বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। ভাগ্যদেবী কোনওদিনই এই মানুষটির প্রতি বিন্দুমাত্র সদয় ছিলেন না। চিরকালই তিনি তাঁর কৃপা-করুণা লাভে বঞ্চিত থেকেছেন। ফলস্বরূপ তাঁর পরিবার পরিজনকে যথেষ্ট সঙ্কটের মধ্যেই দিন কাটাতে হতো। অভাব-অনটন ছিল মতিলালের নিত্যসঙ্গী। যতদিন স্ত্রী ভুবনমোহিনী দেবী জীবিত ছিলেন ততদিন শ্বশুরবাড়ির অনুগ্রহে তাঁদের সংসার তরীটি কোনওমতে চলছিল। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ এই মানুষটির অবস্থা হয়ে উঠল নিদারুণ। আসলে মতিলালের কোনওদিনই কর্মের প্রতি কোনও রকম টান ছিল না। তিনি ভালোবাসতেন লেখালিখি করতে, আর সময় পেলেই ডুবে যেতেন বইয়ের জগতে। এর ফলে এলাকার মানুষজন তাঁকে মনে করত দুর্বোধ্য, মতিচ্ছন্ন, খ্যাপাটে।
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর যা হওয়ার তাই হল। শ্বশুরবাড়ি থেকে তিনি বিতাড়িত হলেন। পাঁচ সন্তানের হাত ধরে তিনি নেমে এলেন পথে। খঞ্জরপুর এলাকায় একটি ছোট্ট খোলার ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু হল তাঁদের ‘ভগ্ন সংসার’। তবে স্ত্রীর এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা একদমই মেনে নিতে পারেননি মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। লেখা, বইপড়া, স্বপ্নদেখা— সবকিছুই হারিয়ে গেল তাঁর জীবন থেকে। ঘর নয়, তখন তাঁর প্রিয় জগৎ হয়ে উঠল পথ। মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের সেইসময়কার করুণ পরিণতি সম্বন্ধে ‘শরৎ-পরিচয়’-এ সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘যতদিন ভুবনমোহিনী বেঁচে ছিলেন ততদিন নিরাশ্রয় হননি। তাঁর মৃত্যুর পরই মতিলাল ছেলেপুলের হাত ধরে গাঙ্গুলীবাড়ী ছেড়ে পথে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।...ভুবনমোহিনীর অভাব তাঁকে বিমূঢ় করে দিয়েছিল। মতিলালের জীবনে সকল সরসতার আদিভূত কারণ ছিলেন তিনি। তারপর কতদিন দেখা গেছে, মতিলাল পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছেঁড়া চটির উৎক্ষিপ্ত ধুলোয় কোমর পর্যন্ত ধূসর। মাথার চুলগুলোয় জট বাঁধতে শুরু করেছে। পেটে নেই ভাত, হাতে নেই পয়সা। হাত পা নেড়ে বিড় বিড় করে কার সঙ্গে কথা কয়ে কয়লাঘাটের পথে অশ্বত্থতলায় পাগলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
‘জিন’, পূর্বপুরুষের জিন উত্তরপুরুষে প্রবাহিত হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্র শরৎচন্দ্র পিতার থেকে পেয়েছিলেন লেখার সহজাত প্রতিভা ও যখন-তখন গৃহত্যাগ করার মানসিকতা। পরবর্তীকালে তিনি যখন প্রখ্যাত লেখক সেইসময় তিনি বন্ধুদের কাছে শৈশব, কৈশোরের নিদারুণ কষ্টের কথা বলে বলতেন,‘এমন দিন গেছে যখন ভগবানকে জানাতাম, হে ভগবান আমার কিছুদিনের জন্যে জ্বর করে দাও, তাহলে দু’বেলা খাবার ভাবনা ভাবতে হবে না, উপোস করেই দিন কাটবে।’ আর শোনাতেন তাঁর পিতা মতিলালের ভূত দর্শনের কথা। এই গল্পটি তিনি বহুবার বহুজনকে শুনিয়েছেন।
একবার সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়কে কথাপ্রসঙ্গে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন— তুমি ভূত মানো কী? তারপর তিনি তাঁকে শুনিয়েছিলেন কাশীতে পিতা মতিলালের ভূত দর্শনের কথা। বেশ রোমাঞ্চকর সে কাহিনী। একবার মতিলাল বেশ কয়েকদিনের জন্য কাশীতে বেড়াতে গেলেন। দিনগুলো চমৎকার কাটছে। বাবা বিশ্বনাথ, মা অন্নপূর্ণার ধাম কাশী। প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের দর্শন করে এ ঘাট-সে ঘাটে ঘুরে বেড়ান মতিলাল। একদিন কোনও এক মঠে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ হল এক ভদ্রলোকের। কাশীর বাসিন্দা। কথায় কথায় তিনি বললেন, আমার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত শালগ্রাম রয়েছেন।
আমাদের পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ এই শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। এতকাল আমার পিতৃদেব দেবপূজা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমার ওপরেই অর্পিত হয়েছে দেবপূজার ভার। কিন্তু সম্প্রতি আমরা একটা বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছি। প্রতি রাতে আমি দেবতার পূজা সাঙ্গ করে, তাঁকে তাঁর খাটে শয়ন করিয়ে মশারি টাঙিয়ে পুজোর ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। বেরনোর সময় ঠাকুর ঘরে আমিই তালাচাবি লাগাই। কারণ বিগ্রহের অঙ্গে বেশকিছু সোনাদানা আছে।
মতিলাল এই কথাগুলি শুনে বললেন, বাঃ বেশ তো। পুজো করেন তাতে সমস্যা কোথায়?
ভদ্রলোক বললেন, সমস্যাটা শুরু হয় রাত এগারোটা-বারোটা নাগাদ। বন্ধ ঠাকুরঘরের ভেতর থেকে তখন ভেসে আসে ঘণ্টার আওয়াজ। একদিন সাহস করে ঘরে ঢুকে দেখি, ঘর লণ্ডভণ্ড। দেবতাকে খাট থেকে নামিয়ে এনে স্থাপন করা হয়েছে তামার টাটে। সামনে আসন পাতা। কোষাকুষিতে জল, দেবতার অঙ্গে লেগে রয়েছে ফুল ও তুলসীপাতা। ঘণ্টাটিও যথাস্থানে রয়েছে। কিন্তু ঘরে কাউকে আমি দেখতে পাইনি। ঘর শূন্য। অথচ সেদিনও আমি পুজো করে বেরনোর সময় সবকিছু যথাস্থানে রেখে এসেছিলাম।
সব শুনে মতিলাল বললেন, আজ তো এখনও আপনি পুজো করেননি। আপনি অনুমতি করলে আমি আপনার পুজোর সময় ওই ঘরে থাকতে চাই।
ভদ্রলোক সানন্দে রাজি হলেন।
যথাসময়ে শুরু হল পুজো। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই তিনি পুজো করলেন। আরতির পর দেবতাকে তাঁর খাটে শুইয়ে মশারি টাঙিয়ে ভদ্রলোক মতিলালকে বললেন, চলুন এবার বাইরে যাই।
মতিলাল বললেন, না, আপনি বাইরে যান। আমি এখন এই ঘরে থাকব। রাতে কী হয় তা আমাকে দেখতে হবে। আপনারা নিজেদের ঘরে চলে যান। ঘণ্টার আওয়াজ পেলে নেমে আসবেন।
ভদ্রলোক ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন।
(ক্রমশ)
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে