচির ঠাকুমা।’
বিকেল প্রায় শেষ। এবার লাস্ট ম্যান পাঁচু বোস। অথচ তার মুখে কোনও কথা নেই। সত্য মাস্টার অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘কই পাঁচু কিছু বল, এবার উঠতে হবে যে—।’
পাঁচু বলল, ‘আমি ছিলুম রিকশ ইউনিয়নের দুঁদে নেতা।’
এতটুকু বলে সে থেমে গেল।
বেচা ঘোষ বললেন, ‘তা তো ছিলেন, সে আমরা দেকেচি।’
পাঁচু বোস বলে চলল, ‘আপনারা জানেন আমি অকৃতদার। সেটা ঠিক আবার বেঠিকও।
আমার প্রেম বিয়ে সব ওই রিকশর সঙ্গেই। রিকশ উঠে গিয়ে এখন টোটো হয়েচে। তাই আমি এখন বিধবা। এবং ইউনিয়নও বন্ধ। কর্মীরা কাজ হারায়, নেতা কখনও কাজ হারিয়েচে শুনেচেন! আমি হলুম ওয়ার্ল্ডে ফার্স্ট বেকার নেতা! এ অভিজ্ঞতা দুনিয়ায় কারওর নেই, তাই শেয়ার করালেও বুঝবেন না...।
যাক গে, চলুন, সন্ধে হচ্চে।’