যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
তিনতলা বাড়ি। ১৪জন সদস্য। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামছে ছোটরা। একতলার রান্নাঘরে নানা স্বাদের জলখাবার তৈরিতে ব্যস্ত বড়মা। হাতে হাতে গুছিয়ে দিচ্ছে মেজমা, সেজমা। কারও অফিস, কারও কলেজ, কারও বা স্কুলে বেরনোর তাড়া। দোতলার বারান্দায় দাদু চায়ের অপেক্ষায় বসে। তিনতলার ঠাকুরঘরে সকালেই ধূপ ধুনোর গন্ধ, ঘণ্টার আওয়াজে মগ্ন ঠাকুরমা। জমজমাট, হুল্লোড়ের দিনগুলো এখন অতীত। ১৪ জনের কেউ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। কেউ বিদেশে স্থায়ী বসত গড়েছেন। কারও বা অন্য শহরে চাকরি। কলকাতার সেই তেতলা বাড়ি কখনও খালি পড়ে থাকে। কখনও বা আগলে রাখেন বুড়ো-বুড়ি। এই চিত্র ২০২৩-এর কাছে বড় চেনা। ছেলেমেয়েরা কর্মসূত্রে দূরে। বৃদ্ধ বাবা, মা রয়ে গিয়েছেন স্মৃতি আগলে। বড় বাড়ি যত্ন করাও মুশকিল। একাকিত্ব তো রয়েইছে। আবার কখনও বা নিরাপত্তার অভাববোধ তীব্র হয়ে ওঠে। এসবের একটা বিকল্প অবস্থান হতে পারে হোম স্টে। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে হোম স্টে-র খোঁজে থাকা ভ্রমণপিপাসুর সংখ্যা কম নয়। অর্থাৎ বেড়ানোর মুডে হোম স্টে পছন্দের তালিকায় উপরের দিকেই রয়েছে। আপনার শহরে গ্রামে মফস্সলেও তো বহু লোক বেড়াতেই আসেন। তাদের জন্য নিজের বাড়িকে গুছিয়ে নিয়ে শুরু করতে পারেন হোম স্টে-র নতুন ব্যবসা।
ইন্টিরিয়র ডিজাইন নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন বিদিশা বসু। তিনি অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, কলকাতায় এখন অনেকেরই দোতলা বা তিনতলা— বড় বাড়ি। মেনটেন করতে অসুবিধে হচ্ছে। কোভিডের পর এই হোম স্টে-র ট্রেন্ড বিপুলভাবে শুরু হয়েছে। ‘মানুষ ট্রাভেল করলে হোম স্টে খোঁজেন। বাড়ি থেকে দূরে গিয়েও এটা বাড়িতে থাকার অনুভূতি। বাড়ির একটা অংশ হোম স্টে-র উপযুক্ত করে সাজাতে পারেন। সেটা আলাদা অ্যাপার্টমেন্টের মতো হতে পারে। দোতলায় বাড়িওয়ালা থাকলে একতলাটা সাজাতে পারেন। একটা ঘর। তার সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম। আলাদাও থাকতে পারে বাথরুম। একটা ডাইনিং, কিচেন। আবার কারও হয়তো তিনটে ঘর আছে একটা ফ্লোরে। দুটো ঘরের ক্ষেত্রে লাগোয়া বাথরুম রয়েছে। কিচেনও রয়েছে। সেক্ষেত্রে লাগোয়া বাথরুম সহ একটা ঘর নিয়ে একটা হোম স্টে করতে পারেন। বাকি থাকা আর একটা লাগোয়া বাথরুম সহ ঘর এবং দ্বিতীয় ঘরটি নিয়ে একটু বড় আকারের আর একটা হোম স্টে করা যেতে পারে। লাগোয়া বাথরুম এখন সকলেই প্রায় পছন্দ করেন। একটা ছোট কিচেন। নিজের মতো চা বা ম্যাগি বানিয়ে নিতে পারবেন, এমনটাও পছন্দ অনেকের। এই বিকল্প থাকা জরুরি। আর টাকার প্রয়োজনীয়তা সকলেরই রয়েছে’, বললেন বিদিশা।
শীত পড়ছে শহরে। এসময় বেড়ানোর জন্য আদর্শ। কলকাতাতেও দেশের অন্য শহর বা বিদেশ থেকে বেড়াতে আসেন অনেকে। কলকাতাকে কেন্দ্র করে দার্জিলিং, শান্তিনিকেতন, বীরভূমের কিছু জায়গা বেড়াতে যেতে চাওয়ার ভ্রমণার্থীদের সঙ্গে কাজ করেছেন বিদিশা। তিনি বললেন, ‘এসময় অনেকে কলকাতার ক্রিসমাস উপভোগ করতে চান। যাঁর বাড়িতে অতিথি আসছেন তিনি যতটা সম্ভব স্থানীয় তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কলকাতায় কোথায় কোথায় ঘুরবেন, কীভাবে যাবেন, কী কী স্থানীয় খাবার খাবেন, এসব বলে দিতে পারে। বাইরে থেকে অতিথি এসে যেমন স্থানীয় ফ্লেভার এনজয় করেন, তেমনই ধরুন কোনও অস্ট্রেলিয়ান আপনারই বাড়িতে অস্ট্রেলিয়ার কোনও পদ তৈরি করে আপনাকেই নেমন্তন্ন করছেন। এতে একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। দু’তরফই সমৃদ্ধ হয়। বাড়ির মালিক বা মালকিন অথবা তাদের পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে ভালোবাসেন বহু পর্যটক। এতে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান হয়। দুটো আলাদা ঘরের অতিথিদের মধ্যেও বন্ধুত্ব হয়।’
কয়েক বছর আগে এই হোম স্টে-র ধারণা একটু অন্যভাবে ধারণ করেছিল বাঙালি। বিদিশা মনে করিয়ে দিলেন, ‘আগে হলিডে হোম-এর কনসেপ্ট ছিল। আদতে ছুটিতেও বাড়িতে থাকার অনুভূতি। বেড়াতে গিয়ে বাঙালি বাজার করত। হলিডে হোমে থেকে রান্না করে খেত। সেই কনসেপ্টটাই নতুন নামে খানিক ধাঁচ বদলে হোম স্টে হয়েছে। হোম স্টে-তে যে উষ্ণতা, নিরাপত্তা, পারিবারিক অনুভূতি পাওয়া যায় সেটা অন্য কোথাও সম্ভব নয়।’
আপনার বাড়ির অতিরিক্ত অংশ খানিক সাজিয়ে, গুছিয়ে হোম স্টে তৈরি করতে পারেন। নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে। একাকিত্ব, অবসাদ কাটানোর এ এক অন্যতম উপায়। আপনার ব্যবহৃত আসবাব অতিথিদের ব্যবহার করতে দিতে পারেন। ছোট টেবিল, রান্নাঘরের কিছু সাধারণ বাসন প্রয়োজন বুঝলে কিনে নিন। বাথরুমের সব ব্যবস্থা রয়েছে কি না, দেখে রাখুন। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সকলেরই পছন্দ, ফলে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। হোম স্টে শুরু করতে গেলে আপনার নিরাপত্তার দিকেও নজর দিতে হবে। এই ধরনের ব্যবসা শুরুর আগে স্থানীয় থানায় জানিয়ে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে রাখুন। অতিথিদের আধার কার্ড, পাসপোর্টের মতো পরিচয়পত্র জমা রাখুন। একইসঙ্গে আপনার কিছু তথ্যও অতিথিরা দেখতে চাইতে পারেন। সেকারণে হোম স্টে-র মালিকানার প্রমাণপত্র, হোম স্টে-র পরিকল্পনা, পুলিসের অনুমোদনপত্র, আপনার বাড়ির ল্যান্ডমার্কের তালিকা হাতের কাছে রাখুন। এখনকার দিনে ইন্টারনেট পরিষেবা খুব জরুরি। ফলে অতিথিদের জন্য ওয়াই ফাই-এর বন্দোবস্ত করে রাখাই শ্রেয়। প্রয়োজনে তার দাম সম্পূর্ণ প্যাকেজের সঙ্গে ধরে নিন।
যে কোনও কাজেরই কিছু ঝুঁকি থাকে। হোম স্টে-র ব্যবসাও তার ব্যতিক্রম নয়। আপনার বাড়ির কোনও অংশ তা দেওয়াল হোক বা আসবাব— অতিথিদের হাতে অনিচ্ছাকৃতভাবেই তার ক্ষতি হতে পারে। তা সারিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কতটা আপনার, কতটা সে দায়ভার অতিথিদের কাঁধে ফেলবেন, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনার হোম স্টে-তে থেকে যাওয়ার পর অতিথিরা যদি নিজেদের ভুয়ো পরিচয় দিয়ে সমাজমাধ্যমে হোম স্টে-র বদনাম করেন, তার প্রভাব পড়বে ব্যবসায়। এমনকী আপনি সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও অতিথিদের তা পছন্দ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রেও নেতিবাচক মন্তব্য শোনা এবং তার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
কলকাতা শহরে হোম স্টে-র প্যাকেজ কেমন রাখবেন, তা আপনার বাড়ি শহরের কোন এলাকায়, অতিথিদের যাতায়াতের মাধ্যম কতটা হাতের নাগালে, কতটা জায়গা জুড়ে হোম স্টে বা কী কী পরিষেবা দিচ্ছেন তার উপর নির্ভর করবে। এর জন্য প্রয়োজন আপনার প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের হোম স্টে-র প্যাকেজ কেমন তা জেনে নেওয়া। অর্থাৎ মার্কেট সার্ভেও করে নিতে পারেন। এখন আর এই ব্যবসা শুধু শীতকালীন নয়। বেড়াতে যাওয়ার মরশুমে আপনার বাড়িতে অতিথি থাকবেন, বাকি সময়টা উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা নয়। বিদিশার পরামর্শ, ‘প্রচুর অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে এখন ঘুরে ঘুরে কাজ করেন। কখনও এক সপ্তাহ, কখনও মাসের ১৫ দিনও থেকে যেতে হয়। কাজের দিনগুলোয় তাঁরা আপনার বাড়ির অতিথি হিসেবে থেকে গেলেন, আবার কাজের ফাঁকে শহরও ঘুরে নিলেন। ফলে এই ব্যবসা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এখন এটা সারা বছরের ব্যাপার।’
এবার শুধু সঠিক পরিকল্পনার অপেক্ষা। তাহলেই আপনার বাড়ি হয়ে উঠতে পারে অচেনা অতিথিদের নির্ভরযোগ্য হোম স্টে।