মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
ছেলেটা দেখেনি ভাগ্যিস। দেখলে দাম বাড়িয়ে বলত নির্ঘাত। ফুটপাতের দোকানদার ওরা। কাস্টমারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝে। প্রমদাকান্তও কম যান না। এই ফুটপাত থেকে জলের দরে দেশি-বিদেশি সাহিত্যের অনেক অমূল্য রতন তুলে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেই যে সেই যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই...। প্রমদাকান্ত তাই করেন। তবে কোনও বই নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখালে ওরা বুঝতে পারে। ভেবে নেয় পাখি ফাঁদে পড়েছে। উড়ে যাবে না। তাই নট নড়নচড়ন। তখন ফিক্সড প্রাইসের গাওনা গায়। আরে রাখ তোমার ফিক্সড প্রাইস। ফুটের বইয়ের দোকান। কোনও বাড়ির মনিব মারা গিয়েছে। ছেলেরা বিদেশে থাকে। বাড়ির চাকর বইয়ের আলমারি ফাঁক করে ঝেড়ে দিচ্ছে। নইলে এত পুরনো এডিশনের রেয়ার বই এত কমে বেচো কী করে চাঁদু? ওসব আমাকে শেখাতে এসো না। মনে মনে এসবই বিড়বিড় করেন প্রমদাকান্ত। আবার ভাবেন, সবই কি বাড়ির চাকর ঝাড়ে? ছেলেরাও তো জঞ্জাল সাফ করার জন্য আলমারি ধরেই বেচে দিচ্ছে আজকাল। বাবা হয়তো অভাবের মধ্যেও কষ্টের টাকায় বই কিনেছেন। আহাম্মকের মতো কাজ করেছেন। যেমন তিনি করছেন।
কবে আছেন কবে নেই। একবার তাঁর ছেলে অর্ক তাঁর একটা ছবি বাঁধানোর আর্জেন্ট অর্ডার দিলেই হল। সাদা কাপড়ের ম্যারাপ খোলা ইস্তক তর সইবে না, আলমারি ধরেই হয়তো বেচে দেবে।
ছেলেকে ডাক্তার বানিয়ে কানমলা খেয়েছেন তিনি। সাহিত্যের সাতশো কিলোমিটার দূর দিয়ে হেঁটে চলে যায়। বইগুলো সব ওজন দরেই হয়তো বেচে দিয়ে বেঁচে বর্তে যাবে। প্রমদাকান্ত ভাবেন, অর্কর বউ মধুরিমাও তো ডাক্তার। তাঁর তো বইয়ের প্রতি বেশ আগ্রহ আছে। ছেলেটা অমন বেরসিক হল কী করে? বাপের কিসসু পায়নি অর্কটা। উল্টে বউমা মধুরিমা যেন শ্বশুরের ধাঁচ পেয়েছে। রীতিমতো বইপত্তর পড়েটড়ে। আজকের এই ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের ই-বুকের এরাতেও ওই বয়সি একটা মেয়েকে বই পড়তে দেখলে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
পেনশনের টাকায় এমনিতেই টেনেটুনে চলতে হয় প্রমদাকান্তকে। সেই টাকায় থাবা বসাচ্ছে বই। একেবারে বাঘের থাবা। রেহাই নেই। কী করবেন প্রমদাকান্ত? রেয়ার বই পড়া, সেসব বই সংগ্রহে রাখার নেশা মদের নেশার চেয়েও মারাত্মক। সেই নেশাতেই সপ্তাহে একবার অন্তত এই অঞ্চলে ঢুঁ না মারলে পেটের ভাত পাকস্থলী ইস্তক পৌঁছবে না প্রমদাকান্তর।
হাতে বইটা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকেন প্রমদাকান্ত। ছেলেটার অবশ্য হুঁশ নেই। শেষমেশ জলের দরেই বইটা পেয়ে গেলেন তিনি। বইটাকে শুধু রেয়ার কালেকশন বললে ভুল হবে। রেয়ার অব দ্য রেয়ারেস্ট যাকে বলে।
প্রমদাকান্তর বয়স বাহাত্তর ছুঁই ছুঁই। বলতে গেলে জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে এই মহার্ঘ প্রাপ্তিতে তাঁর দু’চোখ ফেটে জল এসে গেল। বইটাকে সাইডব্যাগে সযত্নে গুছিয়ে রাখেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালটাকে দ্রুত তুলে নিলেন মুঠোর মধ্যে। চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে আছে। তাই দু’চোখ রুমালে মুছে নিলেন তিনি। ফুটপাতে একটু ছায়া খুঁজে গিয়ে দাঁড়ালেন। রুমালে মুখ, গলা ও ঘাড়ের ঘাম মুছে নিলেন। চশমাটা ফের চোখে রাখলেন। ভাবলেন, জীবনের এই প্রাপ্তির ঘটনাটা কারওর সঙ্গে শেয়ার না করলে স্বস্তি নেই তাঁর। কিন্তু এই ঘটনা তো রামা-শ্যামার সঙ্গে শেয়ার করা চলে না। বাড়িতে নীলিমাকে বলতে গেলে ভিক্ষে চাই না কুকুর ঠেকাও পরিস্থিতি হবে। বউমা মধুরিমা অবশ্য বুঝবে। তবে ওকে বলারও ইচ্ছে হল না। ইচ্ছে হল না কারণ, প্রমদাকান্তর মনে ও মগজে এসে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে সুবিনয়। প্রমদাকান্তর প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে একজন। তাঁর বিচারে সুবিনয় সবার সেরা। সবচেয়ে প্রিয়। সেরা সমঝদার। প্রমদাকান্তর এক-এক সময় মনে হয়েছে অর্কর বদলে সুবিনয় যদি তাঁর নিজের ছেলে হতো, তাহলে বেশ হতো। অর্কর মতো একটা নীরস আত্মকেন্দ্রিক ছেলে তিনি কামনা করেননি। এমন একটা ঘটনা শুধু সুবিনয়ের সঙ্গেই শেয়ার করতে পারলেই যেন প্রমদাকান্ত স্বস্তি পেতেন। শরীরের সব জ্বালাপোড়ার উপশম হয়ে যেত। কিন্তু সুবিনয় তো তাঁর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। সেই যাদবপুরে গিয়ে ফ্ল্যাট কিনে সেটেল্ড হয়েছে। প্রমদাকান্ত ভাবেন, তিনি এখনই সুবিনয়ের কাছে চলে যাবেন নাকি? যাদবপুরেই চলে যাবেন নাকি? নিজের ভেতরে দোটানা চলতে থাকে। তিনিও চলতে থাকেন ডালহৌসি এলাকা ছেড়ে শিয়ালদার দিকে। রাস্তা অনেকটা। তবু বাস ট্রামের তোয়াক্কা করেন না প্রমদাকান্ত। শিয়ালদহে নেমে হামেশাই ধর্মতলা আর ডালহৌসি চত্বরে হেঁটেই চলে আসেন। আবার হেঁটেই ফেরেন। সেই চিরকেলে এগারো নম্বর বাস। একটু হাঁটাচলার মধ্যেই থাকতে চান তিনি। নইলে বয়স পেয়ে বসবে। কলকব্জা সব অকেজো হতে শুরু করবে। শরীর এখনও টানটান মেদহীন। বয়স না বললে ধরা যায় না।
শিয়ালদার খুব কাছাকাছি এসে আবার পোকা নড়ে বসল প্রমদাকান্তর মগজে। নড়ছে তার কারণ, হঠাৎই তাঁর মনে পড়ল, আজ বুধবার। সুবিনয়ের উইকলি ডে অফ। ছুটির দিন নিশ্চয়ই বাড়িতে থাকবে। রেস্ট নেবে। মধ্যমগ্রামের বাড়িতে থাকতে তো বলত, কাল ডে অফ। সূর্যেরও মুখ দেখব না। সত্যিই তো খবরের কাগজের কাজ। চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটি আওয়ার। ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছোকরা বেশ মজার কথা বলে। বলে, ‘স্যার আটঘণ্টা কাজের দাবিতে যখন আন্দোলন হয়েছে, তখন বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিলাম আমরা। তাই আমাদের এখন চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। আর গুলির সামনে যারা বুক পেতে দিয়েছিল, তারা সবাই এখন গিয়ে বসেছে সরকারি চেয়ারে।’ প্রমদাকান্ত ভাবেন, ছেলেটার এই রসবোধের জন্যেই তিনি বয়সের ব্যবধান ভুলে একদা ছাত্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন। মধ্যমগ্রামে ছিল, কাছে ছিল। দেখা হতো, আড্ডা হতো। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে সুখ আছে। এমন তুখোড় সেন্স অব হিউমার যে, কাকে কী বলে বোঝাবেন প্রমদাকান্ত। বেশ চোস্ত চৌকস ছেলেটা। সুন্দর অবজার্ভেশন। অভিজ্ঞতার অর্জন কিছু কম নয়। প্রমদাকান্ত মনে মনে ছাত্রকেই গুরু মানেন। এই ডিজিটাল যুগে তো তিনি একেবারেই ডিসকোয়ালিফাইড। সাদা কাগজে মার্জিন টেনে কলমে লেখার দিন তো গিয়েছে। প্রমদাকান্তর একটু আধটু লেখালিখির বাতিক আছে। সুবিনয় বলে, ‘স্যার, একটা স্মার্টফোন কিনে নোটপ্যাডে লিখুন। অনেক সুবিধা।’ অর্কর বউ মধুরিমাও বেশ কয়েকবার ঝোঁক তুলেছে, বলেছে, ‘বাবা, চলো তোমাকে একটা দামি ফোন কিনে দিই। আমি সব শিখিয়ে দেব। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেব।’
আরে ধুর ওসব দিয়ে কী হবে? আবার ভাবেন প্রমদাকান্ত, ফেসবুকে নাকি অনেক পুরনো বন্ধুর হদিশ মেলে। কৈশোরের বেশ কয়েকজন বন্ধুর কথা তাঁর খুব মনে পড়ে। তাঁরা সব কোথায় যে যার মতো ছিটকে গিয়েছে। তাঁর মধ্যমগ্রামে তিনি একা শিবরাত্রির সলতের মতো আছেন। বসুনগর, বঙ্কিমপল্লিতে যে দু-চারজন ছিল, তাঁদের ছবিতে মালা উঠেছে। বাসুদেব, মলয় ওরা সব কোথায় থাকে? বেঁচে বর্তে আছে কি না ভেবে বুকের ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করেন। তাঁর স্কুলের সহকর্মীদের মধ্যে কেউই তাঁকে তেমনভাবে টানে না যে, গিয়ে দু’দণ্ড আড্ডা দিয়ে সময় কাটাবেন। তারচেয়ে তাঁর বইবন্ধু অনেক প্রিয়। অল্প বয়সে পড়া বইগুলো ফিরে ফিরে পড়েন। সেই পড়ার মধ্যে দিয়ে ফিরে ফিরে আসে তাঁর হারিয়ে যাওয়া অনেক মুখ। তলিয়ে যাওয়া অনেক ঘটনা। বেশ রোমাঞ্চ জাগে। তাঁর এই ফিলিংসটা সুবিনয় বেশ ধরতে পারত, বুঝতে পারত। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রমদাকান্ত তাঁর অজান্তেই কখন শিয়ালদা সাউথ স্টেশনের দিকে হেঁটে চলে এসেছেন। তার মানে সুবিনয়ই টানছে তাঁকে। আর তাই প্রমদাকান্তকে যেন কোনও ক্লান্তি স্পর্শ করতে পারছে না। আজকের অমূল্য রতন প্রাপ্তির কথা সুবিনয়কে না বলা পর্যন্ত যেন তাঁর কোনও নিস্তার নেই। বাড়ি ফিরতে নির্ঘাত অনেক রাত হয়ে যাবে। বাড়িতে নীলিমা ভাববে। হয়তো বার বার ফোনে তাঁকে ধরার চেষ্টা করবে। তা করুক গে। ফোন বেজে যাক। প্রমদাকান্ত আজ ফোন ধরবেন না। আজ তাঁর কাউকে কোনও কৈফিয়ত দেওয়ার দায় নেই। তাঁর রক্তে এখন যে রোমাঞ্চ জেগে আছে, তাতে সুবিনয়ের সঙ্গে দেখা না হলে সব মাটি হয়ে যাবে।
একটা লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে ভিড় ঠেলে উঠে গেলেন প্রমদাকান্ত। অফিসযাত্রীদের বাড়ি ফেরার ভিড়। এই কুৎসিত ভিড়ের ট্রেনে ওঠার পাত্র তিনি নন। মধ্যমগ্রাম থেকে দুপুরের ট্রেনে উঠে শিয়ালদা আসেন, ভিড় থাকে না। ফেরার সময় ধীরেসুস্থে বারাসাত লোকালে উঠে সিনিয়র সিটিজেনের সিট। ব্যস নো টেনশন। সেই টেনশন আজ ছুঁতে পারছে না প্রমদাকান্তকে। দিব্যি ময়দা ঠাসা ভিড়ে কাঁধের ঝোলাটাকে কোনওমতে সামলে দাঁড়িয়ে রইলেন। যাদবপুর স্টেশনে হুড়োপাটা করে নেমেও গেলেন।
স্টেশন থেকে রিকশয় বেশ অনেকটাই পথ। অটোতেও উঠতে পারতেন। সেখানে লাইনে দাঁড়ানোর তর সইবে না প্রমদাকান্তর। তিনি এখন পারলে উড়ে চলে যাবেন সুবিনয়ের কাছে। সেই পাখনাও যেন তাঁর গজিয়ে যেতে পারে। তাঁর কাঁধের ঝোলায় দুষ্প্রাপ্য বইটিকে তিনি পরম যত্নে ভরে রেখেছেন। ঝোলার মুখের কাছটাকে খামচে মুঠো করে ধরে রেখেছেন। প্রমদাকান্ত যেন কোনও এক অলীক পাখিকে ঝোলায় পুরেছেন। যেন মুঠি আলগা করলেই সেই পাখি এই সন্ধেরাতের অন্ধকারেই ফুরুৎ উড়াল দিয়ে পালিয়ে যাবে। একেবারে সুবিনয়ের সামনে গিয়েই এই মুঠি আলগা করবেন তিনি।
সুতনুকা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে রিকশ থেকে নেমে পড়লেন তিনি। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তরতর সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে তিনতলায় উঠে গেলেন। কে বলবে তিনি বাহাত্তুরে বুড়ো। ডোর বেল চেপে দিলেন। দরজা খুলে সুদেষ্ণা বলল, ‘আরে স্যর আপনি!’
‘সুবিনয় বাড়ি আছে তো?’
‘হ্যাঁ, আছে। আসুন। আপনি ভেতরে আসুন।’ প্রমদাকান্ত ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন। গন্তব্যে পৌঁছনোর পরে আর কীসের ব্যস্ততা? সুদেষ্ণা মেয়েটি আগাগোড়াই বেশ আন্তরিক। সে চেঁচিয়ে ডাকল সুবিনয়কে, ‘এই যে দেখ কে এসেছেন।’ সুবিনয় বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে ভূত দেখল। ‘এ কী! স্যার আপনি? কোত্থেকে এলেন?’ প্রমদাকান্ত এখন শান্ত। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘চলো আগে বসি। তারপরে বলছি।’ প্রমদাকান্তকে ডিভানের কাছে বসাল সুবিনয়। নিজে গুছিয়ে বসল ডিভানে। প্রমদাকান্ত বললেন, ‘আমার লেখা একটা বই তোমায় দিয়েছিলাম তোমাদের কাগজে রিভিউ করতে। মনে পড়ে তোমার?’
‘হ্যাঁ, স্যার। অনেকদিন হল। তবে বইটা আমি আমার কাছে যত্নেই রেখেছি। রিভিউ হবে।’
‘বইটা তোমার কাছে থাকতে পারে না সুবিনয়। কারণ বইটা আজ আমি ফুটপাত থেকে কিনে এনেছি। এই দেখ, আমার নিজের হাতের লেখা, শ্রীমান সুবিনয়কে সমালোচনার জন্য...’