যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
গায়িকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই জানেন। রেকর্ডে বা ক্যাসেটে বা বেতারে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেননি এমন শিক্ষিত বাঙালি নেই বললেই চলে। বহু বছর ধরে বহু গুণীজন এবং প্রখ্যাত বাঙালি তাঁর অসাধারণ কণ্ঠমাধুর্যের তারিফ করেছেন।
কিন্তু মানুষ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনেকেই সেভাবে জানেন না। শান্তিনিকেতনে যাঁরা দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন তাঁদের কথা অবশ্য আলাদা। আমি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা সময় বেশ কাছাকাছি দেখেছি। শান্তিনিকেতনে তাঁদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার থেকেছিও। কলকাতায় এলে তাঁর সঙ্গে অনেকবার ঘোরাঘুরিও করেছি। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন।
এমন শিশুর মতো সরল মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। একেবারে খোলা ছিল তাঁর মন। যখন যা ভাবতেন, তাই বলতেন। প্যাঁচগোছের ধার ধারতেন না। কারও ওপর রাগ হলে সঙ্গে সঙ্গে সে তা মালুম পেত। আবার, কারও ওপর খুশি হলে আশপাশের সকলেও তা বুঝতে পারত। কারও সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও তিনি কখনও বেশিক্ষণ রাগ পুষে রাখতেন না। চটপট সব ভুলে যেতেন।
একবারের এক ঘটনা বলি। পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। কণিকাদিদের বাড়িতেই সেবার উঠেছিলাম। আমি তখন আনন্দবাজারে কাজ করি। আমার এক সহকর্মী সেবার মেলা থেকে একটা টাই কিনে দিয়েছিলেন। আমি বিকেলবেলা সেই টাইটা বাড়িতে রাখতে এসেছি। কণিকাদি এবং বীরেনদা (কণিকাদির স্বামী)। দু’জনেই বাড়িতে ছিলেন। আমি দু’জনকেই টাইটা দেখিয়ে বললাম কী সুন্দর দেখুন। বীরেনদা হেসে বললেন: বাঃ, খুব সুন্দর টাই। তোমার খুব ভালো মানাবে। কণিকাদি কিন্তু টাইটা ভালো না খারাপ সে প্রসঙ্গে গেলেনই না। হঠাৎ রেগে বলে উঠলেন, ও তোমাকে টাই দিয়েছে। ও তো একটা কুচুটে লোক! ওকে তুমি চেন না। আমি জিভ কেটে বললাম: মোহরদি, কী বলছেন। সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মোহরদি আরও জোর গলায় বললেন: এ কথা আমি বারান্দায় গিয়েও বলে আসতে পারি।
তার পরের দিনের ঘটনা। ওই সহকর্মীর লেখা নিয়ে কথা হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে একটা লেখার কথা। বীরেনদা বেশ ভালো পড়াশোনা করা লোক ছিলেন। নানা বিষয়ে বহু লেখালেখিও করে গিয়েছেন। বীরেনদা বললেন, হ্যাঁ, ও গুরুদেবকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছে। ভালো লেখে। মোহরদিও বললে: হ্যাঁ ও বেশ ভালো লেখে। ওঁর কথা শুনে আমি হেসে বললাম: এই যে সেদিন বলছিলেন ও কুচুটে। মোহরদি হেসে জবাব দিলেন: কুচুটে লোক কি লিখতে জানে না। আমি অনেক কুচুটের নাম করতে পারি যারা ভালো লিখতে পারে।
আর একদিনের ঘটনা। সেবারও পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। মোহরদিদের বাড়িতেই উঠেছি। মোহরদিরা তখন চীন ভবনের পাশে একটা ছোট বাড়িতে থাকতেন। হঠাৎ রাত ২-২.৩০টার সময় বাইরে শুনতে পেলাম গৌরকিশোর ঘোষ আর পরিমল চন্দ্রের জোর চেঁচামেচি। দু’জনেই আমার নাম ধরে ডাকছিলেন: বরুণ উঠে এসো, আমরা এসে গিয়েছি। আমি চুপচাপ শুয়ে ভাবছিলাম, কী করব? এখন যদি ওদের সঙ্গে বেরোই তাহলে শীতের মধ্যে শান্তিনিকেতনে ঘুরে বেড়াতে হবে! ওরা জানতেন আমি ওখানে উঠব। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে প্রথমে বীরেনদা পরে মোহরদির গলার আওয়াজ পেলাম। আমার সঙ্গে মোহরদি ও বীরেনদার সেই সময় যতটা পরিচয় ছিল, গৌরদা এবং পরিমলবাবুর তারচেয়ে অনেক বেশি জানাশোনা ছিল। পরে এই পরিমলবাবু মোহরদির বোনকে বিয়ে করেছিলেন। মোহর প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বরুণকে ডাকাডাকি কেন? ও ঘুমোচ্ছে। আমি একটু আশ্বস্ত হলাম। বুঝলাম, মোহরদি যখন কেসটা টেক-আপ করছেন তখন ভয়ের কিছু নেই। ওরা দু’জনেই বললেন: আমরা বরুণকে ডাকতে এসেছি। ও আমাদের সঙ্গে যাবে। মোহরদি জিজ্ঞেস করলেন: ও কোথায় যাবে? ওঁরা বললেন, আমরা যেখানে থাকব সেখানে যাবে। মোহরদি চড়া গলার আওয়াজ তুলে বললেন, না ও ছেলেমানুষ, ঘুমিয়ে আছে। ওকে ডাকাডাকি করবেন না। ও যাবে না। কাল সকালে আপনাদের সঙ্গে দেখা করবে। গৌরদা তারপর কী যেন একটা বলতে গেলেন। মোহরদি কড়াভাবে জবাব দিলেন: আমি বলছি ও যাবে না। আপনারা এবার চলে যেতে পারেন।
তারপর প্রায় ২৪ ঘণ্টা গৌরদা, পরিমলবাবু আমার সঙ্গে রাগে কথাই বলেননি। কথা বলেননি মোহরদির সঙ্গেও। আমি পরদিন সকালবেলা মোহরদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: আপনি ওদের ওভাবে তাড়িয়ে দিলেন কেন? মোহরদি বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললেন: তাড়িয়ে দেব না কেন? তুমি ছেলেমানুষ। ওরা তোমার ঘুম ভাঙাবে কেন? আমার তখন বয়সটা নিশ্চয় অনেক কম ছিল কিন্তু মোহরদির তুলনায় আমি যে খুব ছোট ছিলাম না তা নয়। হিসেব মতো মোহরদির সঙ্গে আমার বয়সের তফাৎ মাত্র ১০-১২ বছরের। আমি তখন ২৬-২৭। আর মোহরদির বয়স ৩৬-৩৭। বীরেনদার বয়স আরও কয়েক বছর বেশি।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে অনেকেই বলেন, শৈলজারঞ্জন গোষ্ঠী আর শান্তিদেব গোষ্ঠী বলে আলাদা দুটো গোষ্ঠী রয়েছে। শুনেছি মোহরদিরা মূলত শৈলজারঞ্জন গোষ্ঠীর ছিলেন। বহুদিন মোহরদির কাছে শৈলজারঞ্জনবাবুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি। একদিন হঠাৎ শান্তিনিকেতনের মোহরদির বাড়িতে গিয়েছি। দেখি শান্তিদা, অর্থাৎ শান্তিদেব ঘোষ মোহরদির বসার ঘরের চেয়ারে বসে। আর তাঁর পায়ের কাছে বসে মোহরদি। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরই শান্তিদা চলে গেলেন। আমি হেসে বীরেনদাকে জিজ্ঞেস করলাম: কী বীরেনদা, মোহরদি কি গ্রুপ পাল্টেছেন নাকি? বীরেনদা কোনও জবাব দেওয়ার আগেই মোহরদি আমাকে ধমকে উঠলেন: তুমি জানো শান্তিদাকে আমি কত শ্রদ্ধা করি? শান্তিদার মতো মানুষ ক’জন আছে? শান্তিদার কাছে আমি কত গানই না শিখেছি।
শুনেছি, সুচিত্রা মিত্র, মোহরদি, অরুন্ধতী মুখার্জি এবং কুটুদি এই চারজন একসময় খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন। আবার, পরবর্তীকালে মোহরদি বেশি ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, না সুচিত্রা বেশি ভালো গান, এই নিয়ে বহু বিতর্কও শুনেছি। কারও কারও মতে, কিছু গান সুচিত্রাদি ভালো গেয়েছেন। আবার, অন্য কিছু গান ভালো গেয়েছেন মোহরদি। আমি বরাবরই শুনতাম, মোহরদির সঙ্গে সুচিত্রাদির একটা লাভ-হেট রিলেশন রয়েছে। এ নিয়ে আমি দু’একবার বেশ মজাও করেছি। একদিন বীরেনদা, মোহরদির সঙ্গে খেতে বসেছি। বললাম, অমুকে বলছিলেন মোহরদির চেয়ে সুচিত্রাদি ওই গানটা অনেক ভালো গেয়েছেন। মোহরদি সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে যেতেন। আবার এমনও অনেক দিন হয়েছে আমি হঠাৎ বলেছি, শুনলাম সুচিত্রাদি সেদিন এমন বাজে গাইলেন আর বলার নয়। মোহরদি আমাকে রেগে ধমকে দিতেন: রবীন্দ্রসঙ্গীতের তুমি বোঝ কী হে! সুচিত্রার গানের সঙ্গে কারও গানের তুলনা হয়।
