যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
ব্রিটিশ আমলে এক সাহেব নেটিভ মহিলার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন! এই ঘটনায় তোলপাড় পড়ে যায় চারদিকে। শেষ পর্যন্ত মামলায় হেরে গেলেন রানি রাসমণি। সাহেবের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য ৫০ টাকা জরিমানা গুনতে হল। মামলার ভয়ে উত্সবের দিনে বাজনা থামাতে রাজি হননি জানবাজারের রানিমা। ব্রিটিশ আমলের দুর্গাপুজোর ইতিহাসে এমন রুখে দাঁড়ানোর কাহিনি স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। তবে, সেকালের কলকাতায় জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপুজো শুরু হওয়াটা ছিল একেবারেই আলাদা। সেখানে রয়েছে আপসের গল্প।
ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুজোর শোভাযাত্রা শুরু হবে। চারপাশে সাজ সাজ রব। এসেছে হাতি, ঘোড়া, ব্যান্ডপার্টি আরও কত কী! কোনও রকমের জৌলুসেরই অভাব নেই। না, তখনও দুর্গাপুজো বাঙালির কাছে শ্রেষ্ঠ উত্সবের তকমা পায়নি। ১৭৫৭ সাল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের মাটিতে রাজত্ব স্থাপনের শিলান্যাসটি করে ফেলেছে। পলাশির যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন রবার্ট ক্লাইভ। যুদ্ধ জিতে কলকাতা ফেরার পথে ক্লাইভ তাঁর মুনশি নবকৃষ্ণ দেবকে ফুরফুরে মেজাজে বললেন, ‘এত বড় যুদ্ধ জয় করলাম। তোমরা একটু আমোদ করতে পার না?’ সাহেবের কথা মনে ধরে নবকৃষ্ণেরও। সেই থেকে তাঁর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, কীভাবে সাহেবের কথা রাখা যায়। হঠাত্ নদীর তীরের দিকে চোখে দূরবিন তাক করে সাহেব দেখেন, কাতারে কাতারে মেয়ে-বউ বটবৃক্ষের সামনে জমায়েত করছে। সঙ্গে ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গ বাজছে। নবকৃষ্ণ বলেন, ‘হুজুর, আজ মনসা পুজো।’ ক্লাইভের মাথায় তখনই বিদ্যুত্ ছুটে যায়। তিনি বলেন, ‘পুজোআচ্চার মাধ্যমেই তো সারা বাংলার মানুষ পলাশির যুদ্ধ জয়ের আনন্দ উদযাপন করতে পারেন।’ ক্লাইভের এই কথা শুনে নবকৃষ্ণের চিন্তা আরও গভীর হল। কী এমন পুজো করা যায়, যা বেশ কয়েকদিন ধরে উদযাপন করা যাবে? হঠাত্ তাঁর মাথায় আসে দুর্গাপুজো করলে কেমন হয়! কিন্তু সে পুজো তো বসন্তকালে হয়। তবে, ক্লাইভ এতদিন অপেক্ষা করতে নারাজ। তাই বাধ্য হয়ে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনকেই বেছে নিলেন নবকৃষ্ণ।
ক্লাইভ চেয়েছিলেন, এমন একটা কিছু করতে, যাতে বোঝা যায় সিরাজ-উদ-দৌলা নামের এক ‘অশুভ শক্তি’কে বিনাশ করেছে কোম্পানি। তখন দুর্গাপুজো বলতে জমিদারবাড়ির পুজো। ক্লাইভের কাছে নবকৃষ্ণ আবদার করেন, নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে ডেকে তিনি যেন কড়া ভাষায় বলে দেন, সারা বাংলার সব জমিদারবাড়িতে শরত্কালেই দুর্গাপুজোর আয়োজন করতে হবে। কৃষ্ণচন্দ্রকে বললেই বাংলার সব জমিদার সেই কথা শুনবেন। ব্রিটিশ সেনাপতি হেসে বলেন, ‘বেশ বলে দেব।’ দুর্গাপুজোর কল্পনায় বিভোর নবকৃষ্ণ। সেই যাত্রাপথেই জাঁকজমকের ব্লুপ্রিন্ট শুনিয়ে দিলেন, সুতানটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা জুড়ে কী কাণ্ড হয় দেখবেন। ষোলো দিন ধরে নাচা-গানা, খানা-পিনা হবে। কবিগান, কেষ্টযাত্রা, পুতুলনাচ, বাইনাচ সব থাকবে। ভিয়েন বসবে। রাস্তা জুড়ে তাঁবু বসবে শয়ে শয়ে। আলোতে ঝলমল করবে গোটা এলাকা। এসবের মাঝে ক্লাইভকে নেমন্তন্নটিও করে বসেন তিনি। ক্লাইভও তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘নদীয়া নয়। এই বছর পুজোতে তোমার বাড়িতেই যাব।’
ক্লাইভের শোভাযাত্রা মহাষ্টমীর দিন এগিয়ে চলেছে। চিত্পুর রোড হয়ে শোভাযাত্রা যাবে নবকৃষ্ণের বাড়িতে। সেদিন কার্যত কার্নিভালের চেহারা নিয়েছিল কলকাতা শহর। হাতির পিঠে বসেছেন ক্লাইভ। তাঁর মাথার উপর ধরা ছাতা। পিছনে ঘোড়ার পিঠে চলেছেন ওয়ালশ, ওয়াটস সহ ফোর্ট উইলিয়ামের ছোট-বড় কর্তারা। গোটা শোভাযাত্রা এসকর্ট করছে গোটা পঞ্চাশেক গোরা পল্টন। তাঁদের হাতে আকাশে তাক করা বন্দুক। একেবারে পিছনে ছিল ব্যান্ড। তারা রুল ব্রিটানিয়ার সুর বাজাচ্ছে। নবকৃষ্ণ আবার পুজোর কিছুদিন আগে ফোর্ট উইলিয়ামে এসে সমস্ত পরিকল্পনা জানিয়ে আলাদা করে নেমন্তন্নও করে গিয়েছিলেন।
ক্লাইভ চেয়েছিলেন গোটা হিন্দুসমাজকে দুর্গাপুজোর আনন্দে মাতিয়ে রাখতে। সাধারণ মানুষ যেন কোনওভাবেই কোম্পানিকে ভিলেন বলে না মনে করে। হাতির পিঠে যেতে যেতে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করছিলেন তিনি। দেশি পাড়া থেকে শয়ে শয়ে মানুষ তাঁকে দেখতে রাস্তার ধারে ভিড় করেছিল। কোম্পানির পতাকা নিয়ে নাচতে নাচতে মানুষ বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। তাদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে ভেসে আসছিল ইংরেজ সেনাপতির কানেও — ‘ওই তো ক্লাইভ বসে রয়েছেন! কর্নেল ক্লাইভ!’ এত আড়ম্বর দেখে দেশের মানুষরাও অবাক হয়ে গিয়েছিল। এ দৃশ্য যে তারা এর আগে দেখেনি। গোবিন্দপুরের অদূরে বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের বাড়িতে বহুকাল যাবত্ এই পুজো হয়ে আসছে ঠিকই। সুতানটির নকু ধরের বাড়িতেও পুজো হতো। কিন্তু সে পুজোতে এত আড়ম্বর ছিল না। সকলের প্রবেশাধিকারও ছিল না। কিন্তু নবকৃষ্ণের বাড়িতে এদিন হতদরিদ্র থেকে তাবড় কেষ্ট-বিষ্টু সকলেরই অবারিত দ্বার। মুনশির কেরামতি দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন গোবিন্দরাম মিত্তির, শোভারাম বসাক সহ সেকালের শহরের বাবুরা। ক্লাইভ এবার নবকৃষ্ণের বাড়িতে প্রবেশ করবেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে পলাশির যুদ্ধে ব্যবহৃত একটি ফিল্ড পিস কামান নবকৃষ্ণ চেয়ে নিয়েছিলেন। নাটমন্দিরের সদর দেউড়ির পাশেই গাড়িসমেত কামানটি স্থাপন করা হয়। তোপ দাগার জন্য এক পর্তুগিজ গোলন্দাজকেও নিযুক্ত করা হয়। দেউড়ি থেকে নাটমন্দির পর্যন্ত লাল গালিচা পাতা হয়েছে। ক্লাইভ এলেই পুষ্পবৃষ্টি করার জন্য সুন্দর পোশাকে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েকজন। ইংরেজ সেনাপতি আসার পথে নদীর পাড়ের কাশফুলের শোভা দেখে মুগ্ধ। তিনি জানতে চান, এ কেমন ফুল? তাঁকে জানানো হয়, এই ফুলই বাংলায় শরতের আগমনের প্রতীক। নদীতে তখন সারি সারি নৌকা বোঝাই মানুষ। তারা সকলে নবকৃষ্ণের বাড়ির পুজোতে আসছে। হুগলি, বর্ধমান থেকেও সেদিন মানুষ এসেছিল। এ তো কিছুই নয়। ক্লাইভকে খুশি করার জন্য নবকৃষ্ণ দেব আরও একখানা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। চিত্পুর রোড ছেড়ে তাঁর বাড়ির দিকে এগতেই ইংরেজ সেনাপতির চোখ আরও বড় হয়ে গেল। পথের পাশে বিরাট একখানা ক্লাইভের মূর্তি। কৃষ্ণনগরের এক শিল্পী তৈরি করেছিলেন এই মূর্তি। নিজের মূর্তি দেখে মুচকি হেসে উঠেছিলেন তিনি। শোনা যায়, নবকৃষ্ণের মৌখিক বিবরণ শুনেই কৃষ্ণনগরের সেই শিল্পী মূর্তি তৈরি করেছিলেন। এবার সেই নাটমন্দিরের তোপ গর্জন করে উঠল। নবকৃষ্ণ জোড় হাতে, নতমস্তকে স্বাগত জানালেন ক্লাইভকে। দুর্গার রূপ দেখে মুগ্ধ ক্লাইভ বললেন, ‘আমিও পুজো দিতে চাই। তোমার দেবতা কি আমার পুজো নেবেন?’ ব্যস্ত নবকৃষ্ণ বললেন, ‘হুজুর, আপনি বাম হস্তে একটি ফুল ছুড়ে দিলেও মা পুজো গ্রহণ করবেন।’ সেই থেকে শুরু হল কলকাতায় জাঁকজমক সহকারে পুজো। কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল বেপরোয়া প্রতিযোগিতা। এক বাড়ির সঙ্গে আর এক বাড়ির লড়াই। কেউ বেনারস থেকে বাইজি আনল তো কেউ আনল লখনউ থেকে। কার পুজোয় কত সাহেব-মেম এল, সেই নিয়েও চলত প্রতিযোগিতা। তবে বাঙালি সমাজের ভিতরে জাতপাতের বজ্র আঁটুনিটা তখনও বেশ শক্ত ছিল। আবার সেই সমাজেই লালমুখো সাহেবদের পুজোতে আদর-আপ্যায়ন করা হতো। এই দুর্গাপুজোর ব্যাপারে সাহেবদের আগ্রহ কম ছিল না। সাহেবরাই নিয়ম করে দিয়েছিলেন হিন্দুদের পুজোতে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে তোপ দাগা হবে। আর কোম্পানির ফৌজ হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির সামনে গেলেই সেলাম জানাবে ফৌজি কায়দায়। কলকাতা শহরে জন চিপস নামের এক সাহেব ছিলেন। একবার তার ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছিল। এক বাঙালি বন্ধুর পরামর্শে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য বাড়িতে শুরু করলেন দুর্গাপুজো। সেকালের সাহেব ছোকরারা বাঙালির দুর্গাপুজো নিয়ে পাতার পর পাতা কবিতাও লিখেছেন। ফ্যানি পার্কস নামের এক মেম একবার কলকাতার ধনী বাড়িতে পুজো দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘পুজোমণ্ডপের পাশেই একটি বড়মাপের ঘরে নানান জাতের উপাদেয়, উত্কৃষ্ট খাবার থরে থরে সাজানো। সব ইউরোপীয় অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য। এসব খাবারদাবার সরবরাহ করেছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান মেসার্স গাটার অ্যান্ড হুপার।’ অনেক সাহেব পুজোপাগল হলেও সব সাহেব তা ছিল না। তাদের ধারণা, পুজো-পার্বণ উপলক্ষে হিন্দুরা এই যে এত ইউরোপীয়দের সম্মান প্রদান করছে। আসলে এর পিছনে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। এসবই কোম্পানির কাছে আসার প্রচেষ্টা। এমনকী, সাহেবরা বাড়ির পুজোয় এলে ‘গড সেভ দ্য কিং’ বলে রব উঠত। মিশনারি সাহেবদের ভয় ছিল, সাহেবরা না শেষে পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতে শুরু করে! সাহেবদের এইসব আদিখ্যেতা নিয়ে আবার হিন্দু পাড়াতেও সমালোচনা হতো।
একটা সময় আবার এই পুজোকেই ব্রিটিশরা ভয় পেতে শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতার দুর্গাপুজোর চালচিত্রটা ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। বাঙালিবাবুদের হাতে আর কুক্ষিগত হয়ে থাকল না দুর্গাপুজো। এল বারোয়ারি পুজো। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আখড়া হতে শুরু করে সেইসব বারোয়ারি পুজো। কলকাতায় বিপ্লবীদের জোটবদ্ধ করতে একটা কনভেনশনের দরকার ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের ফাঁকি দিয়ে সেরকম জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। ফন্দি আঁটলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সিমলা অঞ্চলে ছিল বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর বাড়ি। নেতাজির নির্দেশে অতীন্দ্রনাথ শুরু করলেন বারোয়ারি পুজো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা নেওয়া হল। সিমলা ব্যায়াম সমিতি হল সংগ্রামীদের জমায়েতের স্থান। সেখানেই সকলের সঙ্গে পাত পেড়ে প্রসাদ খেতেন সুভাষচন্দ্র, রাজেন দেবরা। কিন্তু দু’বছরের মধ্যেই ব্রিটিশরা সেই পুজো ভেঙে দেয়। সারা বছরের শরীরচর্চা আর সাহসিকতার পরীক্ষার দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল অষ্টমীর দিনকে। এই দিনটিকে তাঁরা ‘বীরাষ্টমী’ দিবস হিসেবে পালন করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আরও একটি আখড়া ছিল কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গোত্সব। আবার বাগবাজার সর্বজনীনের প্রথমে নাম ছিল ‘নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গা পুজো’। ১৯৩০ সালে বিখ্যাত আইনজীবী দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় বাগবাজারের পুজো কর্পোরেশনের মাঠে উঠে আসে। নেতাজি তখন শহরের মেয়র। এই পুজো উপলক্ষে তখনকার দিনে ৫০০ টাকা চাঁদাও দিয়েছিলেন তিনি।
বাংলার দুর্গাপুজো নিয়ে গোটা বিশ্বের কৌতূহল অনেক দিনের। আর আজ সেই দুর্গাপুজোই পেল ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।