শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
শহর হিসেবে বরোদা যে খুব একটা বড় তা নয়, তবে ব্যস্ত জনপদ। ইন্দো-সেরাসিনিক স্টাইলের স্থাপত্যই বরোদার বিশেষত্ব। ‘বডোপত্রক’ অর্থাৎ বট পাতা থেকেই এই শহরের নাম বাডোদারা বা ভাদোদারা। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছিলেন বরোদা। এখন আবার পুরনো নামেই ফিরে এসেছে এই রাজকীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত শহর।
এখন বরোদার কথা থাক। পাওয়াগড়ের কথা বলি। বরোদা থেকে পাওয়াগড়ের দূরত্ব ৪৭ কিমি। পাওয়াগড় পর্বতের পাদদেশে ৫ কিমি আগে চম্পানের গ্রাম। বরোদায় এক রাত কাটিয়ে পরদিন সকালেই স্টেশন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে আমি চম্পানের যাওয়ার বাসে চাপলাম। উত্তর-পূর্ব গুজরাতের পাঁচমহল জেলায় চম্পানের বহু ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত এক প্রাচীন দুর্গ-শহর। শোনা যায়, পাটাই রাওয়াল বংশের শেষ রাজা ভানরাজ চাওড়ার এক সেনাপতির নাম ছিল চাঁপা বা চম্পা। তিনিই এই নগরীর পত্তন করেছিলেন বলে এর নাম হয় চাঁপানের বা চম্পানের। এখানেও দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহম্মদ বেগড়ার অনবদ্য কীর্তি জামি মসজিদটি।
আমি প্রায় ঘণ্টাখানেক এখানে থেকে এখানকার মসজিদ ও খণ্ডহর দেখে একটি ট্রেকার নিয়ে চলে এলাম পাওয়াগড় পর্বতের কোলে ‘মাছি’তে। জায়গাটিকে কেউ মাচি আবার অনেকে মাছিও বলেন। এখান থেকে দেড় কিমি উচ্চতায় পাওয়াগড়ের দেবীস্থান। অত্যন্ত দুর্গম ও খাড়াই পথ। তবে ১৯৮৬ সালে কলকাতার ‘ঊষা ব্লেকো লিমিটেড’ ব্রিটেনের ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সাহায্য নিয়ে মাছি থেকে ৩০০ মিটার উচ্চতায় ৭০০ মিটার লম্বা এখটি রোপওয়ে তৈরি করে দেওয়ায় যাত্রীসাধারণের খুবই সুবিধা হয়েছে।
পাওয়াগড় পর্বতে ১ হাজার ৩২৫ ফিট উঠলে বিশ্বামিত্রী নদীর উৎস দেখা যায়। কিন্তু উড়োনখাটোলায় অর্থাৎ রোপওয়েতে উঠেছি বলে সেই উৎস আমার দেখা হল না।
এবারও আমি এসেছিলাম নবরাত্রির মুখে। তাই এখানে বহু যাত্রীর সমাবেশ দেখতে পেলাম। আমি সেই যাত্রীদলের সঙ্গ নিয়েই পাওয়াগড়ের মহাকালীকে দর্শন করতে চললাম।
যাত্রাপথে দুটি প্রসিদ্ধ তালাও পড়ল। তার একটির নাম দুধিয়া তালাও, অপরটি ছাঁচিয়া তালাও। এ দুটির সম্বন্ধে প্রবাদ এই যে, একবার বিশ্বামিত্র মুনি যখন ধ্যানে মগ্ন সেই সময় তাঁর কামধেনুটি একটি গর্তের মধ্যে পড়ে যায় এবং তাকে গর্ত থেকে তোলবার জন্য বারবার মুনির কাছে আবেদন করতে থাকে। কিন্তু বিশ্বামিত্র তখন এমনই অবস্থার মধ্যে রয়েছেন যে, সেসময় তাঁর আসন ত্যাগ করে উঠে আসবার কোনও উপায় ছিল না। তাই তিনি কামধেনুকে একটু কষ্ট করেই উঠে আসতে বললেন। কামধেনু তখন বিশ্বামিত্রকে শরণ করে দুধে ভরিয়ে দিল গর্তটি। ফলে নিজের দুধে নিজেই ভেসে উঠে আসতে পারল। এই ঘটনার পর থেকেই তালাওয়ের নাম হল দুধিয়া তালাও। আর সেই দুধের ছাঁচ জমা হয়ে আর একটি যে তালাও সৃষ্টি হয়েছিল তার নাম হল ছাঁচিয়া তালাও। এর সুপেয় জলের জন্য অন্য আর এক নাম হল ‘সাস কি তালাও’। তবে পুণ্যার্থীরা এই তীর্থে এলে দুটি তালাওতেই স্নান করেন।
