মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
‘পৌষপার্বণের আর কত দেরি?’
—প্রশ্নকর্তার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রতিবার শীতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে অন্যতম বড় অনুষ্ঠান ছিল পৌষপার্বণ। সরলা দেবী লিখেছেন, ‘পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠে গড়া— সেটা একটা বিরাট অনুষ্ঠান...ঘরোয়া আনন্দ। ননদ-ভাজ মেয়ে-বৌরা মিলে গড়া ও বামুনে ভেজে দিলে এ-ঘর ও-ঘরে বণ্টন করা।’ পৌষ মাস ধরেই চলত পিঠে খাবার পালা। পুরনো দিনের মেয়েদের সংস্কার ছিল, সরস্বতীপুজোর পরে গোটা পিঠে খেতে নেই। অর্থাৎ পঞ্জিকা মেনেই শীতকালীন ভোজে ইতি টানা হতো সেকালে। কবি পিঠেপুলি ভীষণ ভালোবাসতেন। সেকথা জানতেনও সকলে। তাই শান্তিনিকেতনের অনেকেই নানারকম পিঠে বানিয়ে কবির কাছে পাঠাতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায়ের স্ত্রী ও পুত্রবধূ। ঠান্ডার আমেজ আসামাত্র কবিই জিজ্ঞেস করতেন নেপালবাবুকে, ‘পৌষপার্বণের আর কত দেরি?’
চিত্রা দেবের লেখা একটি প্রবন্ধে পাই, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে পৌষপার্বণ হতো বেশ বড় আকারে। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীও লিখেছেন, ‘দৈনিক বাজারে আমাদের কিছু করতে হতো না। কেবল পৌষপার্বণে রাশিকৃত পিঠে গড়তে হতো বলে লোক কম পড়লে বৌদের ডাক পড়ত।’ বেশিরভাগ হতো রাঙালুর পুলি ও সেদ্ধপিঠে। নানারকম পিঠে তৈরি করতেন পূর্ববঙ্গের মেয়ে-বউরা। ঠাকুরবাড়িতে বধূদের মধ্যে অনেকেই যশোরের কন্যা। সঙ্গে এনেছিলেন তাঁদের পারিবারিক রন্ধনশিল্প। মৃণালিনী দেবী তৈরি করতেন অনবদ্য চিঁড়ের পুলি। সৌমেন্দ্রনাথের মা, অর্থাৎ চারুবালা দেবীর হাতে তৈরি দুধপুলির স্বাদ ছিল অপূর্ব। ৫ নম্বর বাড়িতে হতো ক্ষীরপিঠে। দীপেন্দ্রনাথের ভারী পছন্দ ছিল।
পাঁচ নম্বর বাড়ির পিঠেপুলির সেদ্ধপিঠের সুনাম ছিল। চালগুঁড়োর এই পিঠেতে থাকত ক্ষীর-নারকেলের পুর। অতঃপর তা জলের ভাপে সেদ্ধ করা হতো। এহেন সেদ্ধপিঠে পাতলা নলেন গুড়ে ডুবিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সেদ্ধপিঠেটিকে দুধ ও গুড় মেশানো পাতলা ক্ষীরে ফেলেও ফের সেদ্ধ করা হতো। ওই বাড়িতে পিঠের নামও বদলে হয়েছিল ক্ষীরপিঠে। পাটিসাপটাও ভেজে রসসিক্ত করতেন গিন্নিরা। জানতেন পিঠে ঘিয়ে ভাজলেও, মুখসামলি সর্ষের তেলে না-ভাজলে মচমচে হয় না। সেইসঙ্গে হতো খেজুরগুড়ের অতি সুস্বাদু পায়েসও। এছাড়াও তাঁরা পাকাতেন কমলালেবুর পায়েস, আখের পায়েস, আতার পায়েস আর হিমকণা পায়েস।
প্রজ্ঞাসুন্দরীর পৌষপার্বণের তালিকায় এই অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য আরও সুন্দরভাবে ধরা রয়েছে। বস্তুত এসবই সেকালের অনুষ্ঠানকে সরস করে রাখত— সরুচাকলি, মুগসামলি, সেদ্ধপিঠে, ভাপাপিঠে, বাটাসাপটা, পাটিসাপটা, চিঁড়ের পুলি, রাঙালুপুলি, গোলালুর পুলি, আশকেপিঠে, চুষিপিঠে, কড়াইশুঁটির পুলি, খইয়ের পুলি, আঁদোসা, রসবড়া, গুড়পিঠে, ছানার পুলি, ক্ষীরপুলি, দুধের চুষিপিঠে, ময়দার সাপটাপুলি, গোকুলপিঠে, কচুর পিঠে, লাউয়ের পুলি।
রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গীয় একাধিক মিষ্টান্নের নাম পাল্টে দিয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশের পরিবারের মেয়েরা তাঁকে খাইয়েছিলেন ‘এলোঝোলো’। নাম শুনেই নাকসিঁটকে কবি বলেছিলেন, ‘এই সুন্দর জিনিসের এই নাম! আমি বরং এর নাম দিলাম পরিবন্ধ।’
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও ভালো রাঁধতেন। এই প্রশ্নে, মহর্ষির কন্যাদের মধ্যে সবচেয়ে সুখ্যাতি ছিল শরৎকুমারী দেবীর। দ্বিজেন্দ্রনাথের কন্যা সরোজাসুন্দরীও কৃতিত্বের পরিচয় দেন। রান্নাবান্না যাঁরা জানতেন না, উৎসাহ কম ছিল না তাঁদেরও। ইন্দিরা দেবী রাঁধতে পারতেন না, কিন্তু কোথাও কোনও নতুন পদ খেলে সযত্নে খাতায় লিখে রাখতেন তার প্রস্তুত প্রণালী। পূর্ণিমা দেবীও ঠাকুরবাড়ির রান্নার পাকপ্রণালী উপহার দিয়েছেন বাঙালি ভোজনরসিকদের। তাতেও শীতকালীন খাদ্যের বিপুল আয়োজন রয়েছে। এসব রান্নার সব ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব নয়। তৎকালীন বৃহৎ বাংলার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি থেকে সেসব বহুলাংশে সংগৃহীত। আর তার সঙ্গেই মিশেছিল ঠাকুরবাড়ির খাদ্যরসিক সদস্যদের শিল্পরুচি এবং পরিবারের মহিলাদের একাগ্র সাধনা। এসব শুধু পেট ভরাবার আয়োজন নয়, শিল্পী মনেরও খোরাক। কবি একেই ‘অনির্বচনীয়’ বলেছিলেন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রধান উৎসব ছিল ১১ মাঘের ব্রহ্মোৎসব। ব্যাপারটা বাঙালির দুর্গাপুজোর মতোই আড়ম্বরপূর্ণ। অতীতে দুর্গাপুজোর সময় যেমন সুবিশাল মিঠাই তৈরি করা হতো, অনুরূপ মিঠাই তৈরির ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ব্রহ্মোৎসবেও। মিঠাই তৈরির ভার পেয়েছিলেন কুঞ্জ নামে এক হালুইকর। খোয়াক্ষীরের সঙ্গে দরবেশের বেসন মিশিয়ে তৈরি করা হতো এই মিঠাই। খোয়া বা মেওয়ার সঙ্গে মেশানো হতো চিনি, কিশমিশ, বাদাম, পেস্তা প্রভৃতি। তার উপর থাকত সুগন্ধী তবক। মিঠাই ছিল স্বাদে গন্ধে তুলনাহীন!
মহর্ষির ব্রাহ্ম পরিবারে বাঙালির আরও একাধিক প্রিয় অনুষ্ঠান বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালিত হতো। যেমন ভাইফোঁটা, নবান্ন, পৌষপার্বণ বা পিঠেপার্বণ, বসন্তোৎসব, বাংলা বর্ষবরণ উৎসব ইত্যাদি। ঠাকুরবাড়িতে নবান্নে সৌদামিনী দেবী কাঁচাদুধে সুগন্ধী কামিনীভোগ আতপ চাল, নতুন গুড়, নারকেল প্রভৃতি দিয়ে নবান্ন তৈরি করতেন। এরপর সেসব পৌঁছে যেত প্রত্যেকের ঘরে। বস্তুত নবান্নেই থাকত পৌষপার্বণের ইন্ধন। নিত্যনতুন রান্নার আবিষ্কার ছিল ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের নেশা। তাতে মহর্ষিও যুক্ত করেছিলেন নিজেকে। এমনই একবার দেবেন্দ্রনাথ নিজের হাতে পায়েস রান্না করলেন। পরিবেশনের পর প্রশ্ন রাখলেন, ‘ভালো হয়েছে না?’ প্রায় সকলে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেও একজন মুখ ফসকে বলে ফেললেন, ‘তবে একটু ধোঁয়ার গন্ধ!’ চতুর দেবেন্দ্রনাথ উত্তরে বললেন, ‘ধোঁয়ার গন্ধ হয়েছে তো? ওইটিই আমি চাইছিলাম। পায়েসে একটু ধোঁয়াটে গন্ধই পছন্দ করি!’ আসলে, সেদিনের পায়েসটা একটু ধরে গিয়েছিল।
সবাই মিলে সাহেবদের নকল করার পরিবর্তে যাবতীয় বাঙালিয়ানার সংগ্রহ হোক, চাইতেন লীলা মজুমদার। তাঁর মতে, এগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল—মাঝিদের গান ও বাউলগানের সঙ্গে গ্রামবাংলার রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা পিঠেপুলির সুবাস। এনিয়ে অনেকের অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে রস উপভোগ করতে না-পারলে মানবজনমই বৃথা। ভালো করে পিঠেপুলি করতে জানলে কম খরচে শ্রেণি ও বয়স নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ যে আনন্দ উপভোগ করে তার তুলনা নেই।
লোককথা, উপকথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, খাঁটি স্বদেশি জিনিসের এমন নমুনা আর নেই। লীলা মজুমদারের বক্তব্য, কথাটি পিঠেপুলির বেলায়ও খাটে। পিঠেপুলির প্রস্তুতপ্রণালী এবং সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পিঠেপুলির জন্য মন তৈরিরও একটা সময় আসে। বাংলার প্রকৃতিই বাঙালির সেই মন গড়ে দেয়। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, আমরা ছোটবেলায় দেখতাম ঠাকুমা, জ্যাঠাইমা, পিসিমারা নতুন গুড়ের জন্য এইসময়ে মুখিয়ে আছেন। দেশের বাড়িতে নারকেল পাড়া হয়ে নানাস্থানে পৌঁছে গিয়েছে। আমার পিঠেপুলির নিয়মে বেশ একটু বাংলাদেশি ভাব আছে এবং একশোবার বলব যে গুণটা ১০০ গুণ বেড়েছে।
গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি জিনিস দুষ্প্রাপ্য বা খুব দামি নয়। প্রধান উপকরণ খেজুরগুড়, নারকেল, চালগুঁড়ো, সুজি, মুগ বা কড়াই ডাল, ঘন দুধ, খোয়াক্ষীর, এলাচ, কর্পূর ইত্যাদি। দুধকে তখনও খুব দামি জিনিস ভাবা হতো না। টাকায় পাঁচ-সাত সের পর্যন্ত দুধ মিলত। মানুষের বিশ্বাস ছিল, কালো গোরুর দুধ নাকি অমৃতের মতো মিষ্টি। লাল গোরুর দুধ খেতে ভালো হলেও যারা খায় তারা নাকি বদমেজাজি হয়ে যায়! মহর্ষি পছন্দ করতেন মিষ্টি স্বাদের দুধ। অবন ঠাকুর এক জায়গায় লিখেছেন মহর্ষির জন্য গোরুদের গুড় খাইয়ে মিষ্টি দুধ পাওয়ার কথা। ছোটবেলায় ভঁইসা ঘিতে রান্না প্রচলন ছিল। কিন্তু বাঙালির হেঁশেলে পিঠেপুলির জন্য নির্দিষ্ট ছিল কেবল গোরুর দুধ।
তখনকার দিনে ফ্রিজ বলে কিছু ছিল না। তাই, পিঠেপুলি দিনকয়েক রেখে খাওয়ার উপযোগী করেই তৈরি হতো উপকরণগুলো। এজন্য পিঠেপুলিতে পাতলা রসের ব্যবহার বারণ ছিল। তাতে আরও একটা সুবিধা ছিল এই—দূরে দূরে আত্মীয়বাড়িতে স্বচ্ছন্দে পাঠানো যেত। তখন যাতায়াত বলতে ছিল গোরুর গাড়ি, নৌকো আর রেলগাড়ি। পৌষপার্বণের ষোলোকলা পূর্ণ করতে পিঠেপুলির সঙ্গেই আয়োজন হতো সুস্বাদু পায়েসেরও। নকশা-ছাঁচে নরুন দিয়ে গাওয়া ঘি মাখিয়ে, ক্ষীরের পাক থেকে একধরনের মিষ্টান্ন তৈরির কথা শুনিয়েছেন লীলা মজুমদার। পৌষপার্বণে প্রস্তুত এই মিষ্টান্নকে তিনি পিঠেপুলির তালিকা থেকে বাদ দিতে নারাজ। নারকেল-চিঁড়ের একটা আইটেমকে তিনি পিঠেপুলির বন্ধনীতে রেখেছেন তার যাবতীয় গুণ বিচার করে। লীলা মজুমদার আরও একটি কম পরিচিত মিষ্টান্নের কথা বলেছেন—‘ইচামুড়াই’। নারকেলের গা থেকে কালো পর্দাটা প্রথমে চেঁছে ফেলতে হবে। তারপর কুচোতে হবে দেশলাই কাঠির মতো করে। সেগুলো ফেলতে হবে খোয়াক্ষীরের মতো ঘন হয়ে আসা দুধে। শেষকালে গাওয়া ঘি মাখিয়ে থালায় সাজিয়ে রাখলে দেখতে অবিকল চিংড়ির মুন্ডু! তার উপর এলাচগুঁড়ো ছড়িয়ে দিলে পাগল করা স্বাদ!
লীলা দেবীর বড়দি সুখলতা রায়ের শ্বশুরবাড়ি ছিল ওড়িশায়। আশকেপিঠের জন্ম নাকি সেখানে। আতপ চালের সঙ্গে সিকি পরিমাণ সাদা কলাই ঘণ্টাখানেক ভিজিয়ে রেখে বাটতে হয়। তারপর সেটা দুধে কিংবা জলে গুলে নিতে হবে। জিনিসটা হবে পোরে ভাজার গোলার মতো ঘন। তারপর একটা ঝকককে চাটু উনুনে গরম করে তার মধ্যিখানে ঢেলে দিতে হবে ছোট একহাতা গোলা। অতঃপর একটা কাঁসার গেলাস চাপা দিয়ে গেলাসের বাইরে দু’হাতা জল ঢালতে হবে। অমনি সবটা বুড়বুড় করে ফুটে উঠবে। তখন ন্যাকড়া দিয়ে গেলাস তুলতেই দেখা যাবে পিঠেটা কেমন ফুরফুর করছে। খুন্তি দিয়ে উল্টে দিতে হবে গেলাস চাপা। সামান্য একটু জল ঢালতেই রেডি অন্য পিঠটাও। সঙ্গে সঙ্গে চাটু নামিয়ে আশকেপিঠেটা থালায় তুলে ভাজা যাবে পরেরটা। সুখলতা দেবীর এক বুড়ি ননদকে এরকম তিরিশটা আশকেপিঠে ভেজে একটা থালায় পদ্মফুলের মতোই সাজিয়ে রাখতে দেখেছিলেন লীলা দেবী। এই পিঠে খেতে হয় নলেন গুড়/চিনির রস মাখিয়ে।
পাশ্চাত্যের কেককেই অনেকে আমাদের দেশের পিঠের সঙ্গে তুলনা করেন। তবে নিখাদ পিঠে জাতীয় খাবার ঠিক কাদের অবদান তা আজও অজ্ঞাত। এনিয়ে রয়েছে নানা মত। ১৩৩২ বঙ্গাব্দে উত্তর কলকাতায় ‘উত্তরায়ণ সাংস্কৃতিক সংস্থা’র বার্ষিক সাধারণ সভায় দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মশায় ‘পিষ্টকপরিচয়’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। পিঠের মতোই রসে ঠাসা ওই লেখায় তিনি জানিয়েছেন, পিঠে বস্তুত বৈদিক যুগের খাবার। তখন অবশ্য গোধূম বা যব থেকে তৈরি করা হতো। চালের পিঠের জন্মকাল ঋগ্বেদের পরবর্তী যুগ। সেই হিসেবে যিশু খ্রিস্টের জন্মের অন্তত দেড় হাজার বছর আগেই ভারতবাসী পিঠে (পুরোডাশ বা পিষ্টক) খাওয়ার মজা নিতে শুরু করেছে। বালগঙ্গাধর তিলকসহ সেকালের কয়েকজন পণ্ডিতের মতে অবশ্য পিঠের জন্মভূমি সুমেরু পার্বত্য অঞ্চল। আবার কারও কারও মতে, পিঠের প্রচলন হয়েছিল কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী অঞ্চলে। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের অনুমান, ধনধান্যপুষ্পভরা প্রাচ্যদেশই পিঠের পিতৃভূমি। স্বয়ং বিশ্বকর্মাই নাকি পিঠের সৃষ্টিকর্তা। শাস্ত্রী মশায়ের মতে, শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য নামের মতো পিঠেও প্রাচীনকালে অগুনতি নামের হতো—পূপ, অপূপ, আপূপিক, পিষ্ট, পুরোডাশ, পর্পট, শজ্জুলি, ক্ষেণক, লড্ডুর, ঘৃতপুর, মধুমস্তক প্রভৃতি।
প্রাচীন শাস্ত্রকারগণ পিঠের পুষ্টিগুণ নিয়েও চর্চা করেছেন। তাঁদের রায়, ‘শালি পিষ্টাবতারে কথা ও পিত্তনাশক, স্নেহসিক্তাবতারে গুরু, হৃদ্য এবং বলোপচয়বর্ধক।’ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বলেছে, ‘অন্নাদষ্ট গুণং পিষ্টম্’। প্রাচীনকালে পুরোডাশ ছাড়া কোনও ইষ্টি হতো না। পশুযাগেও পশুর মাংসের সঙ্গে পুরোডাশ আহুতি দেওয়া হতো। স্মৃতির যুগেও পুরোডাশের প্রভাব কমেনি। পিতৃপুরুষের জন্য অপূপাষ্টকা শ্রাদ্ধে শুধুমাত্র পিষ্টক নিবেদন করার প্রথা ছিল। পুরাণেও পিঠের প্রতিপত্তি স্বীকার করা হয়েছে। ললিতা, সপ্তমী, দুর্বাষ্টমী, তালনবমী, অনন্তচতুর্দশী প্রভৃতির কোনওটাই পিঠে বিনে সম্পন্ন হয় না। একালের বাউল, বৈষ্ণবরাও পিঠেকে উচ্চস্থান দিয়েছেন। পিঠে জাতীয় মিষ্টি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণেরও বিশেষ প্রিয় ছিল। শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে শ্রীকৃষ্ণকে পিঠেভোগ দেওয়ার বিধানের উল্লেখ আছে। ক্ষীর, ঘি ও মিষ্টিরসের গোকুলপিঠে নাকি তাঁরই নামে। মীরাবাই কৃষ্ণপুজোয় গোকুলপিঠে উৎসর্গ করতেন।
পুণ্য পুরাণ, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কাব্য আর বৈষ্ণব সাহিত্যে নারকেল কোরা নতুন গুড় ও অন্যান্য পুরে প্রস্তুত সাদাপুলি, পায়েসপুলি, ক্ষীরপুলি, ডালের পুলি, সরুচাকলি প্রভৃতির বিবরণ রয়েছে। পরে পৌষসংক্রান্তিতে বহু বাড়িতে এসব হয়ে থাকে। পূর্ববঙ্গ এবং রাঢ়বঙ্গ দু’দিকেই কিছু ধনী ব্যক্তির বাড়িতে এখনও বেশ ঘটা করে পিঠেপুলি বানানো হয়। এই প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গিয়ে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ‘শীতের বিলাস’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বাগবাজারের প্রখ্যাত দাশ পরিবারের কথা। ‘রসগোল্লার কলম্বাস’ নবীন দাশের নাতি সারদা দাশমশাই পৌষপার্বণে বিশ-তিরিশ রকমের পিঠেপুলি করে প্রিয়জনদের খাওয়াতেন।
পিঠের আসল মজা হল খেজুর রসে। এর উৎস যদিও কাঠখোট্টা কিছু খেজুর গাছ। গুপ্ত কবি যথার্থই বলেছেন, ‘হায় রে শিশির তোর কি লিখিব যশ।/ কালগুণে অপরূপ কাঠে হয় রস।/ পরিপূর্ণ সুধাবিন্দু খেজুরের কাঠে।/ কাঠ কেটে উঠে রস যত কাঠ কাটে।/ দেবের দুর্লভ ধন জীবনের ঘড়া।/ এক বিন্দু রস খেলে বেঁচে ওঠে মড়া!’ ঈশ্বর গুপ্তের আমলেই ইংরেজরা খেজুর রসের উপর ‘ট্যাকশো’ বসিয়েছিল। প্রতিবাদে কবি লিখেছিলেন, ‘আমাদের ভাগ্য দোষে মিছে করি দ্বেষ।/ বিজাতীয় রাজা হয়ে নষ্ট করে দেশ।/ লোভকারী আবকারী যুক্ত করি কর।/ এমন খেজুর রসে বসাইল কর।/ মাশুল উশুল করে রসের গুড়ে।/ পরে বুঝি গঙ্গাজলে কর দেবে জুড়ে।’
দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনে কলকাতাসহ গোটা বঙ্গদেশে কেক-পেস্ট্রির প্রচলন যথেষ্ট হয়েছে। ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার উদ্যাপনে সাহেব-মেমরা কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও জায়গার কথা ভাবতেই পারতেন না। কলকাতাই হয়ে উঠেছিল ‘হাফ বিলেত’।
স্বাধীন ভারতও সেসব থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি, বিশ্বায়নের যুগে ওই সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে বরং উত্তরোত্তর। তবু হারায়নি পিঠেপুলির সংস্কৃতি। বরং গত দু’দশকে পিঠেপুলি বাণিজ্যিক চেহারাও নিয়েছে। বহু মিষ্টান্ন বিক্রেতা মিষ্টির পাশাপাশি এইসময় পিঠেপুলিও তাদের শো-কেসে সাজিয়ে রাখেন। কলকাতা মহানগরে এবং জেলায় জেলায় হয় পিঠেপুলি উৎসব। তা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের বিপুল উৎসাহ বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য অবশ্যই এক সুখবর। পিঠেপুলি উৎসব ওপার বাংলাতেও হচ্ছে মহাসমারোহে। তাই আজও গ্রামাঞ্চলে পৌষের জন্য জেগে থাকে প্রাণের আকুতি, ‘পৌষ এল গুড়িগুড়ি/ পৌষের মাথায় চালের গুঁড়ি/ এস গো পৌষ যেও না/ জন্ম জন্ম ছেড়ো না।’ সব মিলিয়ে মানতেই হয়, ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবুও রঙ্গে ভরা।’