শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
কোলহাপুর থেকেই আমি রওনা দিলাম সৌন্দত্তির পথে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ভবানীমণ্ডপের অদূরে শিবাজি পুতলা থেকে অটো নিয়ে সিটি বাসস্ট্যান্ডে এলাম। প্রচণ্ড ভিড়ের বাসে রওনা দিলাম কর্ণাটকের পর্বতবাসিনীদেবী ইয়েলাম্মাকে দর্শন করতে। সময়টা ১৯৮৮ সাল।
রামদুর্গের পথ ধরে নিপ্পানির পার্বত্য প্রদেশে শঙ্কেশ্বর, হাক্কোড়ি, হওরগী, গোকক হয়ে ঘটপ্রভা নদীর কূলে কূলে ইয়েরগোট্টি, নোল, মানোলী অতিক্রমের পর দশ ঘণ্টারও বেশি সময় জার্নি করে অবশেষে মলপ্রভা নদীর তীরে সৌন্দত্তিতে এলাম। প্রকৃতির যে অনবদ্য রূপ সেখানে আমার দৃষ্টিগোচর হল তা এককথায় অবর্ণনীয়। দু’চারজন ছাড়া বাসযাত্রীদের প্রায় সকলেই নেমে পড়লেন এখানে। আমিও নেমে পড়লাম। বাস ওই দু’চারজন যাত্রীকে নিয়েই চলে গেল পাহাড়ের বাঁক ঘুরে ওপরে সৌন্দত্তি গ্রামে।
আমরা তাহলে এখানে নামলাম কেন? আসলে ভিড়ে ঠাসা এই বাসের প্রায় সব যাত্রীই দেবদাসী। তাঁদের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমার ভালোই পরিচয় হয়েছিল। তাঁদেরই নির্দেশে আমি নামলাম। ওঁরা বললেন, এখানকার যোগড়বামি সত্যাম্মা কুণ্ডে স্নান না করে সৌন্দত্তির মন্দিরে প্রবেশ করতে নেই। সৌন্দত্তির অধিষ্ঠাত্রী ৫১ (৫২) পীঠের অন্তর্গত দেবী ইয়েলাম্মা আছেন কোঙ্গরের (পাহাড়ের) উপর। এখানে দেবীর ‘অঙ্গ’ পড়েছিল। তাই পুণ্যকামী নর-নারীরা দেবীপক্ষে, নবরাত্রে এবং বিশেষ বিশেষ দিনে এখানে ছুটে আসেন।
আমি মুগ্ধ চোখে এখানকার দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে লাগলাম। মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাতারে কাতারে নর-নারী আসছেন এখানে। একদিকে ঘন নীল মলপ্রভার বিশাল জলধারা, অপরদিকে মরুভূমির মতো ধু-ধু করছে বালি।
তারই কোল ছুঁয়ে সার্কাসের তাঁবুর মতো ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। আর আমার পিছনে রঙিন পাথরের সুন্দরী সৌন্দত্তির সিদ্ধাচল পর্বত। মতান্তরে রামগিরি।
যাই হোক, আমার দেবদাসী সহযাত্রীদের সঙ্গে কুণ্ডের কাছাকাছি যেতেই একদল বৃহন্নলা এসে তাদের কোলে নিয়ে নাচ শুরু করে দিল। কেন এমন হল? শুনলাম যাঁরা দেবী ইয়েলাম্মার নির্দেশ অমান্য করে তারাই জন্মান্তরে বৃহন্নলা হয়ে জন্মায়। তাই কৃপাবশত দেবীর নির্দেশানুযায়ী এঁরাই হলেন এই সত্যাম্মা কুণ্ডে স্নান পূজা করানোর একমাত্র অধিকারী। আমার সঙ্গিনী দেবদাসীরা একজন বৃহন্নলা পুরোহিতকে ঠিক করলেন। তাঁরই পৌরোহিত্যে আমরা কুণ্ডস্নানের জন্য এগিয়ে গেলাম। কুণ্ডের ধারে তখন বিগতযৌবনা কয়েকজন দেবদাসী—মাথায় ইয়েলাম্মার প্রতিমূর্তি নিয়ে নাচগান করছেন। আর দলে দলে বালিকা, কিশোরী ও যুবতীরা বসে আছেন স্নানের প্রতীক্ষায়। এঁরা সবাই দেবদাসী হবেন। সত্যাম্মা কুণ্ডে স্নান করে সর্বপাপ মুক্ত হয়ে ‘নিম্মান্না’ করতে হবে। তারপর পদব্রজে অথবা গোযানে যেতে হবে ইয়েলাম্মার মন্দিরে। আগামীকাল মাঘীপূর্ণিমা। খুব ভোর থেকে দেবদাসী করণ শুরু হবে।
এখানকার নিয়মানুযায়ী মেয়েরা কুণ্ড স্নানের পর ওপরে উঠে এলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। অনেকে আবার নগ্ন হয়েই স্নান করে পোশাক পরিবর্তন করেন। এখানে পুরুষ-নারী সবাই স্নান করে পাপমুক্ত হয়ে মন্দিরে খাবার খান। কিন্তু সহস্রাধিক লোকের স্নানের ফলে কুণ্ডের যা অবস্থা হল তাতে আর স্নান করার প্রবৃত্তি হল না আমার। শুধু কুণ্ডের জল মাথায় নিলাম। সঙ্গিনী দেবদাসীরা অনেক করে বোঝালেন আমাকে, এত দূর থেকে এসেছেন আপনি, এখানকার নিয়ম রক্ষা করুন, ‘নিম্মান্না’ করুন। নাহলে এই তীর্থে আসার কোনও ফলই হবে না আপনার। আমি হাসিমুখে তাঁদের প্রণাম জানালাম।
