পর্ব- ২০
বিপিনচন্দ্র পাল
পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়
জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেওয়ার মাত্র দু-সপ্তাহ পরে, ১৯০৭ সালের ১৬ আগস্ট অরবিন্দের নামে পুলিস বের করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তাঁর অপরাধ, বন্দেমাতরম পত্রিকায় ২৭ জুন প্রকাশিত ‘India For the Indians’ প্রবন্ধটি ইংরেজ সরকারের চোখে রাজদ্রোহপূর্ণ।
পুলিসের বিবেচনায় অরবিন্দই বন্দেমাতরম পত্রিকার সম্পাদক, অতএব তিনিই দায়ী, তাঁর অপরাধের বিচারের জন্য জারি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ১৬ আগস্ট আসন্ন গ্রেপ্তারের কথা শুনে তিনি পরামর্শ করেন ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তারপর অরবিন্দ স্বয়ং আত্মসমর্পণ করলেন পুলিসের কাছে। গিরিশচন্দ্র বসু ও নীরদচন্দ্র মল্লিক আড়াই হাজার টাকার জামিনে অরবিন্দকে বিচারসাপেক্ষে তখনকার মতো মুক্ত করে আনেন।
২২ আগস্ট অরবিন্দ ‘বন্দেমাতরম’-এ লিখলেন আর একটি অগ্নিদীপ্ত প্রবন্ধ ‘The Crime of Nationalism’। বললেন, ‘Can I be false to the fundamental message of my religion, my civilisation and its philosophy?’
এই রাজদ্রোহমূলক মোকদ্দমাকে কেন্দ্র করে অরবিন্দকে নিয়ে সারা দেশে সঞ্চারিত এক অদ্ভুত আলোড়ন। অরবিন্দ এতদিন ছিলেন বাংলাদেশের নেতা, ‘বন্দেমাতরম’ মামলার কারণে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে।
‘Madras Standard’ পত্রিকায় লেখা হয়— ‘বাংলার বাইরে খুব অল্প লোকেই অরবিন্দের নাম শুনেছে। এমনকী Londan Times পর্যন্ত এই ভুল ধারণা পোষণ করে আসছে যে, বন্দেমাতরম পত্রিকার শাঁসালো এবং ঝাঁঝালো প্রবন্ধগুলি সবই বিপিনচন্দ্র পালের লেখা। কিন্তু এখন সে ভুল দূর হল, এখন সকলেই জানতে পারল যে— অরবিন্দই the power behind the paper.’
বন্দেমাতরম কাগজখানি চলছিল একটি কোম্পানির অধীনে। রাজা সুবোধ মল্লিক ছিলেন সেই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণের পর পুলিস জানতে পারে— এই পত্রিকার সঙ্গে বিপিনচন্দ্র পাল কতটা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সুতরাং অভিযুক্ত প্রবন্ধগুলির লেখক ও সম্পাদক সম্বন্ধে বিলক্ষণ অবগত আছেন বিপিন পাল। কাজেই তাঁকে তলব করা হল সাক্ষী হিসেবে। ঘটনাচক্রে বিপিন পাল জড়িত হলেন এই মামলায়।
চিত্তরঞ্জন দাশ প্রথম জীবনে বিপিন পালের অনুগামী, ক্রমশ হয়ে ওঠেন অন্তরঙ্গ, শেষ জীবনে চিত্তরঞ্জনের অনুরাগী বিপিন পাল। বন্দেমাতরম মামলার সময় দু’জনেরই সম্পর্ক অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। তখন নির্বাসিত লালা লাজপত রায় মান্দালয় দুর্গে বন্দি।
এমন পরিস্থিতিতে বিপিন পালকে চিত্তরঞ্জন বললেন, ‘আপনি চারমাস পূর্বে মাদ্রাজে যে প্রলয়ঙ্কর বক্তৃতা দিয়েছেন, তাতে লাজপত রায়ের মতো আপনাকেও সরকার অনির্দিষ্ট কালের জন্য মান্দালয় দুর্গে নির্বাসনে পাঠাতে পারে। আর যদি এই মোকদ্দমায় আপনি সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন, তবে আদালত অবমাননার জন্য বড়জোর ছয় মাস জেল হবে। অনির্দিষ্টকালের জন্য মান্দালয় জেলে বন্দি হওয়ার চেয়ে বড়জোর ছয় মাস জেল অধিকতর লোভনীয় শাস্তি।
চিত্তরঞ্জন আরও বলেন, দেখুন— আপনি সাক্ষ্য না দিলে পুলিস প্রমাণাভাবে অরবিন্দকে জেলে দিতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, পুলিস বন্দেমাতরম পত্রিকাটিও বাজেয়াপ্ত করতে চায়। আপনি সাক্ষ্য না দিলে কাগজখানিও বেঁচে যায়। সেই সঙ্গে বাংলার চরমপন্থী দলও রক্তক্ষরণ থেকে নিস্তার পায়। সুতরাং দেশের জন্য এই vicarious martyrdom আপনি করুন।’
ভেবে পান না, কী উত্তর দেবেন? তখন বিপিন পালের এক অদ্ভুত মুখাবয়ব। পরাধীনতার গ্লানি দেশে-বিদেশে তাঁকে কম সইতে হয়নি। একবার তিনি আমেরিকায় যখন বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার একজন বলেছিলেন, ‘আগে তোমরা স্বাধীন হও, তারপর এদেশে এসে তোমাদের ধর্ম, দর্শন সম্বন্ধে বক্তৃতা দিও। তখন আমরা শুনব।’
তাঁর মুখাকৃতি নিবেদিতার কাছে কীরূপ প্রতিভাত হতো সে সম্বন্ধে স্বয়ং বিপিন পাল ‘মার্কিনে চারিমাস’ গ্রন্থে লিখেছেন— ‘আমাদের ফলিত জ্যোতিষে মানুষের একটা গণ নির্দিষ্ট হইয়া থাকে, কেহ দেবগণ, কেহ বা নরগণ, কেহ বা রাক্ষসগণ। নিবেদিতার কোন গণ ছিল জানি না, আমারই বা কি গণ সে কথাও মনে নাই। কিন্তু আমাদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা হইলেই সেই প্রথম দিন অবধি যেরূপ দৈব দুর্ঘটনা ঘটিত, তাহাতে নিবেদিতার দেবগণ এবং আমার রাক্ষসগণ, এ অনুমান নিতান্ত অসঙ্গত হইবে না। কারণ দেখা হইলেই একটা ঝগড়া পাকাইয়া উঠিত। অথচ আশ্চর্যের কথা এই যে, এই ঝগড়ার দরুন উভয়ের মধ্যে কাহারও মনে এক মুহূর্তের জন্যও বোধহয় কোন বৈরিতার লেশমাত্র জাগে নাই।’
বিপিন পাল-নিবেদিতার বিরামহীন বিবাদের পরিহাস-সৌরভ উপভোগ করতেন জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ।
জগদীশচন্দ্র ১৯০০ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতা থেকে বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে জানান— ‘এবার আমেরিকা হইতে বিপিনচন্দ্র পালের একখানা চিঠি দেখিলাম। তাঁহার সহিত নিবেদিতার তুমুল সংগ্রাম হইয়াছে। বিপিনবাবু এবং নিবেদিতা Mrs. Bull-এর বাড়িতে অতিথি ছিলেন। সেখানে বিপিনবাবু বিবিধ প্রকার pleasant কথাই বলিতেছিলেন, কিন্তু দৈবের নির্ব্বন্ধ! সেখানে একটি meeting হয়, তাহাতে নিবেদিতা জাতিভেদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করিতেছিলেন, বিপিনবাবু চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন। হঠাৎ নিবেদিতার মনে হইল যে, ব্রাহ্মেরা জাতিভেদ মানে না এবং স্বামীর প্রতি [বিবেকানন্দ] তাহাদের ভক্তি অপরিমিত নহে। অমনি বলিলেন, আমি জানি যে এই meeting-এ একজন আছেন যিনি জাতিভেদ মানেন না এবং সনাতন ধর্ম্মের উপর যাঁহার আস্থা নাই। তাহার পর বিপিনবাবুকে রণং দেহি বলিয়া challenge করিলেন। এইরূপ আকস্মিক রূপে আক্রান্ত হইয়া বিপিনবাবু বলিলেন যে, জাতিভেদের অনেক সদ্গুণ আছে, তবে কিছু কিছু অসুবিধাও আছে। It keeps down men of genius, for example, Swamiji could not have had so much inffluence যদি জাতিভেদ থাকিত। ব্রাহ্মণের একাধিপত্যে নিম্নজাতির উত্থান দুরূহ হইত। আর কোথা যায়! মনে করিতে পারেন [বিবেকানন্দ] স্বামীর সম্বন্ধে এরূপ কথা! অমনি এক Scene; পরিশেষে ঘোরতর ঘৃণার সহিত নিবেদিতা বলিলেন যে, ব্রাহ্মরা হিন্দুও নহে, খৃস্টানও নহে আর বিপিনবাবুকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, তুমি মৎস্যও নহ, মাংসও নহ!!
আপনাকে সমস্যা দিতেছি, বিপিনবাবু তবে কি? সে যাহা হউক, এরূপ অসাধারণ ভক্তি অতি দুর্ল্লভ।’
একবার আমেরিকায় অর্থ সংগ্রহের জন্য নিবেদিতা বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার মাঝে কয়েকদিনের জন্য আসেন বস্টনের কেম্ব্রিজ শহরে মিসেস বুলের বাড়িতে। বিপিন পাল মিসেস বুলের পূর্ব পরিচিত। তখন তিনিও আতিথ্য নিয়েছিলেন সেখানে। পরিচয়ের প্রথম পর্বেই নিবেদিতার সঙ্গে কীভাবে একের পর এক ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন সে-সম্বন্ধে বিপিন পাল লিখেছেন—
‘প্রাতঃরাশে বসিয়া স্বভাবতই কলিকাতার কথা উঠিল। আমি ব্রাহ্মসমাজের লোক, নিবেদিতা ইহা জানিতেন। আর ব্রাহ্মসমাজের প্রতি তাঁহার একটা গভীর অশ্রদ্ধা ছিল। নিবেদিতার স্বচ্ছ চিত্তে কখনও কোনও মনোভাব ঢাকা পড়িত না। সুতরাং সৌজন্যের খাতিরেও আমার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়ের দিনে তিনি তাঁহার অন্তরের অশ্রদ্ধা গোপন করিতে পারিলেন না। একেবারে সোজাসুজি আমাকে লক্ষ্য করিয়া ব্রাহ্মসমাজকে আক্রমণ করিলেন।’
সেদিন বিকেলে মিসেস বুলের প্রতিবেশী ডাঃ জোন্সের বাড়িতে এবং আবার মিসেস বুলের বাড়িতে বিদ্যালয় শিক্ষয়িত্রী-সম্মেলনে বিপিন পালের সঙ্গে আরও ‘দুই দফা সংগ্রাম’ হয়ে যায় নিবেদিতার।
নিবেদিতা শিক্ষয়িত্রীদের সঙ্গে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কথা বলছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ে জাতিভেদের কথা। আলোচনায় যোগ দেন বিপিন পাল এবং কথায় কথায় বলেন— হিন্দুর এই জাতিভেদ ভারতের মনুষ্যত্বকে পঙ্গু করে রেখেছে। নিবেদিতা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন— ‘ও কথা ঠিক নয়। আপনি ব্রাহ্ম বলে হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করছেন।’
অনেক কথার পর বিপিন পাল বললেন— ‘প্রচলিত শাস্ত্রের প্রাচীন প্রভাব বিদ্যমান থাকলে ব্রাহ্মণের কাছে ধর্মপ্রচার বিবেকানন্দের পক্ষে অনধিকার চর্চা বলেই মনে হতো।’
এ-কথায় ক্রোধে জ্বলে উঠলেন নিবেদিতা। বললেন— ‘It is a lie. The Swami has been accepted as the Guru of the Hindus.’
উত্তরে বিপিন পাল বললেন— ‘স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুদের ধর্মগুরু নন। হিন্দুসমাজ তাঁকে গুরুরূপে গ্রহণ করেনি। তিনি রাজা রামমোহন রায় প্রমুখের মতো একজন ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক মাত্র।’
এরপরের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন স্বয়ং বিপিন পাল— ‘নিবেদিতার কোমল প্রাণে এ আঘাত সহ্য হইল না। আমার কথায় তাঁহার গুরুর অপমান হইয়াছে মনে করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। কিন্তু সে কথা তো মুখ ফুটিয়া বলা যায় না। কহিলেন, যখন তখন তোমরা আমাদের স্ত্রীলোক বলে অপমান কর। আমি কহিলাম, স্ত্রীলোক বলিয়া অপমান করি না, সম্মান করি। এতটা সম্মান করি বলিয়াই আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী কহিলেন, অথচ তাহার যথাযোগ্য জবাব আমি দিতে পারিলাম না।’
ফিরে আসা যাক— ১৯০৭-এর ২৬ আগস্টে। সেদিন বন্দেমাতরম মোকদ্দমায় কিংসফোর্ডের আদালতে সাক্ষীমঞ্চে দাঁড়িয়ে বিপিন পাল। তাঁর সাক্ষ্য না দেওয়ার কৈফিয়তের খসড়া রাতারাতি মুসাবিদা করে দেন চিত্তরঞ্জন দাশ। সেই অনুযায়ী সাক্ষীমঞ্চে দাঁড়িয়ে বিপিন পাল সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন— ‘I have conscientious objection against taking part in a prosecution which I belive to be unjust and injurious to the cause of popular freedom and the interest of public peace.’
বিপিন পালের এই অভিনব ও অপ্রত্যাশিত জবাবের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিপিন পাল স্থাপন করলেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ যেন ইতিহাসের এক ‘পাশমোড়া দেবার সময়’।
১৯২১ সালের মার্চে বরিশালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক সভায় একটি গল্প শুনিয়েছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। সেই গল্পটি আবার শঙ্খ ঘোষ বলেছেন তাঁর ‘ভিন্ন রুচির অধিকার’ গ্রন্থে।
গল্পে আছে, জনাপাঁচেক মাতালের মধ্যে একজন একেবারে নড়াচড়া করছে না দেখে অন্যেরা সাব্যস্ত করেছিল যে, সে মারা গিয়েছে। সৎকারের জন্য তাকে কাঁধে তুলে নিমতলা ঘাটে যাবার পথে মৃতটি হঠাৎ একবার পাশ ফিরে শুল। দেখে একজন বলে উঠল, ‘ওরে, ও তো মরেনি, পাশমোড়া দেয় যে!’ শুনে আরেকজন গম্ভীর স্বরে বলল, ‘এই মড়া এই অবধিই মরে। চল।’
অশ্বিনীকুমারের মনে হয়েছিল, আমাদের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন ছিল সেইরকম এক পাশমোড়া দেওয়া, মৃতকল্প জাতির আকস্মিক এক পাশমোড়া, তারপর আবার ঘুম। আর এর অনেকদিন পর, অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা দেখে তাকে তিনি ভাবছিলেন যেন ‘দ্বিতীয়বারের পাশমোড়া’।
কিংসফোর্ডের আদালতে উদগ্রীব জিজ্ঞাসু জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বিপিন পাল জানান, সাক্ষ্য দিতে তাঁর বিবেকের বারণ। কেন বারণ, তার স্বরূপ উদ্ঘাটনে বলেন, তাতে বিঘ্নিত হবে মানুষের স্বাধীনতা ও শান্তি। স্বদেশবাসীর স্বাধীনতার জন্য বেছে নিলেন অসহযোগের পথ, আইন অমান্য করে জেলে যেতে প্রস্তুত। এটাই বাংলার স্বদেশি যুগের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ।
