যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯০৭ সাল। আদালতে ইংরেজ কৌঁসুলি মিঃ গ্রেগরি প্রাণপণ চেষ্টা করেন ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় বিস্ফোরক প্রবন্ধগুলির জন্য অরবিন্দকে দায়ী সাব্যস্ত করতে। আলিপুর বোমা মামলার সময়ও বারংবার বন্দেমাতরম পত্রিকার প্রাণপুরুষরূপে অরবিন্দের ভূমিকার কাটাছেঁড়া হয় আদালতের সওয়াল-জবাবে।
ক্ষুরধার বুদ্ধি চিত্তরঞ্জন আলিপুর বোমা মামলার সময় শান্ত মাথায় যুক্তি সাজিয়ে বলেন, অরবিন্দ জাতীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। জাতীয় বিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনীতির সংস্রবমুক্ত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। কাজেই চরমপন্থী রাজনীতির মুখপত্র ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক তিনি হতে পারেন না।
১৯০৭-এর ২৩ সেপ্টেম্বর ‘বন্দেমাতরম’ মামলায় অরবিন্দ ছাড়া পেয়ে যান প্রমাণাভাবে। বিপিন পাল বিবেকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বন্দেমাতরম মোকদ্দমায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করে বরণ করেন ছয়মাসের কারাবাস। বক্সার জেল থেকে তিনি মুক্তি পেলে ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় ১৯০৮-এর ১০ মার্চ অরবিন্দ ‘ওয়েলকাম টু দি প্রফেট অব ন্যাশন্যালিজম’ সম্পাদকীয়টি লেখেন।
জীবনসায়াহ্নে বিপিন পাল ‘বন্দেমাতরম-এর অরবিন্দ’ শীর্ষক এক অনবদ্য নিবন্ধে লেখেন, ‘ভারতের জাতীয় আন্দোলনের পুরোভাগে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে বয়সে তরুণতম হলেও অবদানে, শিক্ষায় এবং চরিত্রে হয়তো তাঁদের সকলের জ্যেষ্ঠ— অরবিন্দ যেন বিধাতারই চিহ্নিত পুরুষ, যাঁকে এই আন্দোলনে এমন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে, যা তাঁর অন্য কোনও সহকর্মী বা সমসাময়িকের অদৃষ্টে লেখা নেই। ... তাঁর একমাত্র ধ্যান হলেন দেশজননী... যাঁকে তিনি মা বলেই উল্লেখ করেছেন।’
বন্দেমাতরম পত্রিকাটির অনুষঙ্গে বিপিন পাল লেখেন— ‘...নতুন পত্রিকাটির (বন্দেমাতরম) সর্বাধিনায়ক, কেন্দ্রীয় পুরুষ ছিলেন অরবিন্দ! জাতীয় কলেজে যে-সুযোগ তিনি পাননি, তা তিনি পেলেন বন্দেমাতরমের সম্পাদনাকালে, এবং কয়েকশত ছাত্রের আচার্য পদ থেকে তিনি বৃত হলেন সমস্ত জাতির আচার্যপদে! ...
অতুলনীয় এই মহামানবের হাত পত্রিকার সূচনা থেকেই ছিল। দিনের পর দিন সকালে, কেবলমাত্র কলিকাতার নয়, সারা দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত, সে-যুগের উদ্দীপনাপূর্ণ সমস্যাগুলি সম্বন্ধে তাঁর বজ্রকঠোর মতামতের পথ চেয়ে। এমনকী, গতানুগতিক আত্মতৃপ্ত বৃটিশ সাংবাদিকদের মনেও তা গভীরভাবে রেখাপাত করল। বন্দেমাতরম পত্রিকা থেকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ যাবৎ উদ্ধৃতি ছাপা হতে লাগল লন্ডনের The Times হেন পত্রিকার স্তম্ভে এবং নতুন পত্রিকাটির সর্বাধিনায়ক কেন্দ্রীয় পুরুষ ছিলেন অরবিন্দ।’
অরবিন্দ যখন ‘বন্দেমাতরম’-এর প্রধান লেখক বা কর্ণধার, জীবনের এই পর্বে অরবিন্দ-অনুরাগী রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত পড়তেন ‘বন্দেমাতরম’। ১৯০৭-এর ২৪ আগস্ট লিখলেন ‘নমস্কার’— অর্থাৎ ‘অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার’ কবিতাটি। আত্মোৎসর্গে অগ্নিবজ্র অরবিন্দকে ‘স্বদেশ আত্মার বাণীমূর্তি’ অভিধায় বরণ করে কবিতাটি লিখে পাঠিয়ে দেন তাঁকে। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায়, ‘বঙ্গদর্শনে’ও।
দু’দিন পরে আমেরিকায় ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে কবি জানান— ‘Statesman কাগজের চাঁদা ফুরলেই আর পাঠাব না। এখন থেকে বন্দেমাতরম কাগজ পাঠাতে থাকব। ওটা খুব ভালো কাগজ হয়েচে। কিন্তু অরবিন্দকে যদি জেলে দেয় তাহলে ও কাগজের কী দশা হবে জানিনে। বোধ হয় জেল থেকে সে নিষ্কৃতি পাবে না। আমাদের দেশে জেল খাটাই মনুষ্যত্বের পরিচয়স্বরূপ হয়ে উঠচে। জেলখানার ভয় না ঘোচাতে পারলে আমাদের কাপুরুষতা দূর হবে না। দু’-চারজন করে জেলে যেতে যেতে ওটা অভ্যাস হয়ে যাবে— বিশেষ কিছু মনেই হবে না। যেমন আমাদের ম্যালেরিয়া আছে— মাঝে মাঝে ভুগচি, মাঝে মাঝে সারচে, মাঝে মাঝে মরচিও— জেলখাটাও আমাদের ভদ্রসমাজের তেমনি একটা নিত্যনৈমিত্তিক অনিবার্য আধিব্যাধির মধ্যে গণ্য হয়ে উঠবে।’
কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর পিসিমার সপত্নী রাজলক্ষ্মী দেবী দেখাশোনা করতেন রবীন্দ্রনাথের নাবালক সন্তানদের।
তখনকার ঘনায়মান অস্থির রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন রাজলক্ষ্মী দেবী। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়েই রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করতে ইংরেজ পুলিসের বিলম্ব হয়নি— অরবিন্দের প্রতি ‘নমস্কার’ জানানোয় ব্রহ্মচর্যাশ্রমেও শ্যেনদৃষ্টি পড়ে পুলিসের গুপ্তচরদের। তাই কবির পরিবারের আনন্দ-বেদনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ‘পিসিমা’র রবীন্দ্রনাথের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না। ১৯০৭-এর ৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় রথীন্দ্রনাথকে লিখিত দিদিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর এক চিঠিতে জানা যায়— অগ্নিযুগের অগ্নিগর্ভ দিনগুলোয় পুলিসের এক গুপ্তচরকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কীভাবে মোকাবিলা করেন। তিনি লেখেন—
‘তোরা জানিস তো, রাজভক্ত বলে বাবার কোনও কালেই ইংরেজ মহলে প্রতিপত্তি নেই, বন্দেমাতরম কাগজের Editor অরবিন্দ ঘোষকে prosecute করেছে, সে খবর তোরা অবশ্য জানিস— বাবা সম্প্রতি অরবিন্দ ঘোষকে আশীর্ব্বাদ করে একটা কবিতা লিখেছেন, কলকাতাময় সেটা ছড়িয়ে পড়েছে, এই মাসের (ভাদ্র) বঙ্গদর্শনেও বার হয়েছে,— তাতে তিনি রাজভক্তির খুব পরিচয় দেননি, কাজেই রাজপুরুষদের খর নজর বাবার উপরে পড়েছে। কাল তাহার একটা উদাহরণ পাওয়া গেছে। হঠাৎ সকালে একটা লোক এসে হাজির অর্থাৎ কি না স্কুল দেখবো— প্রথম থেকেই লোকটার উপর বাবার সন্দেহ হয়েছিল— তিনি কোনগতিকে প্রথমে স্কুলের মাস্টারদের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নিষ্কৃতিলাভ করলেন— কিন্তু সে কি তা শোনে— ঘুরে ফিরে ক্রমাগত খোঁজতল্লাশ করতে লাগলো, আমাদের ছেলেরা লাঠি অভ্যেস করে কি না, বন্দুক ধরে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ... দুপুরের আহারের পর অনেকক্ষণ ধরে বাবাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করছিল, ভান করতে লাগলো সে যেন আমাদের মত একটা বিদ্যালয় খাড়া করতে চায়— সব ভেতরকার খবর যেন আমরা তার কাছে খুলে বলি,— বাবা আমাদের বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বেশ করে বুঝিয়ে দিলেন, কিন্তু সে মূর্খ তা বুঝবে কেন,— আমরা ছেলেদের লাঠিখেলা শেখাচ্ছি কি না, আর রাজবিদ্রোহসূচক কোন শিক্ষা ছাত্রদের দিচ্ছি কি না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেবল সেই কথাই জানবার চেষ্টা করতে লাগলো। ... সন্ধ্যের সময় যখন বাবা তাকে স্পষ্টাস্পষ্টি বল্লেন, মহাশয় চলুন আপনাকে আমাদের সব ঘরদুয়ার দেখাচ্ছি— কোন ঘরেই কামান গোলা বারুদের সন্ধান পাবেন না— তখন লোকটা থতমত খেয়ে এখান থেকে ঠিক সন্ধ্যের পরেই চলে গেল, বহু অনুরোধেও থাকলো না।’
রবীন্দ্রনাথের ‘নমস্কার’ কবিতাটি ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে পুলিসের খাতায় তিনি ‘দাগী’ রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই ছদ্মবেশে লোক শান্তিনিকেতনে এসে খোঁজখবর নিত। সে সময় ‘অভয়ব্রতী’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল ছিল শান্তিনিকেতনে। তারা বিউগল ধ্বনিতে নির্দেশ দিত। ছদ্মবেশী পুলিসেরা বিউগলের আওয়াজে আরও সন্দিহান হয়ে উঠত।
এরপর দেশের কাজ করবার পদ্ধতি নিয়ে অরবিন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তৈরি হয় মতবিরোধ। এই মতান্তর প্রকাশ পায় দু’জনেরই রচনায়। অরবিন্দ ও তাঁর দেশসেবক দলের উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে সুসংগতির অভাব ধরা দেয় কবির চোখে। তা তিনি ব্যক্ত করেন তাঁর রচনায়। ফলে বেড়ে যেতে থাকে তাঁদের দূরত্ব।
অরবিন্দকে আলিপুর বোমার মামলায় অবধারিত মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা থেকে বেকসুর খালাস করে চিত্তরঞ্জন হয়ে ওঠেন এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি আইনজ্ঞ।
১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে দিলীপকুমার রায়কে জানিয়েছিলেন— ‘শ্রীঅরবিন্দ আত্মসৃষ্টিতে নিবিষ্ট আছেন। তাঁর সম্বন্ধে সমাজের সাধারণ নিয়ম খাটবে না। তাঁকে সসম্ভ্রমে দূরেই স্থান দিতে হবে— সব সৃষ্টিকর্তাই একলা, তিনিও তাই। আমাদের অভিজ্ঞতা সেইখানেই যেখানে জমেচে সকলের সঙ্গ— তাঁর উপলব্ধির ক্ষেত্র সকল জনতাকে উত্তীর্ণ হয়ে। কিন্তু আমরা সেটা সহ্য করি কেন? যে জন্যে মেঘকে সহ্য করি দূর আকাশে জমতে শেষকালে বৃষ্টি পাওয়া যাবে চাষের জন্যে তৃষার জন্যে।’
সেই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের দার্শনিক-অধ্যাপক মহেন্দ্রনাথ সরকার একটি বই লেখেন— ‘Eastern Light’। মহেন্দ্রনাথের আর একটি বইয়ের নাম ‘Hindu Mysticisum’।
শোনা যায়, কবির সাহায্য নিলেও Eastern Light গ্রন্থে মহেন্দ্রনাথ কোথাও উল্লেখ করেননি তাঁর কথা। এনিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় কারও কারও মনে। আবার কবির অরবিন্দ বিরূপতার মিথ্যে প্রচারেও যার পর নাই ব্যথিত হন রবীন্দ্রনাথ। দিলীপকুমার রায়ের এক বন্ধুর কাছ থেকে তেমন আভাস পেয়ে কবি ১৯৩৫-এর ৭ সেপ্টেম্বর দিলীপকুমারকে লেখেন এক অতি মূল্যবান চিঠি। রবীন্দ্র-অরবিন্দ সম্পর্ক সন্ধানের ক্ষেত্রে যে চিঠির মূল্য অপরিমেয়। কবি লেখেন— ‘তোমার বন্ধুর পত্র পড়ে আমি দুঃখিত হয়েছি কিন্তু বিস্মিত হইনি। আমার দেশে আমার সম্বন্ধে ভুল বোঝা এত বহু প্রচারিত যে তার আঘাত আমাকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে, অধিকাংশ স্থলেই আমি তার প্রতিবাদ করিনে। আজ এই চিঠি লিখছি তার একমাত্র কারণ শ্রীঅরবিন্দ সম্বন্ধে আমি অশ্রদ্ধা বহন করি এই মিথ্যা উক্তিকে নীরবে অগ্রাহ্য করা আমি অন্যায় মনে করি।
তোমার বন্ধু স্থির করেছেন Eastern Light গ্রন্থে আমার কোনও উল্লেখ নেই বলেই আমি শ্রীঅরবিন্দের বিরুদ্ধে কটাক্ষপাত করেছি। বিশ্বাস করো বা না করো একটা কথা জানিয়ে রাখি আমি নিজেকে কখনোই সাধক বলে কল্পনাই করিনে। আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে আমার অধিকার নেই এ কথা আমি নিশ্চিত জানি এবং কাউকে ভুল জানাইনে। আমার জীবনের যা কিছু সেখানে আমার প্রত্যক্ষ জ্ঞান পৌঁছয় না। আমার মন appearance-এর সীমার মধ্যেই সঞ্চরণ করে, আনন্দ পায়। তিনি যদি মনে করে থাকেন আমি শ্রীঅরবিন্দের উপর ঈর্ষা প্রকাশ করেছি, তবে সে আমার দুর্ভাগ্য। আমার পত্রের সঙ্কেত তাঁর বন্ধুর ভাষার ভিতর দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে তোমাদের কাছে না পৌঁছিয়ে যদি সমস্তটা তোমাদের হাতে পৌঁছত তাহলে হয়তো ভুল বোঝাবুঝিটা ছড়াত না। কিন্তু তাও নিশ্চিত বলতে পারিনে। কারণ আমার সম্বন্ধে তোমাদের মনের সংস্কার যদি অল্পমাত্রও প্রতিকূল থাকে তাহলে বিকৃত ধারণা সম্বন্ধে রক্ষা পাবার কোনো পন্থাই নেই।
এককালে শ্রীঅরবিন্দের প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ ছিলেম, তিনি তাঁর কোনো লেখায় আমার নামোল্লেখ করেছেন বলে আমি জানিনে, আর আজ যেহেতু আর কেউ তাঁর গ্রন্থে আমার নাম নেননি বলেই আমি একেবারে উল্টোসুর ধরব এমন অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য যদি মনে করো তবে আমার সম্বন্ধে তোমাদের সকল ব্যবহার বন্ধ করাই উচিত।
মহেন্দ্রবাবু তাঁর গ্রন্থে যদি আমার উল্লেখ করতেন আমি কুণ্ঠিত হতেম কারণ, আত্মিক সাধনায় আমি অনধিকারী এবং সাধারণ ছাত্রদের চেয়েও আমার অধিকার সামান্য। কখনো কখনো ভ্রমক্রমে আমার কাছে সাধন সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে জিজ্ঞাসু এসেছেন, আমি অনেকবারই শ্রীঅরবিন্দের কাছে তাঁদের পথনির্দেশ করেছি। কখনো কখনো বিদেশী লোকের সম্বন্ধেও এরকম ঘটনা ঘটেছে।’
অরবিন্দ ও রবীন্দ্রনাথ একে অন্যের প্রতি কতটা আগ্রহান্বিত ছিলেন, তার কিছু দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্র-দিলীপকুমারের পারস্পরিক চিঠিপত্রে। পণ্ডিচেরীর যোগীর জীবনকালেও অরবিন্দ কারও কারও সঙ্গে কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে। কবি ১৯৩৪-এর ২৫ জুন দিলীপ রায়কে লেখেন ‘শ্রীঅরবিন্দ আমার সম্বন্ধে কিছু বলেছেন। শুনতে নিশ্চিত উৎসুক আছি। নিজের আধ্যাত্মিক উপলব্ধি সম্বন্ধে আমার অভিমান নেই। বস্তুত আমি রসজ্ঞ— প্রাকৃতিক মানবিক আধ্যাত্মিক সকল বিভাগেই আমি রস পিপাসু— সেই রসের স্বাদ নেওয়া ও তাকে প্রকাশ করাই আমার কাজ বলে মনে করি— রসসমুদ্রে যাঁদের পারঙ্গমতা আছে তাঁরাই গুরু। নন্দন বনের ইন্দ্রত্ব তাঁরা পেয়েছেন। আমরা কখনো কখনো দৈবক্রমে পাই গন্ধ, পাই মধুর কণা। আমাদের দলে যাঁরা বিশেষ বড়ো তাঁরা রচনা করেন মধুচক্র, বিশ্বজন যাহে আনন্দে করেন পান সুধা নিরবধি।’
১৯২৮ সালে অক্সফোর্ড হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্রথম ভারতীয় হিসেবে আহূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ রওনা হন। মাদ্রাজে গিয়ে শরীর গেল বিগড়িয়ে— বিশ্রাম করতে বাধ্য হলেন সেখানে, তারপর স্টিমারে চলেছেন কলম্বো। যাওয়ার পথে জাহাজ থামে পণ্ডিচেরীতে। অরবিন্দ রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানান তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যাওয়ার জন্য, লোকও পাঠান কবির কাছে। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন ‘বৎসর দুই হইল শ্রীঅরবিন্দ সাধারণ লোকজনের সহিত দেখাসাক্ষাৎ প্রায় বন্ধ করিয়া দিয়াছেন; বৎসরে নির্দিষ্ট দিনে ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের দর্শন দেন ও প্রয়োজনমত পত্র লিখিয়া তাঁহার বক্তব্য বা উপদেশজ্ঞাপন করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যতিক্রম হইল।’
কবির সঙ্গে অরবিন্দের সাক্ষাৎ হল বহু বছর পরে। প্রায় এক ঘণ্টা দু’জনে কথাবার্তা বলেন— কী কথা হয় কেউই তা প্রকাশ করেননি। মাদার ছাড়া আর কেউ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ‘শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল’— বললেন কবি।
জাহাজে ফিরে এসেই লিখতে বসলেন প্রবন্ধ ‘অরবিন্দ ঘোষ’। পাঠিয়ে দেন ‘প্রবাসী’তে, প্রকাশিত হয় শ্রাবণ, ১৩৩৫ সংখ্যায়। বহুকাল পরে বিপ্লবী থেকে রূপান্তরিত ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে একান্তে আলাপচারির কথায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন— ‘প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝলাম, ইনি আত্মাকেই সবচেয়ে সত্য করে চেয়েছেন, সত্য করে পেয়েছেন। ... আমার মন বললে, ইনি এঁর অন্তরের আলো দিয়েই বাহিরের আলো জ্বালবেন। ... অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলাম— সেখানে তাঁকে জানিয়েছি— অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার। আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে, অপ্রগলভ স্তব্ধতায়, আজও মনে মনে বলে এলুম তাঁকে, অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।’
অরবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিনই ৩০ মে ইউরোপ প্রবাসী পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে কবি লেখেন— ‘পণ্ডিচেরিতে অরবিন্দের সঙ্গে দেখা করে আমার মনে এল আমারো কিছুদিন এইরকম তপস্যার খুবই দরকার। নইলে ভিতরকার আলো ক্রমে ক্রমে কমে আসবে।’
জাহাজ থেকে ওই একই দিনে তিনি কন্যা মীরা দেবীকে লিখছেন— ‘স্থির করেছি এবার ফিরে গিয়ে অরবিন্দ ঘোষের মতো সম্পূর্ণ প্রচ্ছন্নতা অবলম্বন করব— কেবল প্রতি বুধবারে সাধারণকে দর্শন দেব— বাকি ছয়দিন চুপচাপ নিজের নিঃশব্দ নির্জ্জন শান্তি অবলম্বন করে গভীরের মধ্যে তলিয়ে থাকব। অরবিন্দকে দেখে আমার ভারী ভাল লাগল— বেশ বুঝতে পারলুম নিজেকে ঠিক মত পাবার এই ঠিক উপায়।’