এবার ‘নিম্মান্না’র ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। নববস্ত্র পরিধানের পর বৃহন্নলারা সবার মুখে নিমপাতা গুঁজে দেবেন। তারপর নিমপাতার গুচ্ছ কোমরের সামনে, পিছনে, দুই পাশে লাগাতে হবে ও হাতে নিমপাতা নিয়ে বৃহন্নলা নাচের তালে তালে সত্যাম্মার মন্দির প্রদক্ষিণ করতে হবে। যেহেতু আমি স্নান করিনি তাই আমাকে দিয়ে ‘নিম্মান্না’ করানো গেল না। তবে দর্শনে বাধা রইল না। তাই দেবী সত্যাম্মা, যোগীনাথেশ্বর, একনাথেশ এবং যোগড়বামি সত্যাম্মাকে দর্শন করে ধন্য হলাম। দর্শন শেষে এবার সৌন্দত্তির তীর্থভূমিতে যাত্রা। যাওয়ার আগে কোলপুরবাসিনী দেবদাসী সঙ্গিনীরা তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আনা খাবার কিছু আমাকে খাইয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘ওপরে কিন্তু দিশা পাবেন না। তাই সঙ্গ ছাড়বেন না আমাদের। আমরা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলে আপনিও রয়ে যাবেন আমাদের সঙ্গে।’ বলে দুটি টাঙ্গা ভাড়া করে পাহাড়ের উচ্চস্থানে ইয়েলাম্মার মন্দির প্রাঙ্গণে রওনা হলাম সকলে। এই পাহাড়ে গোরু টানা টাঙ্গা চলে। টাঙ্গা থেকে যেখানে নামলাম সেখানে তখন লক্ষাধিক নরনারী ও দেবদাসীদের ভিড়। তাই বহু চেষ্টা করেও ওখানে কোনও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা গেল না। অবশেষে নিকটবর্তী থানার সামনে কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা বাগানের মাটিতে খোলা আকাশের নীচে শতরঞ্চি বিছিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হল। সারারাত এইভাবে এখানেই থাকতে হবে আমাদের। এখানে শুধু আমরা নই আরও অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন।
এইভাবে রাত্রিযাপন করা হল। শেষরাতে দেবদাসীদের কয়েকজন আমাকে বললেন, ‘চলুন বাবুজি, আপনাকে দেবী দর্শন করিয়ে আনি। ভোরে দেবীকরণ শুরু হলে আর এর ধারেকাছেও যেতে পারবেন না।’ অতএব দর্শনে চললাম। সে কী প্রচণ্ড ভিড়! মাঘ মাসের এই রাত্রি শেষেও ঘেমে উঠলাম। অবশেষে খাপটির মধ্যে পৌঁছলাম মন্দিরে। আহামরি মন্দির নয়। তবুও সতীদেহ প্রভাবে এত মান্যতা দেবীর। দেবী এখানে ভয়ঙ্করী। ইনি ইয়েলাম্মা। তাঁর নির্দেশ অমান্য করলে ফল ভালো হয় না। বহুকষ্টে সেই দেবীকে দর্শন করে মনোবাসনা পূর্ণ করলাম। মন্দিরের অন্যপ্রান্তে ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রতীক্ষায় শয়ে শয়ে মেয়েরা দেবদাসী হওয়ার জন্য বসে আছে। শুনলাম, দেবদাসী হওয়া মানে দেবীর সঙ্গে—বিবাহের পর আর কোনও পুরুষের সঙ্গে বিবাহ করা যায় না। যারা করে তাদের জীবনের ওপর অভিশাপ নেমে আসে। তাদের স্বামীদের অকালমৃত্যু হয় এবং দেবীগণও জন্মান্তরে বৃহন্নলা হয়ে জন্মায়। এখানকার প্রশাসনের বক্তব্য, এই প্রথার উচ্ছেদ কখনও সম্ভব নয়। অতএব এই প্রথা চলতেই থাকবে। ১৯৮৮ সালে আমি যে বছর গিয়েছিলাম সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী সে বছর মোট তিন হাজারের বেশি মেয়ে দেবদাসী হয়েছিলেন।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল