মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তখন নিঃশব্দে বেজে চলেছে লীলা সংবরণের সুর। বেদনার সেই অশ্রুত সুর শুনেছিলেন মা সারদাও। তিনি বুঝতে পারছিলেন ঠাকুরের ইহলীলা অবসানের আর দেরি নেই। ভক্তরাও বুঝতে পারছিলেন। অসুস্থতা দিন দিন বাড়ছিল। সেই সময় জীবনের শেষ কয়েকটা মাস ঠাকুর কাটিয়েছিলেন কাশীপুর উদ্যানবাটিতে।
কাশীপুরের উদ্যানবাটিতে মা ও ভক্তরা অসুস্থ ঠাকুরের সেবা করে চলেছেন। দীর্ঘদিন ধরে ঠাকুর ভুগছেন গলার কর্কট রোগে। চিকিৎসা করছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। ঠাকুরকে নিরিবিলিতে রাখার জন্য ভক্তরা তাঁকে নিয়ে গেলেন শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। সেখানে গোকুলচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়ি ভাড়া করা হল। কিন্তু সেই বদ্ধ ঘরে ঠাকুরের যেন দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। একে বদ্ধ পরিবেশ, তার উপর মা সারদাও তখন কাছে নেই। ঠাকুর যেন শিশুর মতো হয়ে যাচ্ছিলেন। চঞ্চল ঠাকুরকে সামলাতে আনা হল মা সারদাকে। রোগ যন্ত্রণার মধ্যেও ঠাকুরের মুখে হাসি ফুটল। মা সারদা প্রতিদিন যত্ন করে রান্না করে ভুলিয়েভালিয়ে খাওয়াতেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। ওষুধ, পথ্য সব নিয়ম মেনে চললেও ঠাকুরের রোগ সারছিল না। তখন ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, একটু খোলামেলা জায়গায় ঠাকুরকে নিয়ে গিয়ে রাখা হোক।
ভক্তরা তখন কাশীপুরে গোপালচন্দ্র ঘোষের উদ্যানবাটিটি মাসিক আশি টাকায় ভাড়া নিলেন। কিন্তু এত টাকা দেবেন কে? এগিয়ে এলেন ডাঃ রামচন্দ্র দত্ত। তিনিই উদ্যানবাটির ভাড়ার টাকাটা দিতেন। ঠাকুরকে সেখানে আনা হয় ১৮৮৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। এই বাড়ির দোতলায় থাকতেন ঠাকুর। খোলামেলা জায়গায় এসে ঠাকুরও যেন বদ্ধ খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা মুক্ত হলেন। মা সারদা প্রতিদিন নরম করে ভাত রান্না করতেন। দুধ ঘন করে জ্বাল দিতেন। কোনও কোনওদিন সুজি বা পায়েস রান্না করে ঠাকুরকে খাওয়াতেন। অসুস্থ ঠাকুরের মাথাটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে একটু একটু করে খাওয়াতেন। ঠাকুর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন মায়ের দিকে। মায়ের চোখে কষ্টের ছায়া দেখতে পেয়ে ঠাকুর বলতেন, ‘কী ভাবছ? বুঝেছি, ভাবছ আমি চলে গেলে তুমিও চলে যাবে? তা হবে না। কত লোক কষ্টে আছে। তুমি তাদের দেখবে। ঈশ্বরকে ডাকতে শেখাবে। তুমি আমার বাকি কাজ পূর্ণ করবে।’
এইরকম অসুস্থতার মধ্যে, কষ্টের মধ্যে ঠাকুর যেদিন কিছুটা সুস্থ বোধ করতেন, সেদিন একটু বাইরে এসে ঘোরাঘুরি করতেন। বাইরে প্রতিদিন তাঁর ভক্তের দল অপেক্ষা করতেন। তাঁরা অধীর আগ্রহে থাকতেন ঠাকুরের কুশল সংবাদ জানার জন্য। সেদিন ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। বাংলার ১৮ পৌষ, ১২৯২। সেদিন কৃষ্ণা একাদশী তিথি। বেশ কয়েকদিন ভারী অসুস্থতার পর ঠাকুরের শরীরটা সেদিন একটু ভালো। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিলেন। বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তাঁর সঙ্গে থাকা দুই শিষ্য লাটু মহারাজ ও শরৎ মহারাজ। তখন বিকেল তিনটে বেজেছে। শীতের পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে পড়েছে উদ্যানবাটির গাছের পাতায়। সেখানে তখন বসে আছেন ঠাকুরের অন্তত ৩০ জন গৃহী ভক্ত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গিরিশ ঘোষ, মাস্টারমশাই শ্রীম, দেবেন্দ্র মজুমদার, উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, হরমোহন মিত্র, অতুলচন্দ্র ঘোষ, নবগোপাল ঘোষ, বৈকুণ্ঠ সান্যাল, কিশোরীমোহন গুপ্ত, অক্ষয়কুমার সেন প্রমুখ। কেউ বসেছিলেন হলঘরে, কেউবা বাগানে। তাঁরা ঠাকুরের স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ঠাকুরের স্বাস্থ্যের অবনতিতে তাঁরা বিমর্ষ।
সেদিন একটু সুস্থ বোধ করায় ঠাকুরের মনে হল, একটু বাইরে বেরিয়ে আসবেন। সেই কথা তিনি ভাইপো রামলালকে বললেন। রামলাল তাঁকে শীত পোশাক পরিয়ে দেওয়ার পর তিনি ঘরের বাইরে এসে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলেন। পরনে তাঁর লালপেড়ে ধুতি, সবুজ রঙের পিরান। গায়ে লালপাড় মোটা চাদর, সবুজ রঙের কানঢাকা টুপি, পায়ে মোজা ও লতাপাতা আঁকা চটিজুতো। হাতে একটি ছড়ি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রামলালও। তাঁর হাতে ছিল গাড়ু ও গামছা। ঠাকুর বাইরে এসে সুরকি পথ ধরে ধীরে ধরে হাঁটতে লাগলেন। ওদিকে ঠাকুর বেরিয়ে আসায় সেই সুযোগে লাটু মহারাজ ও শরৎ মহারাজ ঠাকুরের বিছানা পরিষ্কার করতে লাগলেন।
ঠাকুরকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন গিরিশ ঘোষ। সে যেন ঠাকুরের এক দিব্যরূপ। মন তাঁর পূর্ণ হয়ে গেল আনন্দে। সেই অনুভবের কথা তিনি লিখে গিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এক আলোকময় পুরুষ যেন হেঁটে আসছেন। এক অদৃশ্য আলোকবলয় ঘিরে রয়েছে তাঁকে। যে গিরিশ তাঁকে বারবার বলেছেন, ‘অবতার’, আজ যেন পরোক্ষে সেই অবতারের রূপ উন্মোচিত। ঠাকুরের মুখে মিষ্টি হাসি। দু’চোখ ভরে তাঁকে দেখতে লাগলেন ভক্তরা। উপস্থিত অক্ষয়কুমার সেন ঠাকুরের সেদিনের সেই রূপের বর্ণনা করেছেন। সেই কান্তিরূপ যেন ‘রূপের পুতলি’। ভক্তরা ছুটে গিয়ে আনত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন।
ঠাকুর গিরিশের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘কী হে গিরিশ, তুমি যে লোকের কাছে আমার সম্পর্কে এত কথা বলে বেড়াও, তা বাপু, তুমি আমার সম্পর্কে সত্যিই কী বুঝেছ, বল তো?’
গিরিশ ঘোষ বললেন, ‘কী আর বলব ঠাকুর, ব্যাস, বাল্মীকি যাঁর সম্পর্কে ইয়ত্তা করতে পারেননি, সেখানে আমি আর তোমার সম্পর্কে কীই বা বলতে পারি!’
একথা শুনতে শুনতে ঠাকুরের মধ্যে ভাবসমাধি দেখা গেল। সমস্ত শরীর তাঁর রোমাঞ্চিত, নিস্পন্দ। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক দিব্য হাসি। দেবত্বের মহিমা সেই মুহূর্তে পূর্ণরূপে প্রতিভাত হল। সে যেন এক পরম ব্রহ্মের প্রকাশ। কাশীপুর উদ্যানবাটির আমগাছের তলায় দিনাবসানের পবিত্র মুহূর্তে তাঁর সেই অবতার রূপ দেখে সকলের চোখ জুড়িয়ে গেল। গিরিশ ঘোষ সকলকে ডাক দিলেন, ‘সবাই এসো গো। ঠাকুর কল্পতরু হয়েছেন।’ ভক্তরা আশপাশ থেকে গাছের ফুল, পাতা তুলে এনে ঠাকুরের চরণে দিলেন। সকলে তাঁর আশীর্বাদ কামনা করলেন। ঠাকুরের ভাবসমাধি চলল কিছুক্ষণ। তারপর তিনি ফিরলেন অর্ধবাহ্য অবস্থায়। সেই অবস্থায় তিনি ডান হাত দিয়ে সকলকে স্পর্শ করে সহাস্য বদনে অস্ফুটে শুধু বলতে লাগলেন, ‘কী আর বলব, আশীর্বাদ করি, তোমাদের সকলের চৈতন্য হোক, তোমাদের চৈতন্য হোক।’
প্রথমে গিরিশ ঘোষ এবং পরে উপস্থিত ভক্তরা সমস্বরে উদ্বেলিত আনন্দে বলে উঠলেন, ‘জয় শ্রীরামকৃষ্ণ, জয় শ্রীরামকৃষ্ণ।’ ঠাকুরের স্পর্শে যেন তাঁদের অন্তরের সব মালিন্য দূর হয়ে গিয়েছে। যেন এক নতুন দিব্য মন তাঁদের হৃদয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তারই আবেগে কেউ কেঁদে উঠলেন হাউহাউ করে, কেউ আনন্দে হেসে উঠলেন, আবার কেউ ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলেন। কেউ বাকরুদ্ধ অবস্থায় ঠাকুরের সেই দিব্যমূর্তি দর্শন করতে লাগলেন। ঠাকুর কারও মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, কারও বুকে হাত বুলিয়ে দিলেন, কারও মাথা তিনি পা দিয়ে স্পর্শ করলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে রচিত হল স্বর্গের পরিবেশ।
এ যেন ঠাকুরের এক লীলা। মর্তধামে নেমে এসে অজ্ঞানতার আলোকে নিমজ্জমান মানুষের মনে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে তোলার লীলা। সেই লীলা ভক্তের সঙ্গে প্রেমের লীলা। ‘তাই তো প্রভু, হেথায় এলে নেমে, তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে।’ অচেতন মানুষের, কূপমণ্ডুক মানুষের মনের ভিতরে চৈতন্য প্রবাহের মধ্যে দিয়ে প্রেমকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস। প্রেম বিনে তো জগৎ মিছে। এখানে একে অপরকে ভালোবাসতে না পারলে, অন্যের কল্যাণ ভাবনায় নিজেকে সমর্পিত না করতে পারলে জীবজগৎ বাঁচে না। সেই বাণীই সেদিন চৈতন্যের বরদানের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ঈশ্বরের দিকে আমাদের প্রতিদিনের এই এগিয়ে চলার নামই সাধনা, মানসভূমির চৈতন্য থেকেই উৎসারিত সেই অনন্ত আকুতি।
ঠাকুরের সেই অবতার রূপে আত্মপ্রকাশের দিনটি আজও পালিত হয়ে আসছে ‘কল্পতরু দিবস’ হিসাবে। সেই উৎসবে যেমন শামিল হন সন্ন্যাসীরা, তেমনই শামিল হন ভক্তরাও। বাঙালি সেদিন ঠাকুরের চরণে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে ব্রহ্ম-স্বরূপের আভাসকে উপলব্ধি করতে চান। তাই কাশীপুর উদ্যানবাটিই শুধু নয়, দক্ষিণেশ্বর সহ মঠ ও মিশনের সর্বত্র এই উৎসব পালন করে আমরা ঠাকুরের কৃপালাভের চেষ্টা করি।
এই যে ঠাকুর কল্পতরু হলেন, সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে অসুস্থ শরীরে নেমে এলেন ভক্তদের কাছে— প্রশ্ন জাগে, আসলে ‘কল্পতরু’ কী? কেন ঠাকুরের সেই কল্পতরু হয়ে ওঠা? এর পিছনে রয়েছে পুরাণের এক গল্প। সমুদ্র মন্থনে উত্থিত এক শক্তিশালী বৃক্ষই হল কল্পতরু। কল্পান্তে সেই বৃক্ষ ফের সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছিল। সেই কল্পতরু মানুষের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে। তার কাছে কিছু চাইলে নিমেষে প্রাপ্তি ঘটে। হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধদের পুরাণে এই অলৌকিক বৃক্ষের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার অনেকগুলি নাম আছে। হিন্দু পুরাণে তাকে বলা হয় মন্দনা, পারিজাত, পারিভাদ্র, সন্তান, কল্পবৃক্ষ, কল্পপাদপ, হরিচন্দন প্রভৃতি। ভাগবত, অগ্নিপুরাণ, গার্গ সংহিতা সহ বৈষ্ণব শাস্ত্রেও আমরা কল্পতরুর উল্লেখ পাই। পুরাণে শিবকে ‘কল্পতরু’ রূপে আরাধনা করার প্রমাণ মেলে। রামপ্রসাদ সেনের গানেও ‘কালী-কল্পতরু’ কথাটির উল্লেখ রয়েছে। আসলে ঈশ্বরকেই আমরা কল্পতরু রূপে কল্পনা করি। তাঁর দয়ায় ও আশীর্বাদে আমাদের সর্বপ্রাপ্তি ঘটতে পারে। জৈন পুরাণে এই গাছ আমাদের সব ইচ্ছে মিটিয়ে দেয়। যেমন মধ্যাঙ্গ বৃক্ষ থেকে পাওয়া যায় সুস্বাদু ও পুষ্টিকর পানীয়। ভোজনাঙ্গ বৃক্ষ আমাদের দান করে সুস্বাদু খাবার, জ্যোতিরাঙ্গ বৃক্ষ আমাদের দেয় উজ্জ্বল আলো, দোপাঙ্গ এবং অন্যান্য এই ধরনের বৃক্ষ আমাদের পুষ্প, সুঘ্রাণ, পোশাক, সঙ্গীত ইত্যাদি দান করে।
সেদিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও সেই রকম কল্পবৃক্ষ হয়ে তাঁর গৃহী ভক্তদের মধ্যে আনন্দ বিতরণ করেছিলেন, আলোক বিতরণ করেছিলেন, চৈতন্য বিতরণ করেছিলেন। সকল ভক্ত তাঁর কাছে একে একে সেদিন অনেক কিছু চেয়েছিলেন। তাঁদের ভক্তি, মোক্ষ, বাসনার আকুতি তিনি মিটিয়ে দিয়েছিলেন।
ঠাকুর বিভিন্ন সময়ে তাঁর ভক্তদের যেসব গল্প বলতেন, তার মধ্যেও বেশ কয়েকবার তিনি কল্পতরুর উপমা এনেছেন। সেকথা আমরা পাই ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ গ্রন্থে। বাগবাজারের নন্দলাল বসু একদিন মৃত্যুকালে ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে ঠাকুরকে প্রশ্ন করেন। ঠাকুর তাঁকে বলেন, ‘কল্পতরুর কাছে গিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। তবে ফল পাওয়া যায়। তবে ফল যখন তরুর মূলে পড়ে, তখন কুড়িয়ে লওয়া যায়। চারি ফল ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। জ্ঞানীরা মুক্তি চায়। ভক্তেরা ভক্তি চায়। —অহেতুকী ভক্তি। তারা ধর্ম অর্থ কাম চায় না।’
আর একবার তিনি এক পণ্ডিতকে বলেছিলেন, ‘প্রার্থনা কর। তিনি দয়াময়। তিনি কি ভক্তের কথা শুনেন না? তিনি কল্পতরু। তাঁর কাছে গিয়ে যে যা চাইবে, তাই পাবে।’
ঠাকুর শুধু মুখেই কল্পতরুর গল্প ভক্তদের বলেননি, তিনি সেই কল্পতরু হয়ে তাঁদের কৃপাও করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে দিয়ে সমগ্র মানব সমাজের অন্তরে চৈতন্যের দীপ্তিপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের এতদিন পরেও আমরা বুঝতে পারি, মানব সভ্যতার আজ সত্যিই চৈতন্যের প্রয়োজন। প্রতিদিন আমরা অন্তরের যে অন্ধ কারার মধ্যে নির্বাসিত হচ্ছি, সেখানে চৈতন্যের আলো দরকার। শুধু কল্পতরুর উৎসবে যোগদান করে তাঁর পাদপদ্মে ফুল দিলেই হবে না। তাঁর শিক্ষাকেও আত্মস্থ করা দরকার। নতুন করে আলো জ্বালানোর সময় এসেছে। সেখানেই কল্পতরু উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা।
ঠাকুরের প্রয়াণের অনেক পরে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘জ্ঞানযোগ’ বইতে লিখলেন, ‘অবতারগণ স্পর্শ করিয়া লোকের চৈতন্য সম্পাদন করেন। তাঁহাদের স্পর্শে যাহারা দুরাচার, তাঁহারা পরম সাধু হইয়া যায়েন।... ঈশ্বরই অবতাররূপে আমাদের কাছে আইসেন। যদি ঈশ্বর দর্শন করিতে আমরা চাই, তাহা হইলে অবতার পুরুষের মধ্যেই তাঁহাকে দর্শন করিব। তাঁহাদিগকে পূজা না করিয়া থাকিতে পারিব না।’
বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছেন, অবতার হলেন এক বড় প্রদীপের মতো, যা ভক্তের মনের অন্ধকার দূর করে তাকে আলোকিত করেন। অচেতনের মধ্যে তিনি নিয়ে আসেন চৈতন্যের অনন্ত প্রবাহ। ছোট আমি থেকে বড় আমিতে উত্তরণই তো সেই চৈতন্যের চিহ্ন। এ এক আধ্যাত্মিক উত্তরণ। অন্তরে তখন যেন জ্বলে ওঠে আলোকমালা। কবিগুরুর কথায় ‘লক্ষ শিখায় জ্বলবে যখন দীপ্ত প্রদীপ অন্ধকারে।’ কল্পতরু উৎসব হল অন্তরে সেই আলো জ্বালানোর উৎসব।