যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
বড্ড মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের কথা। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে বাঘা ঢোল বাজাচ্ছে আর গুপী নেচে নেচে গাইছে, ‘ওরে হাল্লা রাজার সেনা/তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল...।’ রাশিয়া যাওয়ার আগে সকলের মুখে শুনতাম একটিই কথা, ‘ওখানে তো যুদ্ধ চলছে!’ বাইরের দেশের মানুষরা যুদ্ধভয়ে আতঙ্কিত। কিন্তু রাশিয়া? সেখানে উল্টো ছবি। সাধারণ মানুষের মনে এনিয়ে বিন্দুমাত্র কোনও আতঙ্ক নেই।
যুদ্ধং দেহি
বারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে রাশিয়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর মূল কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ। পৃথিবীর মোট প্রাকৃতিক সম্পদের প্রায় অর্ধেক (৪৩%) রয়েছে রাশিয়ায়। নাগরিকদের অভিযোগ, সেই কারণেই দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে। ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তিকরণের চেষ্টার নেপথ্যেও রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের দখলদারির লড়াই। যুদ্ধ কি তবে ইউক্রেনবাসীর বিরুদ্ধে নাকি সেদেশের নীতির বিরুদ্ধে? ১৯৮৩ থেকে রাশিয়ায় থাকেন সুমিত সেনগুপ্ত। বাঙালি এই ব্যবসায়ীর কথায়, ‘যুদ্ধ যদি ইউক্রেনবাসীর বিরুদ্ধে হতো, তাহলে নিশ্চয়ই সেন্ট্রাল মস্কোতে ইউক্রেনের রেস্তরাঁগুলি বছরের সবদিন রমরমিয়ে চলত না!’
যুদ্ধ নিয়ে আতঙ্ক না থাকলেও চাপা ক্ষোভ আছে রুশদের। কারণ—দৈনন্দিন জিনিসপত্র ও গাড়ির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। যুদ্ধের জেরে ইউরোপে তৈরি গাড়ি ও স্পেয়ার পার্টসের আমদানি মূলত বন্ধ রাশিয়ায়। সেই সুযোগে রমরমা বেড়েছে চীনা গাড়ির। অবশ্য এই গাড়ির উপর বিশেষ ভরসা করতে নারাজ রুশরা।
নভেম্বর বিপ্লব
মনে আছে, সের্গেই আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত ছবি ‘অক্টোবর’-এর কথা? শ্রমিক সেনারা ক্রমশ এগচ্ছে লক্ষ্যপূরণের দিকে। প্রাসাদে সংরক্ষিত শিল্পসামগ্রী, অনুপম স্থাপত্যে বিভ্রান্ত সৈন্যরা। সেই সময়েই লেনিনের নির্দেশ, ‘একটি শিল্পকর্মও যেন বিনষ্ট না হয়। এই সম্পদ জনগণের সম্পদ।’
১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বাহিনী রাইফেল উঁচিয়ে এগিয়েছিল উইন্টার প্যালেসের দিকে। বিপ্লবের ১০৬ বছর অতিক্রান্ত। তবু প্রতি বছরই কিছু সংস্থা ‘নভেম্বর বিপ্লব’ নিয়ে চর্চা করে। স্পেশাল ইস্যু বের হয় পত্রপত্রিকায়। তবে বিপ্লবের সেই স্পন্দন আজও অনুভূত হয় ম্যাক্সিম গোর্কির বাড়ির সামনে দাঁড়ালে। মনে পড়ে ‘মাদার’ উপন্যাসের কথা। রুশ বিপ্লবে বিশেষ গতি এনেছিল বহু ভাষায় অনূদিত ‘মাদার’। নিজনিতে গোর্কির বাড়ি এখন মিউজিয়াম। সেখানে রাখা রচনার পাণ্ডুলিপি, পোশাক, আসবাবপত্র, টেলিফোন প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় নভেম্বর বিপ্লবের কথা। সফল বিপ্লবের পর রাশিয়া মেতে ওঠে শিল্পসৃজনের মহোৎসবে। আইজেনস্টাইন ও পুদভকিনের সিনেমা, মায়ারহোল্ডের নাট্য প্রযোজনা, গোর্কি ও গোগোলের কথাসাহিত্য, মায়াকভস্কির কবিতার মধ্যে দিয়ে। সেই ধারা আজও অব্যাহত।
বাংলা ভাষা-সাহিত্য চর্চা
বাংলার সঙ্গে রাশিয়ার যোগ সেই জারের আমল থেকে। শর্টওয়েভে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো মস্কো রেডিয়োতে। তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাঙালিরা। পিটার্সবার্গ, মস্কো সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখানোর পাশাপাশি প্রগতি প্রকাশন থেকে বাংলা ভাষায় রুশ সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশিত হতো। ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পত্রিকাও প্রকাশ করা হতো বাংলায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বন্ধ হয়ে যায় এই প্রকাশনী। বাংলা ভাষাচর্চা বা অনুবাদের কাজে যুক্ত বাঙালিরাও বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন ভারতে। প্রকাশনী বা অনুবাদের কাজ বন্ধ হলেও বাংলা ভাষাচর্চা থেমে থাকেনি। বর্তমানে রাশিয়ান স্টেট লাইব্রেরির ওরিয়েন্টাল সেন্টার অন্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুয়ারও খুলে রেখেছে। সেন্টারের ক্যাটালগিং সেক্টরের প্রধান স্মিতা সেনগুপ্তর কথায়, ‘এখানে বাংলা বই ও জার্নালের সংখ্যা ৮ হাজারের মতো। রবীন্দ্রনাথের ‘ললাটের লিখন’ পাণ্ডুলিপি সহ অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ এখানে সংরক্ষিত রয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ
রাশিয়ার কালজয়ী শিল্পী, সাহিত্যিকদের সঙ্গে আজও সম মর্যাদায় উচ্চারিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। ১৯৩০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মস্কোর বেলোরুস্কায়া স্টেশনে নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উঠেছিলেন হোটেল ‘ন্যাশানাল’-এ। সেখানে থাকাকালীন তাঁর চিত্র প্রদর্শনীও হয়। ‘ভকস্’ (All-Union Society for Cultural Relation)-এর প্রতিনিধিদের পাশাপাশি সেদেশের নানা স্তরের বহু মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রবীন্দ্রনাথের। রুশ সফরে ঠাসা কর্মসূচির মধ্যেও মস্কো আর্ট থিয়েটারে নাটক, বলশয় থিয়েটারে ব্যালে দেখেছিলেন তিনি। বাদ যায়নি সের্গেই আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত সিনেমা ব্যাটলশিপ পোটেমকিনও। পরবর্তীতে মস্কোর ফ্রেন্ডশিপ পার্কে স্থাপন করা হয় বিশ্বকবির মূর্তি।
রাশিয়ার শিল্পসাহিত্য জগতে আরও একটি নাম বহুলচর্চিত—সত্যজিৎ রায়। ‘জলসাঘর’ ছবির জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের তরফে বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন সত্যজিৎ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো রাশিয়াতেও সত্যজিতের সিনেমার অনুরাগী সংখ্যা প্রচুর।
চিত্রাঙ্গদা থেকে চিত্রা ব্যালে
একটা সময় বাঙালি পরিবারে ছিল হারমোনিয়াম-তবলা সহ সঙ্গীতচর্চার রেওয়াজ। কেউ শিখতেন নাচ। রুশ সংস্কৃতিতে সেই জায়গাজুড়ে ‘ব্যালে’। মস্কোর বলশয় থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয় পৃথিবীর সেরা ব্যালেগুলি। টিকিট মূল্য? ভারতীয় মুদ্রায় দশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত। এই ব্যালের দুনিয়ায় রাশিয়া ও ভারতকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য অবলম্বনে রুশ শিল্পীরা ১৯৬১ সালে তৈরি করেছিলেন ‘চিত্রা’ ব্যালে।
রাজ কাপুর এখনও বেঁচে?
পৃথিবীজুড়ে ভারতীয় সিনেমা ও গানের জয়জয়কার। বিশেষ করে রাশিয়ায়। তিভেরে রাস্তা সারাইয়ে ব্যস্ত ছিলেন একদল শ্রমিক। ভারতীয় শুনেই তাঁদের দু’জন মিঠুন চক্রবর্তীর নাচের সঙ্গে বাপি লাহিড়ীর গাওয়া ‘জিমি জিমি জিমি আজা আজা আজা’ গেয়ে উঠলেন। সঙ্গে সাদর আমন্ত্রণ—‘আসুন, একটু নাচি।’ পিটারহফে জারদের প্রমোদ প্রাসাদে রাজা-রানি সেজে ঘুরছেন রুশযুগল। তাঁদের সঙ্গে ছবি তোলার খরচ চারশো টাকা। হঠাৎই তাঁদের একজন বলে উঠলেন, ‘আর ইউ ইন্ডিয়ান? শশী কাপুর...শশী কাপুর...গ্রেট ইন্ডিয়ান অ্যাক্টর।’ বলিউডের জনপ্রিয়তা এমনই। মজার অভিজ্ঞতা হল গোর্কির বাসভবন ঘুরে দেখার সময়েও। কিউরেটর ইরিনা ক্রুকোভা আলাপচারিতার ফাঁকে জানালেন, ‘আওয়ারা’ সিনেমার কথা এখনও ভুলিনি। এর পরেই তাঁর প্রশ্ন— ‘রাজ কাপুর এখনও বেঁচে আছেন?’
ই-ভিসা চালু
রাশিয়ার সৌন্দর্য নয়নাভিরাম। কিন্তু সমস্যা একটাই—এখানে প্রায় সর্বত্র সবকিছু লেখা রুশ ভাষায়। গুগল লেন্স, ট্রান্সলেটর অ্যাপ ছাড়া গতি নেই। তবু কমতি নেই পর্যটকের। যুদ্ধের জেরে ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে টুরিস্টদের আনাগোনা কার্যত বন্ধ। রাজস্ব ঠিক রাখতে ভারত, চীন সহ পঞ্চাশটি দেশের নাগরিকদের জন্য ই-ভিসা চালু করেছে রুশ সরকার। কাগজপত্র ঠিক থাকলে অনলাইনে আবেদন করার চার দিনের মধ্যেই মিলবে ভিসা। সৌন্দর্যের পাশাপাশি এদেশের শৃঙ্খলাপরায়ণতাও দেখার মতো। সেই কারণেই বুঝি এদেশে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।’
কলকাতার যীশু, রাশিয়ার শিশু
কবি নীরেন্দ্রনাথ কলকাতার রাজপথে দেখেছিলেন যীশুকে। রাশিয়ায় অবশ্য এমন ঘটনা কল্পনারও অতীত। রুশ আইন মোতাবেক, শিশু সাবালক হওয়া পর্যন্ত মা-বাবার পাশাপাশি তার সমান দায়িত্ব রাষ্ট্রেরও। সাত বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক শিশুর জন্য যানবাহনে রয়েছে সেফটি সিট। মা-বাবার সঙ্গে যাতায়াতের সময়েও শিশুদের জন্য গাড়িতে সেফটি সিট বাধ্যতামূলক।
ফের সোভিয়েত ইউনিয়ন?
ফেলে আসা ইতিহাস। সোনালি অতীত। নানান কথোপকথনের মাঝে উঠে এল সেই দিনের কথা। উঠে এল সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম। বিশেষত অন্য দেশের আক্রমণ ঠেকানোর প্রসঙ্গে। স্থানীয়দের মতে, বিদেশি চাপের মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, নতুন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাবনা—নিছক কল্পনা বই কিছু না।
মস্কোর ভদানখায় রয়েছে একটি এগজিবিশন কমপ্লেক্স। নির্দিষ্ট প্যাভিলিয়নে সোভিয়েত দেশের বিভিন্ন রিপাবলিকের সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান, খাবার, মনীষীদের কথা লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। বেলারুশ, কাজাখস্তান, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের মতো দেশগুলির রূপবৈচিত্র্য একঝলকে দেখার এটাই একমাত্র পথ। তা দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় জমান প্রতিদিন। স্থাপত্য-আলোয় একাকার হয়ে জেগে ওঠে মুছে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন। একটা যুগের স্মৃতি।