যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
পেটকাটি ঘুড়িতে লাল। চাঁদিয়ালে সবুজ। বক্কাতে থাকবে হলুদ আলো। ভাবতে ভাবতে উঠোনে রিকশ রেখে মায়ের হাতে ভাড়ার টাকা তুলে দেয় ছেলেটা। মা চাল কেনে। ভাত বসায়। মাটিতে এখন অবজ্ঞা খানিক ফিকে। এই সময়টা ছেলেটার অবসর। এসময় কি কোনওভাবেই ঘুড়ি ওড়ানো যায় না? তেরো কি চোদ্দোর ছেলেটা ভাবে-টুনি বাল্ব লাগিয়ে ঘুড়িগুলি উড়লে আকাশটা কি ভালোই না লাগত। আকাশের তারার নীচে তাহলে আরও অনেক তারা ফুটে উঠত। সন্ধ্যায় মা শাঁখ বাজায়। তার সঙ্গে ভো-কাট্টা শব্দ মিশে কি চমৎকারই না হয়ে উঠত বিশ্বকর্মা পুজোর রাত। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে...
তবে চাল কিনতে হয় বলে তার ঘুড়ি কেনা হয় না। টুনি কেনার প্রশ্নই ওঠে না। অমাবস্যার পর আকাশ এখন মিশকালো। অতিরিক্ত তারা ফুটিয়ে আকাশ আলো করে তোলার স্বপ্নগুলি সেই মিশকালো অন্ধকার গিলে নেয়। তখন স্বপ্ন দেখার পরিশ্রমে নাকি সারাদিন রিকশ চালানোর জন্য চোখ জুড়িয়ে আসে ছেলেটার। আর মিশকালো অন্ধকারে ভর করে তার ভাবনাগুলি পিছনে সরতে সরতে পাড়ি দেয় সকালের দিকে। তখন আকাশজুড়ে স্বপ্নমায়া। তখন বিশ্বকর্মা পুজোটা আবার প্রথম থেকে শুরু হয়ে উঠে আসে ভাবনায়। সেখানে আকাশজুড়ে ঘুড়ি আর ঘুড়ি। দেখে মনে হয়, কেউ গোটা আকাশটাকে ধরবে বলে রংরেরঙের জাল বিছিয়েছে। ছেলেটা খ্যাঁকানি শোনে। জোরে প্যাডেল করে। আকাশও দেখে।
ওটা বিল্টুর ঘুড়ি। তার পাশেরটা সন্টুর। ছেলেটা নিজেকে দেখতে পায় তার বাড়ির শ্যাওলা ধরা ছাদে। পাশে মামা, মুখটা রোদে ঝলসে বেগুনের মতো হয়ে গিয়েছে। মামা আসত বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে। বাবা বেঁচে তখন। রাতে কারখানা থেকে ফেরার সময় পাঁঠার মাংস আর খুরি ভরে মিষ্টি আনত। পরের দিন খাওয়া হতো। বাবা মারা যাওয়ার পর দোতলা বাড়িটা ছাড়তে হয়। এখন টালির চাল। একতলা বাড়ি। ছাদ নেই। এক পুজোর এক সকালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তারপর বসার ঘরের আয়নাটার মতো চকচকে রোদ। ঝিরঝিরে বৃষ্টির পাতলা পর্দা সরিয়ে রোদ সব মনে করিয়ে দেয় ছেলেটাকে...
তর্জনির প্রথম করের ঠিক নীচটায় কড়া পড়ে গিয়েছিল। তারিফের চোখে মামার হাতটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কতই বা বয়স হবে তখন? আট বছর! মামা তখন তার একমাত্র হিরো। ছাদের রেলিংটার ধারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখা, কী অনায়াসে ঘুড়িগুলোকে আকাশে ডানা মেলে দিত। মামা বলত, লাটাইটা ধর। আলগা ধরবি। সুতো টানলে যেন আটকে না যায়।
ঘুড়ি ওড়াতে শেখাবে না মামা?
আগে লাটাই ধরা শেখ! এটা একটা আর্ট। তারপর ঘুড়ির সুতোয় হাত দিবি।
কী চেঁচান চেঁচাত মা। ওরে ছাদে শ্যাওলা। পড়ে যাবি। সামনে পরীক্ষা। শুনতে মন চাইত না। মুশকিল আসান মামা। ‘একটু বলো না মাকে! আধ ঘণ্টা। প্লিজ...!’ ম্যানেজ হয়ে যেত। তবে আধঘণ্টা নয়। পনেরো মিনিট। ওটাই আরও মিনিট দশেক টেনে বেড়ে যেত ইলাস্টিকের মতো। বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক আগটায়। পেঁজা তুলোগুলো আকাশে ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
একফোঁটা বৃষ্টি মানে ঘুড়ির দফারফা। তখন হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে ঘুড়ি নামাও রে। মাঞ্জাতে যেন জল না পড়ে, সেটা সামলাও রে। বড় ঝক্কির কাজগুলো এসে পড়ে ঘাড়ে। তারপর হাঁ করে চেয়ে থাকো আকাশপানে। কখন রোদ ওঠে। তার আগে বিল্টুর ঘুড়িটাকে কেটে দিয়েছে মামা। সে কি টান। মামার হাত রেলগাড়ির মতো স্পিডে চলছিল। অত দূর থেকে চাঁদিয়ালটা টানের চোটে হু হু করে নেমে আসছে নীচে। ফরফর আওয়াজ ছাদ থেকে কানে আসছে। মামার মতো সুতোয় টান দিতে পারলে জীবন সার্থক। বিল্টুর মুখটাকে দেখে তখন কী হাসিই না লাগছিল। ঠিক ভূগোল স্যর অনাদিবাবুর মতো তোম্বা, ছিড়কুট্টে।
পরশু ও আর সন্টু মিলে মাঞ্জা দিয়েছিল। ডিম মাঞ্জা। বিল্টু শুনে নাক সিঁটকেছিল—‘কী বদ গন্ধ রে বাবা। তোরা দিগে যা। আমি ‘ছাড়া মাঞ্জা’ই দেব। সাবু দিয়ে।’ নে এখন বোঝ। ডিম মাঞ্জার সঙ্গে অন্য মাঞ্জা কখনও পারে নাকি? মামা বলেছিল, ‘ডিম মাঞ্জা পচে যায় তাড়াতাড়ি। কিন্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই তার রেলা। কাছে এলেই ঘ্যাঁচ।’
মাঞ্জা দিতে ডিম কিনতে হবে। ক’টা টাকা দেবে? আগের সন্ধেয় কথাটা বলতেই বাবা মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। চোখ দেখে পেটটা গুড়গুড় করতে শুরু করেছে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল কি না, বোঝা গেল না। তবে টাকাটা দিল বাবা—‘যা পালা। মাকে বলবি না।’ আর পায় কে? দৌড়ে সন্টুর জানলায়। সকাল হতেই ডিম, কাচের গুঁড়ো, ভাতের ফ্যান জোগাড় হল। সুতো হল। সারাদিন রোদ খাবে মাঞ্জা। বাবার বন্ধু মুখার্জি পাড়ার কনককাকু খুব হেল্প করল সেবার। দু’আঙুলে ন্যাকড়া জড়িয়ে কাচের গুঁড়ো কীভাবে সুতোয় ‘টিপ’ দিয়ে দিতে হয় কনককাকু দেখিয়ে দিয়েছিল—‘খুব সাবধান একটু এদিক ওদিক হলেই কিন্তু হাত কেটে ফালা হয়ে যাবে।’ রোদটা ভালোই উঠেছিল। সন্ধের আগেই তৈরি খড়খড়ে, ধারাল দু’হাজার সুতোর মাঞ্জা। সন্টু নিজের ভাগেরটা লাটাইয়ে গুটিয়ে চলে গেল। একটা আলেকজান্ডার, আলেকজান্ডার ফিলিংস হচ্ছিল তখন। আমরা করব জয় নিশ্চয়। যাওয়ার আগে হাতে ধরে ঘুড়ি চেনাল কনককাকু—‘পেটকাটি হল দু’রং দিয়ে বানানো ঘুড়ি। মুখপোড়ার মুখের দিকে অন্য রং। চাঁদিয়ালের বুকে চাঁদ আঁকা। মোমবাতি ঘুড়ির বুকে লম্বালম্বি সাদা চওড়া দাগ দেওয়া থাকে।’
এদিন বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়। মা করে। পুরুতমশাই আসেন। মামা এল সকাল দশটার মধ্যে। বললে, মাঞ্জাটা ভালোই দিয়েছিস। জানানো হল, মাকে বলে ফ্যান ম্যানেজ হয়েছে। কাচ গুঁড়ো করে দিয়েছেন কনককাকু। ল্যাম্পপোস্টে সুতো বেঁধে মাঞ্জা দেওয়া হয়েছে সারা দুপুর। মা কিছু বলেনি। সন্টু যে সঙ্গে ছিল সেটা চেপে যাওয়া হয়েছিল শুধু। মামার হুকুমে মাথায় ঘষে ঘষে সবক’টা ঘুড়িতে ‘চেত্তা’ দিতে হল। কল বাঁধল মামা—‘এটাই আসল বুঝলি। কল বাঁধা ঠিক না হলে ঘুড়ি গোঁত্তা খাবে। তখন আবার ‘কাঁপে কান্নিক’ দিতে হবে। না হলে ওড়ার সময় ঘুড়ির মুখ সোজা থাকবে না।’ তারপর ‘ধোলাই’ দিয়ে উড়িয়ে দিতে হতো ঘুড়ি।
মামা যখন টানা মাঞ্জায় প্যাঁচ খেলে ওর হাত ভালো করে দেখা যায় না, এত স্পিড। লাটাই গুটোতে গুটোতে কাঁধ ব্যথা হয়ে যায়। বিল্টু, কনককাকুর ছেলে, বাচ্চুকাকু, রুস্তম সবার ঘুড়ি কেটেছে ও। রাতে ঘুমের আগে হিসেব করে দেখা গেল, ১২টা ঘ্যাচাং ফু। পাড়ার মধ্যে বেস্ট কে? মামা ছাড়া আবার কে? একটা মুখপোড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল। কাগজ সাঁটতে হবে। আঠা তৈরি করার ফিকিরে রান্নাঘরে ঢুকতে হয়েছিল ভাত আনতে। হাঁড়ির ঢাকায় সবে হাত পড়েছে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে মা রান্নাঘরে ঢুকল। থাপ্পড় পড়ার বেশ খানিক্ষণ পর টের পাওয়া গেল, ঘামে ভেজা পিঠটা জ্বলে যাচ্ছে। মাকে খুব ভয়। গত বছর একটা কেস হয়েছিল। বস্তির দিক থেকে একটা কাটা ঘুড়ি ভেসে আসে। কালো রঙের মাঞ্জা ঝুলছে অনেকটা নীচে। ধরার জন্য সবাই ছুট দেয়। ঘুড়িটা আটকেছিল বুবুনদের ছাদের অ্যান্টেনায়। কার্নিস বেয়ে ছাদে উঠেছিল নিমাই। সবাই চেষ্টা করেছিল ওঠার। তবে নিমাই ফার্স্টে উঠে ঘুড়িটা পেয়ে যায়। এই খবরটা মায়ের কানে গিয়েছিল। বোধহয় বুবুনের মা বলেছিল। সন্ধেয় বাড়ি ঢোকার পর মা কিছু বলেনি। পড়ার সময় একটা ছোট্ট ভুল নিয়ে কী মারটাই না মারল রান্নার হাতা দিয়ে। হাতার বাড়ি খেয়ে কনুই ফুলে গিয়েছিল। মারতে মারতে চেঁচাচ্ছিল মা, ‘লুকিয়ে লোকের বাড়ি ছাদের ওঠা...। চুরি শিখছো। কাদের সঙ্গে মিশছ তুমি আজকাল। বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ তোমার।’ তারপর তিনদিন খেলতে যেতে দেয়নি। অনেক কান্নাকাটি করে হাতেপায়ে ধরে তবে সেবার রেহাই মিলেছিল।
বাবা কারখানা থেকে এখন ফিরল। হাতে মাংসের ভাঁড়। মামা বিকেলে প্রসাদ খেয়ে চলে যায়। কাল অফিস আছে। বাবা কী একটা হিসেব করছে চেয়ারে বসে। সারাদিন রোদ্দুরে পুড়ে মাথা টনটন করছে। চোখগুলো লাল। রাতে বিছানায় বসিয়ে প্রসাদের খিচুড়ি খাইয়ে শুইয়ে দিল মা। মুখে সেই ক্রিমটা মাখিয়ে দিচ্ছে। এই ক্রিমটার উপর খুব লোভ তবে হাত দেওয়ার নিয়ম নেই। এখন সেটার গন্ধ ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে চোখদুটোকে। সেই কতদূর থেকে মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে। ক্রিম লাগাতে লাগাতে বলছে, ‘শুধু ঘুড়ি ওড়ালেই হবে? পড়াশোনাটাও তো করতে হবে নাকি।’ মায়ের হাতের আংটিটা যেটা এখন আর নেই, সেটা হঠাৎ ঝিলিক দেয় বাল্বের হলদে আলোয়। ঘুমের মধ্যে আংটিটা টুনি বাল্ব হয়ে যায়। ফিরে আসে স্বপ্নে। একটা আংটি অনেকগুলো আংটি হয়ে আকাশজুড়ে ঘুড়ির পিঠে চেপে টুনি বাল্ব হয়ে জ্বলতে থাকে। আংটির জন্য, ঘুড়িগুলোর জন্য আকাশজুড়ে হাজার হাজার তারা।
সেই স্বপ্নে ছেলেটার হাতে ঘুড়ির সুতো। তার ঘুড়িতে ঘরের বাল্বের মতো হলদে আলোর টুনি। বিল্টুর ঘুড়িটায় সবুজ আলো। আকাশে জোনাকির মতো ঝিকমিক করছে কত কত ঘুড়ি। ছেলেটা প্রাণপণে স্বপ্ন ধরে রাখে। স্বপ্নটাকে ভাঙতে দেওয়া যাবে না। স্বপ্ন ভাঙতে দিতে নেই ...