আমি অবশ্য স্নান না করে দুটি তালাওয়ের জলই মাথায় নিয়ে ৫২ পীঠের অন্যতম পাওয়াগড়ের কালীকে দর্শন করতে চললাম। অনেক সিঁড়ি বেয়ে পর্বতশিখরে আরোহণ করে দেবীকে প্রাণভরে দর্শন করলাম। দেবী এখানে মহাকালী হলেও মূর্তি বস্ত্রাবৃত একটি মুখবিশিষ্ট। দারুণ মহিমান্বিত এই দেবীকে দর্শন করতে কত যাত্রীরই না সমাগম হয়েছে আজ। কত মানুষ, কত পাখি, কত সৌন্দর্য বিরাজ করছে এখানে।
এই পাওয়াগড়েই জন্মেছিলেন অমর সঙ্গীত সাধক বৈজু বাওড়া। তখনকার লোক কাহিনী নিয়ে অনেক গরবা-গীতও রচিত হয়েছে। প্রকৃতির অনবদ্য সৌন্দর্য এখানকার মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে দেখা যায় সর্বত্র।
যাই হোক, সংকীর্ণ জায়গায় দেবীদর্শনে ধন্য হওয়ার পর যে সব যাত্রীরা নারকেল ভেঙে পুজো দিয়েছিলেন তাঁদেরই দেওয়া প্রসাদ প্রায় সবার কাছ থেকেই পেতে লাগলাম কিছু কিছু।
এই মহাকালী মন্দিরের মাথার উপরই আরও একটু উচ্চস্থানে আছে পিরের স্থান। যা সারা ভারতে আর কোথাও নেই।
মহাকালী মন্দিরটি ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে চৌহান বংশের রাজারা নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরে মহম্মদ বেগড়ার আমলে সাদনশা নামে এক পিরবাবা এখানে আসেন এবং এই মন্দিরের মাথায় বসবাস করতে থাকেন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি এখানে বরাবরই বজায় আছে বলে মন্দিরের পাশাপাশি পিরের স্থানও রয়েছে।
এখানকার এই পর্বতের পাওয়াগড় নামের নেপথ্যে একটি কিংবদন্তি আছে। কথিত আছে, হনুমান যখন বিশল্যকরণীর খোঁজে এসে গন্ধমাদন পর্বতকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই পর্বতের সামান্য একটু অংশ এখানে খসে পড়ে। একসেরের এক চতুর্থাংশ অর্থাৎ পউয়া বা পাওয়া। তাই থেকেই এই পর্বতের নাম পাওয়াগড়। এই দেবীস্থানকে ৫১ অথবা বাহান্ন পিঠের অন্তর্গত বলে অনেকে মনে করলেও সতী অঙ্গের কোন অংশটি যে এখানে পড়েছিল, তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেন না। তাই কারও কারও মতে এটি একটি উপপীঠ।
সমুদ্রতল থেকে ২ হাজার ৭২০ ফুট উঁচু এই পাহাড়ের দু’দিকে দুইটি চূড়া। একটিতে মহাকালী এবং অপরটিতে ভদ্রকালী। আমি মহাকালী দর্শনের পর ভদ্রকালী দেখতে গেলাম। তারপর আসন্ন মেলার প্রস্তুতি দেখতে দেখতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম চারদিকে। ভারতের এই প্রসিদ্ধ দেবীপীঠে এলে তীর্থমহাত্ম্য ও অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশের গুণে ভরে ওঠে মন। দূরত্বের কারণে ইচ্ছে হলেই তো সেখানে বারবার যাওয়া যায় না, তাই অন্তরেই দেবীর আরাধনা করি।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল