যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
১৯৩২ সালের ৮ মে অরবিন্দ এক চিঠিতে দিলীপকুমার রায়কে লিখেছিলেন যে, লেলের নির্দেশে চলে তিন দিনে তিনি এমন চিন্তাশূন্যতায় আসীন হয়েছিলেন, যে-ভূমিকা থেকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় কীভাবে চিন্তাধারা আসে বাইরে থেকে।
তাঁকে আরও লেখেন, লেলের কাছ থেকেই তিনি প্রথম এ-আশ্চর্য অবস্থার হদিশ পান, তার আগে তিনি জানতেন না যে, কোনও চিন্তাকে আসতে দেব না স্থির করার মতন আত্মকর্তৃত্ব যোগবলে অর্জন করা যায়।
এখানে প্রশ্ন, কে এই লেলে? তাঁর পুরো নাম— বিষ্ণুভাস্কর লেলে। অরবিন্দের গুরু। মহারাষ্ট্রীয় যোগী। সুরাট কংগ্রেসের পরই তিনি লেলের সান্নিধ্যে আসেন।
সুরাট থেকে ফেরার পূর্বেই বারীন ঘোষ তাঁকে তার করেন, বরোদায় অরবিন্দ তাঁর দর্শনাভিলাষী।
নির্দিষ্ট দিন সকাল আটটার দিকে আসেন লেলে। অরবিন্দ, বারীন প্রমুখ তখন থাকতেন বরোদায় স্যার সুবা খাসিরাও যাদবের বাড়িতে। অরবিন্দ-লেলে একান্তে কথা হয় আধ ঘণ্টার বেশি।
বিষ্ণুভাস্কর লেলে বললেন, আমার সাধনা তোমায় দেব, কিন্তু একান্তে সাত দিন আমার সঙ্গে থাকতে হবে।
অরবিন্দ বললেন, কোথায়?
লেলের উত্তর, আমি গোপন স্থানের ব্যবস্থা করব।
দু’জনের এই আলোচনার পর বরোদায় তিনটি সভায় বক্তৃতা দেন অরবিন্দ, সাক্ষাৎ করেন মহারাজার সঙ্গে এবং তারপরেই উধাও গণদৃষ্টির সামনে থেকে।
এখানে স্মরণযোগ্য, অরবিন্দের প্রথম গুরু ছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ। ১৯০৩ সালে নর্মদাতীরে চান্দোতে এই মহাযোগীর দর্শন পান তিনি। দেওঘরের প্রসিদ্ধ হটযোগী বালানন্দ স্বামীর গুরু ছিলেন এই বিখ্যাত সাধক ব্রহ্মানন্দ।
অরবিন্দের সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু কে জি দেশপাণ্ডে এবং একজন করণিক, নাম তাঁর ধুরন্ধর। আশ্রমে পৌঁছেই তীব্র জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েন ধুরন্ধর। তখন ব্রহ্মানন্দ তাঁর শিষ্য কেশবানন্দকে দিয়ে নর্মদা হতে কিছু জল এনে ধুরন্ধরকে পান করতে দিলেন। অবাক বিস্ময়ের, জলপান করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ, জ্বরমুক্ত।
এই যোগী নাকি কারও দিকে দৃষ্টিপাত করতেন না। অরবিন্দ তাঁর সামনে উপস্থিত হতেই পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ফলে অরবিন্দের ভিতরকার সুপ্ত দিব্যভাব অকস্মাৎ মুকুলিত ও প্রস্ফুটিত হতে লাগল। বারীন্দ্রকুমার বলেন, এই ব্রহ্মানন্দের পূর্ণ দৃষ্টিপাতেই অরবিন্দের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম বিকাশ।
বলা যেতে পারে, অরবিন্দের গুরু হিসেবে আগে স্বামী ব্রহ্মানন্দ, পরে বিষ্ণুভাস্কর লেলে। সেই সময়কার মনের অবস্থা সম্বন্ধে তিনি পরবর্তীকালে নীরদবরণকে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরের নিকট আমি প্রার্থনা করতাম, হে প্রভু, যদি সত্যই তুমি থাক তবে তুমি আমার মনের অবস্থা জ্ঞাত আছ। তুমি জান আমি মুক্তি চাই না, অন্য আর পাঁচজনে যা চায় তা আমি চাই না। আমি চাই শক্তি, যে শক্তিতে আমি আমার জাতিকে উচ্চ আসনে বসাতে পারি। এই জাতি, যাকে আমি ভালোবাসি, যার জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করতে আগ্রহী সেই জাতির জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রাখ, তার সেবা করার সুযোগ দাও।’
বরোদায় লেলের নির্দেশে অরবিন্দ ও তাঁর অনুজ বারীন্দ্রকুমার গোপনে গেলেন এক বিশাল জনশূন্য অট্টালিকায়। তখন শহরের লোক তাঁকে খুঁজছে পাগলের মতো। এদিকে লেলের স্ত্রী রাঁধেন, তাঁরা তিনজনে খান। লেলে ও অরবিন্দ দিবারাত্র কাটান ধ্যানে।
বারীন ঘোষ লিখছেন— ‘আমায়ও লেলে বসিবার জন্য পীড়াপীড়ি করেন, আমি মাঝে মাঝে বসি বটে কিন্তু মাথায় তখন বিপ্লবের পোকা গজ গজ করিতেছে; তাহারা আমায় স্থির হইয়া বসিতে দিবে কেন? কাজেই কোন গতিকে ফাঁক পাইলেই আমি সরিয়া পড়ি এবং একটি তালা ঢালাইয়ের কারখানায় বসিয়া ঢালাইয়ের কাজ দেখি ও শিখি। বোমার বারুদের জন্য পিতলের বা কাঁসার আধার ঢালাই করিতে হইবে, কোথায় তাহা শিখিব তখন আমার কেবল সেই চেষ্টা। ভগবানকে ঠিক তখনই সদ্য সদ্য না পাইলেও চলে, তবে তিনি যদি বোমার কারখানার মিস্ত্রী বা বেঙ্গল ব্যাঙ্কের ভরা লোহার সিন্দুক হইয়া আসিতেন তাহাতে আমার বড় আপত্তি ছিল না। তখন আমার সাধনা খুলিয়াছে বটে, কিন্তু মনে বড় অশুদ্ধি, কত প্রবৃত্তির ঢেউ, কত চিন্তা, কত সংকল্পের মাতাল হাওয়া।’
সব শুনে বিষ্ণুভাস্কর লেলে ধীরকণ্ঠে বারীন্দ্রকে বললেন, ‘তোমার মনে প্রাণে অশুদ্ধি রয়েছে, কাম রয়েছে, তাই এ বিঘ্ন।’
বারীন্দ্র গেলেন খেপে, বললেন, ‘আমি তো দেশের কাজে উৎসর্গিত প্রাণ, কাম আবার কোথায় দেখলেন?’
লেলে হাসেন, বললেন— ‘আছে বইকি, তুমি বুঝতে পারো না।’
সেই জনহীন বিশাল অট্টালিকায় লেলের নির্দেশিত পথে তিন দিনের ধ্যানেই নিজের মনকে অবিচল রাখার শক্তি অর্জন করে অরবিন্দ পেলেন মুক্তির স্বাদ।
তারপর অরবিন্দ পুনেতে গেলেন বক্তৃতা করতে। লেলের উপদেশে পূর্বেই কর্তব্য বিষয় ভেবে-চিন্তে বক্তৃতা দেওয়া ছেড়ে দিলেন। শান্ত হয়ে শূন্য মন নিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ানো-মাত্র, আপনি অনর্গল কথার পর কথা কে যেন অন্তরে বসে জুগিয়ে দিত।
কলকাতা রওনা হবার পূর্বে তিনি লেলেকে শুধোন, এখন তো আমি আপনাকে সঙ্গে পাব না, কীরূপ কী প্রণালীতে সাধনায় চলতে হবে আমায় বলে দিন।
বিষ্ণুভাস্কর লেলে প্রথমে সাধনার নানা উপদেশ দিতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু হঠাৎ থেমে বললেন, তোমার কাছে যে বাণী এসেছে, তাতে অকপট বিশ্বাস স্থাপন করে চলতে পারবে?
অরবিন্দ বললেন, হ্যাঁ, তা সহজেই পারব।
লেলে বললেন, তবে তাই করো তাহলে আর কোনও উপদেশই দরকার হবে না।
পণ্ডিচেরিতে জীবনসায়াহ্নে অরবিন্দ এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার বিশ্লেষণে নীরদবরণকে বলেছিলেন— ‘লেলে আমাকে ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকতে বললেন, চিন্তা ভাবনা ত্যাগ করে নিজের মধ্যে মনোযোগ করতে উপদেশ দিলেন। বললেন, নানা চিন্তা এসে জড়ো হবে, মনের মধ্যে প্রবেশের আগেই এদের ঝেড়ে ফেলতে হবে যাতে আমার মন সার্বিক নীরবতা লাভ করতে পারে। আমার পূর্বে জানা ছিল না যে, দৃশ্যত চিন্তারাজি বাইরে থেকে মনে এসে ভীড় করে। কিন্তু আমি লেলের বক্তব্যের যথার্থতায় অবিশ্বাস করিনি— তাঁর উপদেশমত ধ্যানে উপবিষ্ট হলাম। সুউচ্চ পর্বতোপরি বায়ুশূন্যতার ন্যায় এক নিমেষে আমার মন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর নানান চিন্তা যেন কায়াধারণ করে বাইরের থেকে আসতে থাকল, আমি তাদের দূরে সরিয়ে দিলাম। নিজের মনকে রাখলাম অবিচল, মাত্র তিন দিনে আমি পেলাম মুক্তির স্বাদ। সেই মুহূর্ত থেকে, মূলত আমার মানস সত্তা (Mental being) জ্ঞানলোকে মুক্তি পেয়ে এক বিশ্বমানসে (Universal mind) প্রসারিত হল, অপসারিত হল ব্যক্তি চেতনার ক্ষুদ্র গণ্ডী, দৃশ্য ও চিন্তাজগতের শত শত প্রাণসত্তার এবং জ্ঞানরাজির হয়ে উঠল এক স্বেচ্ছা-ভাণ্ডার।’
দিলীপকুমার রায় বলতেন, ‘শ্রীঅরবিন্দ ও বারীনদার গুরু শ্রীবিষ্ণুভাস্কর লেলের কথাও ঋষিদার মুখে শুনতাম, লেলেমহারাজ যোগী ছিলেন বটে ভাই, বলতেন ঋষিদা। নইলে ভাব, মনকে একদম খাঁ খাঁ শূন্য করতে পারে কেউ?’ শ্রীঅরবিন্দ এঁর কাছে দীক্ষা নিয়ে তবে না পেরেছিলেন গীতার ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ নির্দেশটি পালন করার কৌশল আয়ত্ত করতে? জানো তো?’
এবার আসা যাক দিলীপকুমার রায়ের ‘ঋষিদা’র পরিচয়ে। বাংলার অগ্নিযুগের আকাশের নক্ষত্রমালার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র— হৃষীকেশ (ঋষি) কাঞ্জিলাল। পণ্ডিত, রসিক, গৃহী, যাযাবর, বিপ্লবী তথা শঙ্করপন্থী সন্ন্যাসী- দশনামী সম্প্রদায়ের। মহাযোগী ভোলানন্দ গিরি তাঁকে হরিদ্বারে সন্ন্যাসে দীক্ষা দিয়ে নাম দেন— বিশুদ্ধানন্দ গিরি।
দিলীপকুমার রায় বলেছেন, ‘শ্রীঅরবিন্দকে তিনি গুরু বলতেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে— যে সময়ে বারীনদা, উপেনদা, ঋষিদা ও মতিদার (শ্রীমতিলাল রায়) সঙ্গে তিনিও গুরুর কাছে যোগ শিক্ষা করতেন পণ্ডিচেরির সদ্যোজাত যোগাশ্রমে। তাঁর (নলিনীকান্ত সরকার) কাছে কত যে শুনতাম ঋষিদার অন্তহীন রসিকতার গালগল্প! তারপরে বারীনদার কাছে শুনি ঋষিদার দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যের তথা অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তির কথা, যে প্রাণশক্তিতে বারো বৎসর আন্দামানে বাসের পরেও ভাটা পড়েনি। আর উপেনদার মুখে শুনতাম তাঁর দুঃসাহসিকতার কথা।
দুঃসাহসী বলে দুঃসাহসী! যে-মানুষ গৃহী হয়েও বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দেয়, তীক্ষ্ণধী হয়েও ধ্রুবাণি পরিত্যজ্য অধ্রুবাণি নিষেবতে— ধ্রুব নিরাপদকে ছেড়ে অধ্রুব সঙ্কটযাত্রার নেশায় মাতে, আর ক্ষণোচ্ছ্বাসের ঝোঁকে নয়— জেনেশুনে যে, দেশকে জাগাতে গিয়ে জীবন বিপণ্ণ করলেও দেশ জাগবে না (এ-বিপুল ঘুমের দেশে ভাই, লোকে যে জাগতে না জাগতে ফের ঢুলে পড়ে— বলতেন ঋষিদা প্রায়ই মাঝ থেকে ফল হবে শুধু হাতের পাঁচ খুইয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া) দুঃসাহসী বলবে না তাকে?’
তিনি কেমন স্বভাব-রসিক ছিলেন, তার দৃষ্টান্ত রয়েছে তাঁর জীবনের বেলাশেষের একটি ঘটনায়।
কলকাতায় দিলীপকুমার রায়ের নিবাসে গিয়েছেন হৃষীকেশ, তাঁর পায়ের ধুলো নিতেই স্নেহের দিলীপকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘বুক জুড়োলো ভাই— কী ফ্যাসাদেই যে পড়েছিলাম।
ফ্যাসাদ?
নয়তো কী? ট্রামে ঠাঁই নেই একটি বেঞ্চিতেও— কেবল একটি মহিলাদের বেঞ্চিতে একটি মহিলার পাশে ছাড়া। আমি বললাম, মা! বসতে পারি কি একটু? ওমা! তখন কি জানি, সামনের বেঞ্চিতেই যে মহাকায় মহাজন হ্যাটকোট পরা তিনি তার ভর্তা তথা কর্তা? তিনি মুখ ফিরিয়ে গর্জে উঠলেন, অফকোর্স নট— লেডিস সিট!
আমি বললাম একগাল হেসে, আমারও কোঁচা কাছা নেই, ভয় কি? ভর্তা কর্তা প্রায় হর্তা হয়ে ওঠেন আর কী, এমন সময়ে ভর্ত্রী ধমকে উঠলেন, গোল কোরো না। বুড়ো মানুষ— সাধু, বসলেনই বা।
ভর্তা গোঁ হয়ে চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। পরে একটু ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে আড়চোখে তাকাতেই আমি বললাম, সাহেবের করা হয় কী?
তিনি ধমকে উঠলেন, আমি খেটে খাই।
আমি ‘ও!’ বলে একটু চুপ করে থেকে ফের সলজ্জে বললাম, ‘সাহেব, খাটান কাকে?’ তিনি গম্ভীরমুখে বললেন, আমি কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার।
আমি একগাল হেসে বললাম, তবে তো আপনি আমারই দলে। আমিও যে কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার।
তিনি ভ্রুকুটি করে বললেন, ননসেন্স! You are a parasite.’
আমি সুধামাখা হেসে বললাম, না সাহেব। আপনি যেমন ইট কাঠ চুন সুরকির খবর রাখেন। বাড়ি কীভাবে তৈরি করতে হয়, রাখতে হয়, মেরামত করতে হয় তার উপদেশ দেন। আমিও ঠিক তাই করি। এই যে দেহ— এতে কে থাকে, কেমন করে একে টেঁকসই করা যায়, ভাঙন ধরলে কীভাবে মেরামত করে কর্তাকে রাজার হালে রাখা যায়। রোগ শোক পাপ তাপ অসুখ বিসুখে ধসে পড়বার জো হলে কী ধরনের শান্তির সিমেন্টে তাকে খাড়া রাখা যায়— কুচিন্তারা আক্রমণ করে অশান্তিতে নাজেহাল করলে কীভাবে মনকে পবিত্র করা যায় গুরুর করুণার আলোহাওয়ায় ভেন্টিলেশনে, এই সব উপদেশ আমিও দিই ঠিক আপনার মতন। তবে আপনি কেউ কনসাল্ট করতে এলে তার কাছে ফি নেন— আমি উপদেশ দিই ফ্রি অব চার্জ। অর্থাৎ যে আসে তাকেই উদ্ধার করি— বিনামূল্যে।
শ্রোতারা সোল্লাসে ফেটে পড়েন।
অরবিন্দ ‘কারাকাহিনী’তে সঙ্গত কারণে নামোল্লেখ না করেও তাঁর বিষয়ে লিখতে গিয়ে বিস্মৃত হননি তাঁর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য— পরিহাসপ্রিয়তা। তিনি লিখেছেন ‘এই সময়ে একজন আসামী গোঁসাইয়ের নিকট গিয়া বলিলেন, দেখ ভাই, আর সহ্য হয় না, আমিও approver হইব, তুমি শামসুল আলমকে বল আমারও যেন খালস পাইবার ব্যবস্থা করেন। গোঁসাই সম্মত হইলেন... তাহাকে উপেন প্রভৃতির নিকট হইতে এইরূপ কয়েকটি আবশ্যকীয় কথা বাহির করিতে বলিলেন, যেমন— কোথায় গুপ্ত সমিতির শাখা সমিতি ছিল, কাহারা তাহার নেতা ইত্যাদি। নকল approver আমোদ-প্রিয় ও রসিক লোক ছিলেন, তিনি উপেন্দ্রনাথের সহিত পরামর্শ করিয়া গোঁসাইকে কয়েকটি কল্পিত নাম জানাইয়া বলিলেন যে, মান্দ্রাজে বিশ্বম্ভর পিলে, সাতারায় পুরুষোত্তম নাটেকর, বোম্বাইতে প্রফেসার ভট্ট এবং বরোদায় কৃষ্ণাজীরাও ভাও এই গুপ্ত সমিতির শাখার নেতা ছিলেন।’
হৃষীকেশ কাঞ্জিলালের প্রাণের বন্ধু, দুঃখদিনের সঙ্গী ও সহযোদ্ধা উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত বই ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য় সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করেন, তিনি কী বুদ্ধিকৌশলে বিভ্রান্ত করেন ইংরেজ সরকারের পুলিস গোয়েন্দাদের। উপেন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘...নরেন্দ্র গোস্বামী যেন হঠাৎ একটু বেশী অনুসন্ধিৎসু হইয়া দাঁড়াইল। বাংলা ছাড়া ভারতের অন্য কোথাও বিপ্লবের কেন্দ্র আছে কিনা, আর থাকিলে সেখানকার নেতাদের নাম কী ইত্যাদি অনেক রকম প্রশ্নই সে আমাদের জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।...
হৃষীকেশ একদিন আসিয়া আমায় বলিল— গোটা দুই-তিন বেয়াড়া রকমের মাদ্রাজী বা বর্গী-টর্গীর নাম বানিয়ে দিতে পারিস?
কেন?
নরেন বোধহয় পুলিসকে খবর দিচ্ছে, গোটা কতক উদ্ভট নাম বানিয়ে দিতে পারলে স্যাঙ্গাতরা দেশময় অশ্বডিম্ব খুঁজে খুঁজে বেড়াবে ’খন।
তাহাই হইল, মহারাষ্ট্রীয় কেন্দ্রের সভাপতি হইলেন শ্রীমান পুরুষোত্তম নাটেকার, গুজরাতের সভাপতি হইলেন কিষণজী ভাওজী বা এইরকম একজন কেহ, —কিন্তু মাদ্রাজের ভার লইবেন কে? মাদ্রাজী নাম যে তৈয়ারি করা শক্ত! খবরের কাগজে তখন চিদম্বরম পিলের নাম দেখা গিয়াছিল। হৃষীকেশ বলিল, যখন চিদম্বরম মাদ্রাজী নাম হইতে পারে তখন বিশ্বম্ভরম কি দোষ করিল? আর পিলের বদলে যকৃৎ বা অমনি কিছু একটা জুড়িয়া দিলেই চলিবে।’
সৈয়দ মুজতবা আলী বলতেন, ‘উপেন্দ্রনাথ দস্তয়েফস্কির মত শক্তিশালী লেখক নন; দস্তয়েফস্কির মত বহুমুখী প্রতিভা তাঁর ছিল না, কিন্তু এ-কথা বার বার বলব দস্তয়েফস্কির সাইবেরিয়া কারাবাস উপেন্দ্রনাথের আত্মকথার কাছে অতি নিশ্চয়ই হার মানে।’
আন্দামানে অভিশপ্ত নির্বাসিত জীবনের আত্মকথায়ও উপেন্দ্রনাথ শুনিয়েছেন— হৃষীকেশের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের আদিপর্বের কাহিনি—
‘হৃষীকেশ আমার কলেজের সহপাঠী। কলেজ হইতে মা ইংরেজী সরস্বতীকে বয়কট করিয়া আমি যখন সাধুগিরি করিতে বাহির হই, তখন পণ্ডিত হৃষীকেশ ভাবাধিক্যবশতঃ নিমতলার ঘাটে গঙ্গাজল স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, সমস্ত সৎকর্মে সে আমার সহগামী হইবে। একে নিমতলার ঘাট— মহাতীর্থ বলিলেই হয়, তাহার উপর মা গঙ্গা— একেবারে জাগ্রত দেবতা, সেখানকার প্রতিজ্ঞা কি আর বিফল হইবার জো আছে? মা গঙ্গা কি কুক্ষণেই তাহার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া মনে মনে তথাস্তু বলিয়াছিলেন জানি না, কিন্তু সেইদিন হইতে আজ অবধি পণ্ডিত হৃষীকেশ আমার পিছনেই লাগিয়া আছে। শাস্ত্রে বলে, উৎসবে, ব্যসনে দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে ও শ্মশানে যে একসঙ্গে গিয়া দাঁড়ায়, সেই বান্ধব। হৃষীকেশের বিবাহে ও পুত্রের অন্নপ্রাশনে আমি লুচি খাইয়া আসিয়াছি, দুর্ভিক্ষের সময় দু’জনে পীড়িতের সেবা করিয়াছি; একসঙ্গে উভয়ে সাধুগিরি করিয়া ফিরিয়াছি, মাস্টারিও করিয়াছি। আজ রাষ্ট্রবিপ্লব করিতে গিয়া একসঙ্গে উভয়ে পুলিসের হাতে ধরাও পড়িলাম। ভবিষ্যতে সে উভয়কে একসঙ্গে শ্রীধাম আন্দামানে বাস করিতে হইবে, তাহা তখন জানিতাম না। বান্ধবত্বের সব লক্ষণই মিলিয়াছে; বাকি আছে শুধু শ্মশানটুকু! নিমতলার ব্রতটুকু এখন নিমতলায় উদ্যাপন করিয়া আসিতে পারিলেই আমি নিশ্চিন্ত হই।’ (চলবে)