মোহরদির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সন্তোষবাবু। সন্তোষকুমার ঘোষ একাধারে অসামান্য সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক। সন্তোষবাবু আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। কাজও শিখিয়েছেন হাত ধরে। সন্তোষবাবুর সঙ্গে মোহরদির একটা আলাদা সম্পর্ক ছিল। ’৬৫-’৬৬ সালে মোহরদি কলকাতার আশপাশে গান গাইতে গেলে আমরা আনন্দবাজারের তিন-চারজন তাঁর সঙ্গে যেতাম। সন্তোষকুমার ঘোষ, জ্যোতির্ময় বসু রায়ের সঙ্গে আমিও বহুবার গিয়েছি। ওরা দু’জনেই গান জিনিসটা বুঝতেন। আমার গান ভালো লাগে; কিন্তু আমি গানের বিশেষজ্ঞ নই।
একবার এইরকম একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম উত্তরপাড়ায়। গঙ্গার পাড়ে একটা বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। মোহরদি বিচারক। গানও গেয়েছিলেন। প্রতিযোগিতা হয়ে গেল। ফলাফলও ঘোষিত। মোহরদির গানও হয়ে গেল। চা খাওয়ার পর গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসলাম আমরা। সেই বাড়িরই নিজস্ব ঘাট। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন আকাশে খুব বড় চাঁদ ছিল। সন্তোষবাবু মোহরদিকে বললেন, একটা গান গাইবে? মোহরদি বললেন: তুমি যখন বলেছ, তখন না গেয়ে পারি! কোনটা গাইব বল? সন্তোষবাবু হেসে বললেন, এমন জ্যোৎস্না রাতে, একটা গানই হতে পারে। তুমি সেটা গাও। মোহরদি সেদিন অসাধারণ গেয়েছিলেন। আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে...। সেই গানের পর আমরা সবাই চার-পাঁচ মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। সামনে গঙ্গার জল। ছলাৎ ছলাৎ করছে। চাঁদের আলো পড়ছে তার ওপর। একটু দূরে বালি ব্রিজ। ওপারে দক্ষিণেশ্বর মন্দির। মোহরদির ওই গান আমাদের অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর, হঠাৎ মোহরদি আমাকে বললেন: তুমি তো সবার মধ্যে ছোট। এবার তুমি বল কী গাইব? আমার বরাবরই অসাধারণ লাগে মোহরদির গলায় ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটা। এখনও প্রায়ই আমি ক্যাসেট বাজিয়ে চুপচাপ মোহরদির গলায় গাওয়া ওই গান শুনি। জ্যোতির্ময়বাবু একটু কিন্তু কিন্তু করে মোহরদিকে বললেন: ওটা তো একটু বড় গান। রাগ নির্ভরও। এতটা পরিশ্রমের পর আপনার কী ও গান গাইতে অসুবিধা হবে না? মোহরদি হেসে বললেন: তাতে কী হয়েছে। বরুণ ছেলেমানুষ। ওই গানটা শুনতে চাইছে। আমি গাইব না। তারপর একটু চুপচাপ থেকে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটা ধরলেন।
মোহরদিকে আমি কখনও রেখেঢেকে কথা বলতে শুনিনি। যাঁর সম্পর্কে যা মনে করতেন সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতেন। কোনওরকম যদি কিন্তু রাখতেন না। তবে, আমার যা অভিজ্ঞতা, মোহরদি কারও ওপর বেশিদিন চটে থাকতেন না। তাঁর কোনও পার্মানেন্ট শত্রু বা টার্গেট ছিল না। কারও ওপর রেগে গেলে বড়জোর আট-দশ দিন রেগে থাকতেন। তারপরই আবার সব ভুলে যেতেন। আমি এক ভদ্রমহিলার কথা জানি। মোহরদি একটা সময় তার ওপর ভীষণ চটেছিলেন। আবার, সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যেই মোহরদির গলায় গলায় ভাবও আমি দেখেছি। কারও ওপর তিনি বেশিদিন রাগ পুষে রাখতেন না। মোহরদির স্বভাবটা ছিল শিশুর মতো। সরল, কোমল এবং ধপধপে সাদা। মধ্যবয়সেও মোহরদি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন দেখতে। তাঁর স্বভাবটাও ছিল অসাধারণ সুন্দর এবং পবিত্র। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। ঠিকই, তিনি কিছুটা খেয়ালি ছিলেন। কিন্তু তাঁর খেয়ালিপনার মধ্যে কখনও কোনও অঙ্ক থাকত না, হিসেব থাকত না, বিদ্বেষ থাকত না।