কারও কাছ থেকে কোনও দামি উপহার লাভ হতে পারে। অকারণ বিবাদ বিতর্ক এড়িয়ে চলুন। স্বাস্থ্য ... বিশদ
গোটা শীতকালজুড়ে সকাল ন’টা থেকে বিকেল তিনটে—কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে-বসে ছাতে কাটাতেন আমাদের কম্বলদাদু। বৌমারা পালা করে ছাতেই দাদুর সকাল আর দুপুরের খাবার পৌঁছে দিয়ে আসতেন। কম্বলদাদুকে অবশ্য পাহারাদার সাজতে হতো। দিদিমার বানানো লেবু বা ধানি লঙ্কার আচার, নানান ধরনের বড়ি , আমসি ইত্যাদি দেওয়া হতো রোদে। আর সেই সমস্ত লোভনীয় সামগ্রীকে হাতের লম্বা লাঠি দিয়ে চিরক্ষুধার্ত কাকেদের হাত থেকে রক্ষা করতেন কম্বলদাদু।
মাঝেমধ্যে ‘হট’, ‘হাট’, ‘হুস’, ‘পালা’ আওয়াজ ভেসে আসতো পাশের বাড়ির ছাত থেকে। আওয়াজই সার! ছিয়ানব্বই পেরিয়ে কম্বলদাদু তখন এগিয়ে চলেছেন সেঞ্চুরির দিকে! যখন তখন বসে বসেই ঝিমোতেন! এই ফাঁকে কাকেরা মহানন্দে ঠোক্কর মারত বড়ির থালায়। বৌমারা ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে এসে শ্বশুরের যোগনিদ্রা দেখে ঠোঁট টিপে হাসতেন!
একদিন দুপুরে সবে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে। আচমকা চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে এল পাশের বাড়ির ছাত থেকে। বাবার পিছু পিছু আমরা দু’ভাই ছুটলাম কম্বলদাদুদের ছাতের দিকে। জানা গেল, কোনও এক ছিঁচকে চোর সুযোগ বুঝে শুয়ে থাকা দাদুর পেয়ারের তিন নম্বর লাল কম্বলটা ভ্যানিশ করে দিয়েছে!
‘এটা নিশ্চয়ই পটাচোরের কীর্তি’, বলেই কম্বলদাদুর চুরি যাওয়া কম্বল খুঁজতে দাদুর দুই ছেলে রাজকাকু আর বিরাজকাকু সিঁড়ি বেয়ে নেমে ম্যারাথন দৌড় দিলেন পটাচোরের ডেরা জঙ্গলপুরের দিকে। পেছন পেছন ছুটছে ছেলেবুড়োর দল। পটার ডেরায় পৌঁছে দেখা গেল, দরজার বাইরে জোড়া তালা! পটা ভ্যানিশ! হতাশ হয়ে ফিরে আসছে চোর-ধরার দল। কম্বলদাদুর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ভেসে এলো দাদুর আর্তনাদ, ‘ওরে! কম্বলের সঙ্গে আমার কম্বল দিয়ে বানানো গান্ধী টুপিটাও মেরে দিয়েছে চোরটা!’
‘বেশ করেছে! সারা শীতকাল মাথায় জল না দিয়ে দিয়ে জটা পাকিয়ে ফেলেছে বুড়ো! জটা ভেদ করে মাথায় শীত ঢোকে না একফোঁটাও! কোন কাজে লাগত তোমার ওই কম্বলের গান্ধী টুপি! যত্তসব!’ আগুন ঝরে পড়ছে রাজকাকু আর বিরাজকাকুর মা জাঁদরেল ক্ষমাদিদিমার গলা থেকে।
‘ভুলে যেও না, আমি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম। সার্টিফিকেট আর সরকারের দেওয়া তাম্রপত্রটা এখনও বাড়িতে আছে!’ গরগর করতে করতে বলে উঠলেন সংগ্রাম রায়চৌধুরী ওরফে কম্বলদাদু।
‘ডাহা মিথ্যে কথা! সারাদিন ঘুরে ঘুরে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের খবর জোগাড় করে থানায় পাচার করে টাকা রোজগার করতে! ছিলে পুলিসের খোঁচড়, এমএলএ-র পায়ে লিটার লিটার তেল ঢেলে মাথায় কম্বলের গান্ধীটুপি পরে নিজের নামটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকায়! পাড়াসুদ্ধ লোক জানুক, কত ‘মহান’ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলে তুমি!’ হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন ক্ষমাদিদিমা!
হাড়ি ভাঙার বিকট আওয়াজে মনে ভেসে উঠল আমাদের এখনকার পাড়া চমচমপুরের সেই সন্ধ্যেটা। সবে শুরু হয়েছে মাঘ মাস। নানা বয়সের আড্ডাবাজরা একে একে এসে জুটছেন বটতলার আড্ডায়। আড্ডা শুরু করে দিলেন অসময় কর। ‘বলুন তো, টুপি ক’প্রকার ও কি কি?’
‘টুপি দুই প্রকার। পরার টুপি আর পরানোর টুপি।’ অসময় করের প্রশ্নটা পাতে পড়তে না পড়তেই উত্তর দিয়ে দিলেন অভিনন্দন জানা।
‘এত কম জ্ঞান নিয়ে আপনারা বেঁচে আছেন কী করে! দেশি আর বিদেশি মিলিয়ে টুপি অন্তত তেত্রিশ প্রকার।’ হনুটুপিটা মাথায় গলাতে গলাতে বলে উঠলেন প্রণয় কর।
‘এই বয়সেই বুড়ো হয়ে গেলেন নাকি প্রণয়দা! একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘাম দিচ্ছে আমার। আর আপনি সূর্য ডোবার আগেই মাথায় হনুটুপি পরে ফেললেন!’ প্রণয় করের দিকে অদৃশ্য চিমটি ছুঁড়ে দিলেন শক্তি ধর।
‘বাজে বোকো না শক্তি! হাড়কাঁপানো শীত পড়বে আজ। পয়সা বাঁচাতে বাড়িতে খবরের কাগজটা পর্যন্ত রাখো না। রাখলে সকালে উঠে ওয়েদার ফোরকাস্ট থেকে জানতে পারতে আজ সম্ভবত শীতলতম দিন হবে আমাদের এই শহরে।’
‘আরিব্বাস! প্রণয়জেঠুর হনুটুপিটা দেখছি একেবারে টু পিস স্যুটের মতো! নীচের অংশ গলায় পেঁচানো। উপরের অংশটা মাথার ঢাকনা!’ চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে মজার গলায় বলে উঠলেন প্রকাশ কর।
‘আচ্ছা, হনুটুপির নামটা কি হনুমানের নাম থেকে এসেছে? তাই বা কি করে হবে! হনুমান তো আর টুপি পরে না’, ভাঁড়ের চা শেষ করে নিরীহ গলায় জানতে চাইলেন অভিনন্দন জানা।
অনেকক্ষণ থেকে কথার চিমটিগুলি সহ্য করছিলেন প্রণয়জেঠু। এবার আর থাকতে না পেরে হাতের লাঠিটা তুলে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়া করলেন অভিনন্দনকে।
‘বাপের বন্ধুর সঙ্গে চ্যাংড়ামো! আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন!’ শান্ত মানুষ হঠাৎ করে রেগে গেলে বড় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বিরাশি কেজি ওজনের থপথপে চেহারার জানাবাবু ছুটছেন শামুকের গতিতে। ওদিকে প্রায় ছ’ফুট লম্বা ছিপছিপে চেহারার প্রণয়বাবু হাতের শক্তপোক্ত লাঠিটা দু’হাতে উপরে তুলে টেনিদার স্টাইলে ইয়া লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝড়ের গতিতে পৌঁছে গিয়েছেন জানাবাবুর পেছনে। আরেকটু হলেই অভিনন্দনের মাথায় লাঠির ঘা বসিয়ে দিয়েছিলেন করমশাই! একচুলের জন্য বেঁচে গেলেন পাশের ফুটবল খেলার মাঠ থেকে সংলাপ বল দৌড়ে আসায়।
‘আহা, করেন কি, করেন কি জ্যাঠামশাই! আপনার হাতের লাঠি মাথায় পড়লে জানাকাকু তো এতক্ষণে যমরাজের দুয়ারে পৌঁছে যেতেন’, বলতে বলতে প্রণয়বাবুর হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলেন গুলিপাকানো চেহারার গোলকিপার সংলাপ।
ততক্ষণে প্রচুর লোকজন জুটে গিয়েছে চারপাশ থেকে। কেউ এসেছেন রণংদেহী প্রণয়বাবুকে আটকাতে। কেউ বা আবার এসেছেন কী হল, কী হল বলতে বলতে...খোরাক দেখতে। ওদিকে, ভয়ে-আতঙ্কে মাটিতে শুয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপছেন অভিনন্দন জানা। পাশের মাঠের ফুটবল ম্যাচ ততক্ষণে ভেস্তে গিয়েছে। চলে এসেছেন প্লেয়াররাও। উত্তেজিত করবাবু থেকে উৎসুক জনতা—সবাইকে শান্ত করে গড়পারের মাঠে বসিয়ে দিচ্ছেন ফুটবল ম্যাচের রেফারি অভয় সামন্ত।
‘অ্যাই বাপ্পা, তুই আগে প্রণয়জ্যাঠাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।’
‘যাব কী করে? এই গন্ডগোলের বাজারে আমার মাথার টুপিটা কেউ হাওয়া করে দিয়েছে’, ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন করভিলার মালিক।
‘এই নাও, আমার টুপিটা তুমি পড়ে নাও পনু’, সারা শরীর পশমের চাদরে মুড়ে নিজের হনুটুপিটা বন্ধু প্রণয়ের মাথায় পরিয়ে দিচ্ছেন অভিনন্দনের বাবা অতিরঞ্জন। ‘ওরে অভি, বংশের কুলাঙ্গার কোথাকার, জেনে রাখ, আমি আর পনু একসঙ্গে দু’সেট করে হনুটুপি কিনেছিলাম মঙলার হাটে গিয়ে’, গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলছেন রনুবাবু।
‘সামান্য হনুটুপি থেকে আরেকটু হলেই এটেম্পট টু মার্ডার কেস খেয়ে যেতেন প্রণয়জেঠু’, পেছন থেকে ভেসে এল ফচকে জগার গলা।
‘থ্রি হানড্রেড থার্টিন সি, ন্যায় সংহিতার নতুন ধারা। সিক্সটি ডেজ ননবেলেবল। এরকম কেসে জামিন পেতে কালঘাম ছুটে যায়। ষাটদিন জেলের লপসি খেয়ে কারাবাস করতে হতো জেঠুকে’, বিশেষজ্ঞের মতামত দিচ্ছেন বলহরিপুর কোর্টে সদ্য প্র্যাক্টিস শুরু করা হারাধন উকিল।
জেলখানা শব্দটা মাথায় ঢুকে পড়তেই শৈশবের স্মৃতি বুদবুদ কাটছে ঘিলুর মধ্যে। পাড়ায় কয়েকটা বাড়ি পরেই ধবধবে সাদা একটা দোতলা বাড়ি বানিয়ে উঠে এলেন এক লম্বা-চওড়া ভদ্রলোক। কয়েকদিন বাদে বড়দের কাছে জানা গেল, সন্তোষ মিত্র নামে ওই ভদ্রলোক কলকাতা হাইকোর্টের একজন জজসাহেব। বিচারপতি হিসেবে তিনি নাকি ছিলেন রীতিমতো জাঁদরেল। সকাল ন’টা বাজলেই আমরা হাঁ করে দেখতাম, পাড়ার একমাত্র দুধসাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে চড়ে হাইকোর্টের দিকে রওনা দিয়েছেন সাদা স্যুট, লাল টাই পরা জজসাহেব।
বিচারপতির গাড়ি বলে কথা! সামনের সিটে বসে জজসাহেবের গাড়ি চালাতেন যিনি, সেই ড্রাইভারের ধোপদুরস্ত প্যান্ট-শার্টের বোতাম পিতলের। মাথায় ‘ছদ্মবেশী’ সিনেমার ছদ্মবেশী ড্রাইভার উত্তম কুমারের মতো সাদা টুপি। কিছুদিন বাদে জানা গেল, যেমনতেমন ড্রাইভার তিনি নন, তিনি একজন ‘সোফার’।
বিকেলে হাইকোর্ট থেকে ফিরেই জজসাহেব সাহেবি পোশাক ছেড়ে পুরোদস্তুর বাঙালি। দুধ-সাদা ধুতির উপর গিলে করা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম চকচক করছে। সন্ধ্যা হলেই বাড়ির দরজা খুলে হাঁটতে বেরতেন জজসাহেব। বেড়াতে বেড়াতে একেকদিন চলে আসতেন পাড়ার এক-একজনের বাড়ি। আমাদের বাড়িতে যেদিন এলেন, দূর থেকে দেখেই ভয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়েছিলাম!
‘আমি কি বাঘ না ভালুক যে আমাকে দেখে খাটের তলায় ঢুকে পড়তে হবে! বেরিয়ে এসো!’ শুনেই কাঁপতে কাঁপতে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম কাঠের চেয়ারে বসে থাকা জজসাহেবের মুখোমুখি। বিচারপতির চোখ ঈগলের চাইতেও তীক্ষ্ণ। বৈঠকখানায় বসেই আমাদের শোওয়ার ঘরে বিছানার উপর লাল শালুর লেপ দেখে টেনিদার স্টাইলে লম্বা লম্বা পা ফেলে শোওয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একঝলক দেখে নিলেন গোটা ঘরটাকে।
‘লাল শালুর লেপ! ভেরি গুড! জানো, তোমার মতো বয়সে আমরা লেপের তলায় শুয়ে গোটা শীতকাল পড়াশোনা করতাম।’ বৈঠকখানার চেয়ারে বসে আমার চোখে চোখ রেখে মুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটিয়ে বলছেন সন্তোষ মিত্র।
‘আমিও লেপের নীচেই পড়ি’, জজসাহেবের হাসি দেখে ভয়ডর উধাও।
‘খুব ভালো। করো। মনে রেখো, লেপের তলায় শুয়ে পড়লে পড়া বেশি মনে থাকে।’
ভিতরের ঘরে বসে গীতাপাঠ করছিলেন ক’দিনের জন্য মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা মাতামহ। জজসাহেবের শেষ বাক্যটি শুনে হিক্কা তুলতে শুরু করলেন দাদু। মা ছুটে, রান্নাঘর থেকে গিয়ে জলটল খাইয়ে পিঠ চাপড়ে দাদুর হিক্কা থামিয়ে দিলেন।
‘এইডা আপনে কি কইলেন! লেপের তলায় শুইয়া ঘুম ভালো হইতে পারে, ল্যাখাপড়া হয় না’, জজসাহেবের উল্টোদিকে বসে ঢাকা বিক্রমপুরের ভাষায় বলে উঠলেন আমাদের গোঁসাইদাদু।
‘আলবাত হয়। একশোবার হয়’, সামনে রাখা চায়ের টেবিলটাকে এজলাসের টেবিল ভেবে হাতুড়ি ঠোকার ভঙ্গিতে পরপর দু’বার দুটো ঘুঁষি মারলেন সন্তোষ মিত্র। ‘লাল শালুর লেপের উপকারিতা আপনি কি জানেন মশাই?’ বিচারপতির বাজখাঁই গলা শুনে গোঁসাইদাদু ঢোক গিলে, ‘একটু আসছি’ বলে ভয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন!
‘গোঁসাই তো পালালেন! সবাই শুনে রাখুন, লাল শালুর লেপের নীচে দিনে অন্তত ছ’ঘণ্টা শুয়ে থাকলে গায়ের রং মাখনের মতো ধবধবে হয়ে যায়। লাল লেপের নীচে মাথা ঢুকিয়ে রাখলে মগজে ঘিলু বাড়ে,’ প্লেটে রাখা নতুন গুড়ের লালচে রসগোল্লা মুখে চালান করে মায়ের নিয়ে আসা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিচারপতি!
তখনও জাঁকিয়ে শীত পড়ত মফস্বলে। সকাল হলেই ধুনুরির দল মাথায় তুলোর বস্তা, কাঁধে লাল শালু আর চকরাবকরা তোষকের কাপড় নিয়ে হাতের ত্রিকোণ তুলো ধোনার যন্ত্রটির তারে টুঙ-টুঙ আওয়াজ করতে করতে হাঁটতে থাকতেন রাস্তা ধরে। তখনও বাঙালিত্ব বিসর্জন দিয়ে বাঙালি তোষকের বদলে ফোমের গদি আর ব্র্যান্ডেড ব্ল্যাঙ্কেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। ফলে আওয়াজ শুনে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে ডাক আসত।
আমাদের পাড়ায় ধুনুরি ঢুকলেই রবিবার সকালে প্রথমেই তাদের হাজিরা দিতে হতো জজসাহেবের বাড়ির ছাতে। প্রবল লেপপ্রেমী সন্তোষ মিত্র ধুনুরিদের রীতিমতো ট্রেনিং দিতেন জলখাবার খাইয়ে। লাল শালুর ভেতর পাতলা তুলো ঢুকিয়ে আমাকে একটা জ্যাকেট পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছিলেন! ধুনুরিদের শিখিয়েছিলেন, পুরনো লেপ কেটে মাথার টুপি বানানোর কৌশল!
‘এই পাগল লোকটাকে আর সামলানো গেল না! আগের পাড়ার অতো ভালো বাড়িটা ছাড়তে হল ‘লেপসাহেব’ উপাধির অত্যাচারে! এই বাড়িটাও বিক্রি করে পালাতে না হয়!’ সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে গজগজ করছেন জজগিন্নি। একদিন কীভাবে যেন সেকথা শুনে ফেলেছিলেন পাড়ার গেজেট পান্নাকাকু।
দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। আমাদের পাড়াতেও জজসাহেবকে দেখলেই ‘লেপসাহেব’ বলে ডাকতে শুরু করলেন অনেকে। প্রথমদিকে আড়ালে-আবডালে, পরে ভয়ডর উড়িয়ে সামনাসামনি! পাড়ার বীরেনকাকু, লক্ষ্মণকাকু, পশুপতিকাকু, স্কুলের হেডস্যার রাসমোহনবাবু মিলে ‘বিচারপতির সম্মান বাঁচাও কমিটি’ গড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন লেপসাহেবের সম্মান রক্ষা করতে। পারলেন না। হঠাৎ একদিন জানা গেল, রাতারাতি জলের দরে বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে সপরিবারে অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন ‘লেপসাহেব’।
জলের দরে সেই বাড়ি কিনে বহাল তবিয়তে বসবাস শুরু করলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার দেবানন্দ দাম। বয়স হয়েছিল লেপসাহেবের। একদিন চলে গেলেন ধরাধাম ছেড়ে। শোনা যায়, এরপর থেকেই নাকি নানান ঘটনা ঘটতে শুরু করে ‘জজকুঠি’তে। বিচারপতির মৃত্যুর একমাসের মধ্যে ওই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সাহেব। সাদা ধবধবে দোতলা বাড়িটা দিনেদিনে পোড়োবাড়ি হয়ে আজও পড়ে আছে পাড়ার এককোণে।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস