মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
পড়ন্ত দ্বিপ্রহরে গভীর জঙ্গলের মধ্যিখানে ভারী অসহায় দৃষ্টি মেলে প্রশ্নটা শুধিয়ে বসে নয়ন। একরাশ প্রত্যাশা ছিল ওই দৃষ্টিতে। নয়নের ওই প্রত্যাশা-মাখানো দৃষ্টিটাই মতিলাল বাউরিকে যারপরনাই বিপন্ন করে তোলে।
আসলে, বাড়ির পুরনো মাইন্দার হলে কী হবে, মতিলাল বাউরি তো নয়নদের গোটা পরিবারের কাছে আপনজনেরও বাড়া। ওরই কোলেপিঠে বেড়ে ওঠা। নয়ন তো ছেলেবেলা থেকে ওকে আপন কাকা বই কিছু ভাবতেই পারে না। সেই জ্ঞান হওয়া থেকে তো দেখছে লোকটাকে। নয়নদের পরিবারের বিপদে-আপদে দু’চোখে আপনজনের চেয়েও অধিক আশঙ্কা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বারবার। বাড়ির লোকজন থমকে যায়, কিন্তু মতিলাল বাউরি হাল ছাড়ে না। তখন ওকে দেখে কে বলবে যে, লোকটা নয়নদের বাড়িতে স্রেফ সংবৎসরের মাইন্দার বই কিছু নয় এবং জাতে বাউরি হওয়ার কারণে, নয়নদের মতো ভট্চাজ-বাড়ির অন্দরমহলে তার প্রবেশাধিকার পর্যন্ত নেই। ওই বাড়ির কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্তর পর্যন্ত ছোঁয়াছুঁয়ি বারণ।
নিজে পুরোপুরি নিরক্ষর হলেও মানুষটি মনেপ্রাণে চেয়েছে, নয়ন পড়েশুনে মহা-দিগগজ হোক। সম্ভবত সেই কারণেই, একেবারে শিশুকাল থেকেই, সুযোগটি পাওয়ামাত্র, ঠিক বাচ্চাকে মোয়ার লোভ দেখানোর ভঙ্গিতে বলত, ‘তুয়াকে কিন্তু মন দিয়ে লিখাপড়া কইরতে হব্যেক বাপ। অনেক ...অনেক লিখাপড়া শিখ্যে, দিগগজ হইয়্যেঁ, এই দোনিয়ায় পাঁচজনা’র একজন হইয়্যেঁ উঠতে হব্যেক।’
এভাবেই নয়নের গোটা শৈশব-কৈশোর জুড়ে সুযোগ পেলেই লোকটা নয়নের বুকের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজটি পুঁতে দিতে চেয়েছে বারংবার।
মাধ্যমিক পরীক্ষার তখন মাস তিনেক বাকি। আচমকা প্রবল জ্বরে পড়ল নয়ন। ডাক্তার-কোবরেজ, হোমিও-অ্যালো, কোনও-কিছুতেই যখন ছাড়ছিল না সেই জ্বর, তখন মতিলালই পরামর্শ দিয়েছিল নয়নের মাকে, কি না, চিকিচ্ছা যেমনটি চইলছে, চলুক। ওইসঙ্গে ভালুকডিহির বাবা-কালুয়াষাঁড়ের নামে একটা মানত কর বউদিমণি। এক্কেরে জাগ্রত ঠাকুর। দু’দিনেই নয়নের জ্বর ছেইড়ে যাব্যেক।
কোথায় ভালুকডিহি গাঁ, সত্যি সত্যি সেখানে কোনও কালুয়াষাঁড়ের থান রয়েছে কি না, থাকলেও কতখানি জাগ্রত সেই ঠাকুর, এসবের কিছুই জানা ছিল না কারওরই। কিন্তু যেহেতু পরামর্শটা দিয়েছে খোদ মতিলাল বাউরি, কাজেই নয়নের মা সুলতা তৎক্ষণাৎ সদর-পুকুরে তিন ডুব দিয়ে ভিজে কাপড়ে মানত করে ফেললেন ওই অজানা ঠাকুরের কাছে।
ওষুধপত্তর খেয়ে জ্বর তো ছেড়ে গেল দু’দিনেই। মাধ্যমিক পরীক্ষাও ভালো মতো দিল নয়ন। পরীক্ষান্তে, একটি শনিবার দেখে, ব্রাহ্মমুহূর্তে কাকা-ভাইপোতে রওনা দিয়েছিল কালুয়াষাঁড়ের থানে।
দুই
উপস্থিত, নয়নের প্রশ্নটা যারপরনাই বিপন্ন করে তোলে মতিলাল বাউরিকে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝি নয়নের প্রশ্নেরই জবাব খুঁজে বেড়ায় সে।
বাস্তবিক, সকাল থেকেই তো ওরা তিনজনেই ছিল অভুক্ত। নয়ন আর মতিলাল বাউরি তো বটেই, সঙ্গে ছিল তৃতীয় প্রাণীটিও। ডাগর একটি ষাঁড়া-মোরগ। মোরগটা আজ ব্রাহ্মমুহূর্তেও নয়নদের বাড়ির সদর-কুঠুরিতে ময়ূরকণ্ঠী গলা ফুলিয়ে বারংবার ডাক পেড়েছিল সম্ভবত নয়নের মায়ের উদ্দেশে, কি না, ‘উঠ না রে...বউ...।’
একসময় নয়ন আর মতিলাল বাউরির সঙ্গী হয়েছিল সে। সেও ছিল অভুক্ত। এই যাত্রায় তারও কিছু কম ভূমিকা ছিল না। দু’দিনের মধ্যে নয়নের জ্বর সারিয়ে দেবার জন্য বাবা-কালুয়াষাঁড়ের উদ্দেশে মানত-শোধের নৈবেদ্য ছিল সে।
তো, সাকুল্যে তিনটি প্রাণী বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সেই ভোরে। বাসে চেপে রানিবাঁধ পর্যন্ত।
রানিবাঁধ বাজারে মতিলাল কিনে নিয়েছিল এক বোতল মহুয়া। তারপরই ওরা ধরেছিল জঙ্গলের পথ। সেই জঙ্গল ক্রমশ গভীর হতে হতে দুর্ভেদ্য হয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে বনবাসী শবরদের পর্ণকুটিরগুলোর হতদরিদ্র ছবি হয়ে ফুটে উঠছিল মাঝেমাঝেই।
কালুয়াষাঁড়ের থানে যখন পৌঁছল তিনটি প্রাণী, সূয্যিদেব তখন মাথার ওপর।
প্রাচীন মহুল গাছের গুঁড়িতে ঠেসানো একটি বিশাল আকারের মাকড়া-পাথরের চাঙড়। শরীরে দীর্ঘকাল রক্ত মেখে মেখে এখন কুচকুচে কালো রং ধারণ করেছেন। তাতেই নাম কালোষাঁড়। অপভ্রংশে কালুয়াষাঁড়।
পূজারিটি জাতে শবর। নাম, পুশুপতি। অল্প দূরে শবরদের একটি ছোট্ট পল্লিতেই থাকে সে ।
মতিলালদের দেখামাত্র মহা উৎসাহে এগিয়ে আসে পুশুপতি। তোবড়ানো এনামেলের ঘটি ভরে জল নিয়ে আসে। ছিটিয়ে দেয় মহুল গাছের গোড়ায়। বাবা-কালুয়াষাঁড়ের ওপরও ঢেলে দেয় গণ্ডুষ পরিমাণ জল। তারপর মতিলালের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় মোরগটিকে। বাবা-কালুয়াষাঁড়ের দেহের ওপর প্রাণীটাকে চেপে ধরে নিমেষের মধ্যে দা দিয়ে কেটে ফেলে ওর গলার নলি। খানিক ছটফট করতে করতে একসময় নিথর হয়ে যায় প্রাণীটা। রক্তে ভেসে যায় পাথরের বুক। মুন্ডুটা পড়ে থাকে ঠাকুরের দেহের ওপর। পুশুপতি ধড়টা ছুড়ে দেয় অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মতিলালদের দিকে।
ততক্ষণে মতিলাল বাউরি আশপাশের শালগাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলেছে একগাছা শালপাতা। বুনো কাঁটা ফুঁড়ে ফুঁড়ে বানিয়ে ফেলেছে প্রকাণ্ড এক খালা। ষাঁড়া-মোরগের লাশটাকে ভক্তিভরে ওই খালা’র মধ্যে পুরে দিয়ে নিজের ময়লা গামছায় কষে বাঁধে।
ঠাকুরের প্রস্তরদেহটি জুড়ে তখন ঢাল অনুসারে অনেকগুলি রক্তের স্রোত। মতিলালের থেকে মহুয়ার বোতলটা চেয়ে নিয়ে অর্ধেকখানি মদ ওই রক্তের ওপর ঢেলে দেয় পুশুপতি শবর। বাকিটা রেখে দেয় পাশটিতে। ঠাকুরের পূজারি হিসেবে পারিশ্রমিক বাদেও প্রসাদি-মদটাও ওরই প্রাপ্য।
পারিশ্রমিক বাবদ নগদ পাঁচ সিকে মিটিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মতিলাল বাউরি। ততক্ষণে সূয্যিদেব মাথার ওপর থেকে হেলে পড়েছেন।
এখন আর তিনটি প্রাণী নয়। এখন কেবল দু’জন। নয়ন আর মতিলাল বাউরি। সঙ্গের ডাগর ষাঁড়া-মোরগটি, এই মুহূর্তে সে বাবা-কালুয়াষাঁড়ের প্রসাদ! তার মুন্ডুহীন ধড়টা শালপাতার খালার মধ্যে মোড়াচোড়া হয়ে মতিলাল বাউরির ময়লা গামছায় পুঁটলিবন্দি। বাড়ি পৌঁছলে তেল-মশলাসহ হয়ে যাবে কালুয়াষাঁড়ের প্রসাদি মাংস। নয়নদের বাড়ির সবাই চেটেপুটে খাবে ওকে।
কিন্তু সেটা তো ঘটবে সেই রাতের বেলায়। উপস্থিত, নয়নের অসহায় প্রশ্নটার কী জবাব দেয় মতিলাল? ওইটুকুন বাচ্চা, ভোর থেকে পড়ন্ত দুপুর পর্যন্ত অভুক্ত! তা বাদে মতিলাল তো জানেই, নয়নটা খিদে সইতে পারে না একটুও।
—খাবি বাপ।
খুব মিনমিনে গলায় জবাব সারে মতিলাল বাউরি, ‘আগে রানিবাঁধ বাজারে পৌঁছতে দে। তার আগে, এই ধুম জঙ্গলে খাইদ্য-খাবার কুথা পাবি বাপ?’
খিদের চোটে নয়নের মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। মিনমিনে গলায় বলে, ‘উই যে ঝুপড়ি-ঝুপড়ি ঘরগুলান, উয়াদ্যার পাশ কিছো মিলব্যেক নাই?’
—ছিঃ!
মতিলাল স্পষ্টতই আঁতকে ওঠে, ‘উয়ারা হইল্যাক জাতে শবর। বামুন হইয়েঁ উয়াদ্যার খাইদ্য খাবি? ছ্যাঃ—ছ্যাঃ। লোকে শুনলে কী বইলব্যাক!’
মতিলাল কাকার কথার ওপর আর কথা চলে না। কাজেই, ওর পিছু পিছু টলোমলো পায়ে হাঁটতে থাকে নয়ন।
তিন
এক-জঙ্গল শেষ, তো দুশরা জঙ্গল শুরু। মধ্যিখানে ট্যারা-ভালুকডিহির বিশাল একটি ধুতমা ডাঙা। ডাঙার একপ্রান্তে বিশাল চাকোলতা গাছ।
গাছের তলায় বাঁক নামিয়ে বসে বসে বিড়ি টানছিল লোকটা। বাঁকের দু’প্রান্তে দু’টি মুড়ির বস্তা।
বস্তা দুটো দেখতে দেখতে বুঝি অল্পখানি আশা জাগে মতিলালের বুকে। চাকোলতা গাছের তলায় ধূমপানরত লোকটির গা ঘেঁষে বসে পড়ে। এককথায় দু’কথায় ভাব জমাতে চায় লোকটার সঙ্গে। আর, তাতে করেই বেরিয়ে আসে যাবতীয় হালহদিশ।
নামটি বটে চুনারাম। তবে কেবল নাম শুনেই তো হিন্দুদের জাত বোঝা যায় নাকো। আর, জাতটা ঠিকঠাক না-জেনে যার-তার থেকে মুড়ি কিনে তো কোনও ব্রাহ্মণ-সন্তানকে সেই মুড়ি দেওয়া যায় না। মহাপাপ হব্যেক। কাজেই, অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, জেরা-টেরা করে, মতিলাল লোকটার সংসারের তাবৎ অন্ধিসন্ধি জেনে যায়।
পুরো নাম চুনারাম দাস। জাতে বোষ্টম। চুনারামের সুগৃহিণী বউটি সারা সকাল মুড়ি ভেজেছে। দুপুরে চাট্টি ফ্যানে-পান্তায় খেয়ে সেই মুড়ি বস্তায় ভরে পাইকারের আড়তে নিয়ে চলেছে চুনারাম। মুড়ি বিক্রি করে নগদ যা পাবে, তার মধ্যেই রয়েছে ব্যবসার পুঁজিটিও। কাজেই, মুড়ি-বিক্রির টাকা নিয়ে চুনারাম ফিরলেই ওই টাকার থেকে আসল পুঁজিটি দিয়ে পুনরায় ধান কিনবে বউ। সিজিয়ে, শুকিয়ে মুড়ির চাল বানিয়ে, ফের ভাজবে মুড়ি। কিন্তু বউটির মনে যারপরনাই ভয়, কি না মুড়ি-বিক্রির অতগুলো নগদ টাকা হাতে পেয়ে পতি-দেবতাটির যদি সহসা সম্রাট সাজাহান হতে সাধ যায়? যদি টাকা ক’টি ট্যাঁকে নিয়েই বসে পড়ে কোনও মদের ঠেকে? বেশ কয়েক পাত্র চড়িয়ে যদি লাভের পুরো টাকাটাই উড়িয়ে আসে? সংসারের চারটি পেটের জ্বলন থামাতে বউকে তখন পুঁজিটাই ভাঙতে হব্যেক। সেই কারণেই, বেরবার কালে মাথায় হাত রেখে তিন-সত্যি করিয়ে নিয়েছে মরদকে, কি না শত লালসাতেও ঠেকের দিকে ফিরেও তাকাবেক নাই।
পথের বন্ধুকে এইসব কথা বলতে বলতে হেসে লুটিয়ে পড়তে চায় চুনারাম দাস এবং চুনারামকে অমন দিলখোলা হাসি হাসতে দেখেই চটপট সুযোগটা নেয় মতিলাল। কথাটা ঝাঁ করে পেড়ে বসে।
বলে, ‘উই দ্যাখ, সঙ্গের ছেইলাটিকে। সাতশোল গাঁয়ের ভট্চাজ বংশ ইয়ারা। আমার মুনিবের ছেইল্যা। ভাইপোরও বাড়া। এই বচ্ছর মাইধ্যমিক দিল্যাক। উয়াকে লিয়েই সাত-সকালে গিছলাম কালুয়াষাঁড়ের থানে। পূজা দিয়ে এতক্ষণে ফিরছি। ভোখের জ্বালায় ছেইলাটা এক্কেরে ঝামরে পড়্যেছে। কাজেই, উই বস্তা থিক্যে কিছোটা মুড়ি তুমাকে দিতেই হব্যেক। অবশ্য লেহ্য দাম দিব আমি।’
‘পাগল হয়েছ তুমি?’ চুনারাম ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় মতিলালের প্রস্তাবটা, হিসাবের মুড়ি। বউ দস্তুরমতো ওজন করে, দরদাম বাতলে দিয়ে, তবেই-না রওনা করিয়েছে। অর থিকে একদানা মুড়িও দিয়া যাব্যেক নাই।
ওই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা কাটাকাটি চলে। শাস্ত্র-পুরাণ, উপকথা থেকে অনেক অনেক উদাহরণ টেনে মতিলাল প্রমাণ করতে চায় যে, এমনতরো আপৎকালীন পরিস্থিতিতে দুনিয়ার তাবৎ বিধিনিষেধ বন্যার জলের মতো ভেসে যায়, আর এ তো ক্ষুধার্ত বাচ্চার জীবন বাঁচাতে আধ-কিলোটাক মুড়ি!
শেষ পর্যন্ত অভুক্ত ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে, নগদ দশটি টাকা হাতে নিয়ে পাঁচশো গ্রাম মুড়ি দিতে রাজি হয় চুনারাম।
কিন্তু দেবে কীসে? সে তো আর পথের ধারে চপ-মুড়ির দোকান খোলেনি যে, ওই দোকানে এনামেলের ঘটি, শালপাতা, জল ইত্যাদি থাকবে। সে যাচ্ছে মুড়ির বস্তা নিয়ে পাইকারের কাছে।
শেষ পর্যন্ত কোমরে বাঁধা গামছাটাই মেলে ধরে নয়ন। ওই গামছায় চোখের আন্দাজে পাঁচশো গ্রাম মুড়ি ঢেলে দিয়ে, পয়সা বুঝে নিয়ে, হাঁটা দেয় চুনারাম।
পেটভর্তি খিদে নিয়ে নয়ন ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে মুড়িগুলোর ওপর।
মতিলালের দিকে তাকিয়ে বলে, কী হল, শুরু কর। খিদায় যে মইরে গেল্যম।
—শুরু কর মানে? মুড়িগুলা তো ভাগাভাগি কইর্তে লাগব্যেক। আমার গামছায় তো ফের ঠাকুরের ভোগ ষাঁড়া-মোরগটি বাঁধা রয়্যেঁছে।
—আরে, ভাগাভাগির কী দরকার? নয়ন ততক্ষণে অধীর হয়ে পড়েছে, ওই এক জা’গা থিক্যেই আসো দু’জনেই খাই।
কী...! দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় এবং ততোধিক রোষ নিয়ে নয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে মতিলাল, ‘কী কথাটা কইলি তুই?’
—অলেহ্যটা কী কইল্যম?
অবোধের পারা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে নয়ন।
—বামুনের ছা তুই, আর, আমি হইল্যম গিয়ে জাতে বাউরি। তুই আর আমি এক পাতে খেইত্যে পারি?
—ও, এই কথা? নয়ন ডানহাত দিয়ে মাছি তাড়ায়, কিচ্ছুটি হব্যেক নাই। খাও তো। এখন আর উ’সব নাই-মানে কেউ? আমরা তো হস্টেলে সব্বাই একসঙ্গে মুড়ি-চানাচুর খাই।
—একসঙ্গে মানে?
নয়নের চোখে সরাসরি চোখ রাখে মতিলাল, ‘একই পাতে?’
—তা নয়তো কি?
—উয়াদ্যার মধ্যে লিচু জাতের ছগরাও থাকে?
—থাকে বইকি। বামুন, কায়েত, বাউরি, বাগদি, ধোপা, লাপিত, সব্বাই থাকে।
—এসব কী বইলছু রে তুই!
চরম বিস্ময়ে দু’চোখ আকাশের পানে তুলে দেয় মতিলাল, ‘বউদিমণি এসব জানে?’
—জানে বইকি।
—কী বলে সে?
—কী আবার বইলব্যেক?
মুচকি হাসে নয়ন, ‘এই যুগে এসব মানে নাকি কেউ?’
—চুপ মার। ইট্যা কুনো বাহাদুরির কথা লয়।
সহসা খেপে ওঠে মতিলাল, ‘শুন, জাতে বামুন মানে, তুয়ারা জনম লিয়েছু বম্মার মাথা থিক্যে। আর, আমরা বাউরি-বাগদি, ধোপা-লাপিত আমরা জনম লিয়েছি বম্মার পা থিক্যে। মাথা আর পা এক ঠাঁই মিলতে পারে কখনও? এমন কল্লে মরবার পর পিত্রিপুরুষ তুয়ার হাতে জল লিব্যাক? অযথা জাত খুইয়ে বংশের সক্কলকে লরকগামী করাটা কি ঠিক?’
বলতে বলতে মতিলাল হুমকির সুরে বলে ওঠে, ‘দাঁড়া, আমি আজই ঘরে গিয়ে সব কথা বইলব দাদাকে। পাঁচ গাঁয়ের বামুন ডেইক্যে তুয়ার মাথা মুড়িয়ে প্রাচ্চিত্ত কইরত্যে লাগব্যেক।’
মতিলাল বাউরির কথাগুলো শুনতে নয়নের দু’চোখে জমছিল বিস্ময়।
একসময় মতিলালের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আচ্ছা কাকা, বইল্ত্যে পার, এই যে বামুন, কায়েত, বাউরি-বাগদি, ধোপা-লাপিত— এসব কে চালু কইরেছিল্যাক? বামুনরা, নাকি তুমরা?’
—কেন বল দেখি?
—আমার তো মনে লিচ্ছে, বামুনরা লয়, জাত লিয়ে এইসব ভেদাভেদ তুমরাই চালু করেছ।
—অব্বাক কথা বইললি তুই!
মতিলাল যেন আকাশ থেকে পড়ে, ‘ওরে, এই যে হিন্দু-মুসলমান, বামুন-চুয়াড়— এই সব কিছো উপরওয়ালার সৃষ্টি, বাপ।’
বলতে বলতে নয়নের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকায় মতিলাল। বলে, ‘কাজেই, তুই-আমি, আমরা কেউই তা ভাঙতে পারি না, বাপ। এই দোনিয়া তাইলে অধঃপাতে যাব্যেক।’ মতিলাল বাউরির মুখে কথাগুলো শুনতে শুনতে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় নয়ন।
আর, ঠিক সেই মুহূর্তে, সহসা মানুষটার ময়লা গেঞ্জির তলায় একটা মোটা এবং ততোধিক ময়লা পৈতেও দেখে ফেলে সে।