অরবিন্দ বললেন, বিপিনচন্দ্রই নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের প্রথম প্রবর্তক ও প্রচারক।
মাত্র পঞ্চাশ টাকার জামিন-অঙ্গীকার পত্র নিয়ে সেদিনের মতো বিপিন পালকে ছেড়ে দিয়ে পরের দিন হাজির হতে বলা হয় আদালতে।
পরের দিনও আদালতে উপস্থিত হয়ে তিনি একই সুরে বললেন, সাক্ষ্য দিতে তাঁর বিবেকের বারণ। আদালতসুদ্ধ লোক অবাক। যেন এক তাজ্জব কাণ্ড! আদালতে দাঁড়িয়ে আদালতের হুকুম অমান্য।
বন্দেমাতরম মোকদ্দমায় বিবেকের কারণে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন বিপিন পাল। তাঁর কৌসুলি চিত্তরঞ্জন দাশ বিচারপতি রামানুগ্রহনারায়ণ সিংহের এজলাসে বলেছিলেন, ‘মানুষের বিবেক এমনি এক শাণিত তরবারি, যা দ্বারা ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন কোনও বন্ধন নেই যা ছেদন করা যায় না।’
বিপিনচন্দ্রের বিনাশ্রমে ছয় মাস কারাদণ্ড হল। ১৯০৭-এর ১১ সেপ্টেম্বর বন্দি বিপিনচন্দ্র হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা হলেন বক্সার জেলে। পরের দিন বন্দেমাতরম পত্রিকায় অরবিন্দ লিখলেন এক অগ্নিদীপ্ত প্রবন্ধ ‘The Martyrdom of Bepinchandra’।
সহিংস চরমপন্থা বা গীতা সম্বন্ধেও বিপিন পাল ও অরবিন্দের মধ্যে রয়েছে বিরাট মতপার্থক্য। অরবিন্দ লিখেছেন— ‘বন্দেমাতরম শীর্ষক প্রবন্ধে আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু বিপিনচন্দ্র পাল অর্জ্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনের উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন যে, ইহা সম্পূর্ণ অসত্য, কবির কল্পনা মাত্র। আমরা এই কথার প্রতিবাদ করিতে বাধ্য। ... বিশ্বরূপ দর্শন কল্পনা নয়! উপমা নয়, সত্য; অতিপ্রাকৃত সত্য নহে— কেন না, বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্গত, বিশ্বরূপ অতিপ্রাকৃত হইতে পারে না। বিশ্বরূপ কারণজগতের সত্য, কারণজগতের রূপ দিব্যচক্ষুতে প্রকাশ হয়। দিব্যচক্ষু প্রাপ্ত অর্জ্জুন কারণজগতের বিশ্বরূপ দেখিলেন।’
উত্তরে বিপিন পাল লিখলেন, ‘অর্জ্জুন যাহা দিব্যচক্ষে আপনার অন্তরে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, তাহা মিথ্যাও নহে, কল্পনাও নহে। তাহা সত্য। সে সত্য অ-প্রাকৃত। গীতায় সে সত্যের ছবি নাই। ভাষা অ-প্রাকৃত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করিতে পারে না।’
অরবিন্দ ও বিপিন পালের এই মতপার্থক্যেই প্রতীয়মান দু’জনের জীবনদৃষ্টি। জীবনের ভোরবেলায় অরবিন্দ কতটা mystic, কতটা বিপ্লবী এ এক অমীমাংসিত প্রশ্ন হলেও বলা যেতে পারে, কারণজগতের রূপ ও দিব্যচক্ষু সম্বন্ধে অরবিন্দ যতটা নিঃসংশয়, বিপিনচন্দ্র ততটা নয়। অরবিন্দের দৃষ্টি রহস্যে পূর্ণ, আর বিপিনচন্দ্রের দৃষ্টি যুক্তির প্রখর কিরণে প্রদীপ্ত।
(চলবে)
14th August, 2022