যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
হরিদ্বার থেকে সকালে বেরিয়ে উখিমঠ পৌঁছেছি দুপুর পার করে বিকেলের মুখে। মাঝে দু’এক জায়গায় চা-পকোড়া খেতে থেমেছিলাম মাত্র, বাকি সময় টানা চলেছে গাড়ি। এ পথে দেবপ্রয়াগ আমার খুব প্রিয় জায়গা। অলকানন্দা আর ভাগীরথীর সঙ্গমের উপর দাঁড়িয়েই সময় কেটে যায়। মনে হয়, জীবন বয়ে চলে বহু দূর! তার কূলকিনারা পাওয়া এ মনুষ্যজীবনের কর্ম নয়। রাস্তার উপর চায়ের দোকান। ক্লান্ত শরীর তখন এক কাপ গরম চায়ের জন্য উৎসুক। চায়ের কাপ হাতে দেবপ্রয়াগের পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। দুই রঙের জল একে অপরের সঙ্গে মিশছে, জলের স্রোতে বয়ে যাচ্ছে সামাজিক টুকরো টুকরো চিত্র। এ দৃশ্য যে কোনও সিনেমাকে হার মানায়। মন উৎফুল্ল হয়। আবার এক কোণে ছোট্ট মানবজীবন নিয়ে কোনও এক গভীর বিষাদও যেন খেলা করে বেড়ায়। চা খেয়ে আবার গাড়ি ছোটে সামনের দিকে। রুদ্রপ্রয়াগে এসে গাড়ি থামাই। উপর থেকে সঙ্গমের দিকে তাকিয়ে অলোকানন্দাকে ছেড়ে মন্দাকিনীর সঙ্গ ধরি। বাকি পথ সে-ই আমাদের সঙ্গী।
বাসস্ট্যান্ডকে ঘিরে একটা বাজার তৈরি হয়েছে উখিমঠে। ছোট্ট পাহাড়ি শহর। কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ এর অবস্থান। কেদারনাথ আর মদমহেশ্বরের শীতকালীন আবাসস্থল। যার জন্য তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা বছরভর। ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরকে ঘিরেই সবকিছু আবর্তিত হয় উখিমঠে।
শহর ছেড়ে একটু দূরে পাহাড়ের ঢালে লাল রঙের বিরাট বাড়িটা বছরের পর বছর ধরে সকলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, উখিমঠ। আশ্রয়হীনের আশ্রয়, ক্ষুধার্তের খাবারের ঠিকানা। পাহাড়ের ওপাশে গুপ্তকাশী। মাঝে গভীর খাদ।
উখিমঠ থেকে রাস্তা চলে গিয়েছে চোপতা হয়ে যোশীমঠ। আমরা চোপতার আগে বাঁদিকে পাহাড়ের সরু গলিপথে ঢুকে পড়ি। কিছু দূরেই পাহাড়ি গ্রাম ‘সারি’। ছবির মতোই ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়ের ঢালে রঙিন ছোট ছোট বাড়ি। কান পাতলেই পাখির কিচমিচ। সারিগ্রাম থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে পাকদণ্ডী পথ উঠে গিয়েছে এক্কেবারে পাহাড়ের চূড়ায়। সেই পাহাড় ডিঙিয়ে কিছু দূর হাঁটলে স্বচ্ছ জলের বিরাট জলাশয় দেওরিয়াতাল। চারদিকে সারবদ্ধ পাহাড়। তার মাথায় জঙ্গলের জটলা। তারই মাঝে স্ফটিকস্বচ্ছ এই পুষ্করিণী।
এ নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার। আবারও একই হোটেলে এসেছি। হোটেলের মালিক বিক্রমকে তাই গতবারের ছবি দেখিয়ে বলি ‘চিনতে পারছ? ছবি দেখালাম কেন জানো? দু’পয়সা কমাবে বলে!’ হা হা হেসে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল বিক্রম, ‘ঘরের ভাড়া না হয় কমাব। কিন্তু উপরের ঘর তো ফাঁকা নেই। নীচের ঘর খালি আছে। চলবে?’
‘চারটে দেওয়াল আর মাথার উপর ছাদ আছে তো?’ আমার এমন প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলে বিক্রম।
পাতলা অন্ধকার নেমেছে সারিগ্রামের বুকে। আকাশ তার রং বদলাচ্ছে। দূরের বরফচূড়াগুলো আলোয় মাখামাখি। সান্ধ্য আড্ডায় বসেছি হোটেলের ঝুল বারান্দায়। সামনের পাহাড়ের খাদে এখন জমাট বাঁধা অন্ধকার। হঠাৎ দেখলে গা ছমছম করে উঠবে। আকাশে কুমড়োফালির চাঁদ উঠেছে। মধ্য এপ্রিলের ঠান্ডা বেশ কয়েক জোড়া জামাকাপড় ভেদ করে হাড়ে টোকা মারছে। বিক্রমের বাবার রান্নার হাতটা খুব ভালো। গরম গরম পকোড়া দিয়ে গিয়েছেন আমাদের। গরম কফি দিতেও দেরি করেননি। আমার সঙ্গীটি আবার ভীষণ মিশুকে। যেখানেই যায় বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে এক কাপ চা নিয়ে বেসুরেই সে ধরেছে দেশোয়ালি গান। তারই ফাঁকে সুযোগ বুঝে বিক্রমের বাবার কাছে দেওরিয়াতালের গল্পটা শুনতে চাইলাম।
একটু ভেবে নিয়ে শুরু করলেন তিনি, ‘ছোট পাণ্ডবকে যুধিষ্ঠির খুবই ভালোবাসতেন। তা সেও যখন জল নিয়ে ফিরল না তখন যুধিষ্ঠির আর স্থির থাকতে পারল না। ধ্যানে বসে যোগবলে জানতে পারল এই পাহাড়ের মাঝে কাকচক্ষু পুষ্করিণীর কথা। সেখানেই যক্ষরাজ বন্দি করেছেন চার পাণ্ডবকে। যক্ষরাজকে প্রণাম করে ভাইদের মুক্তি প্রার্থনা করলে যক্ষরাজ কঠিন শর্ত আরোপ করলেন। শর্ত মেনে যক্ষরাজের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভাইদের মুক্ত করে আনলেন যুধিষ্ঠির। চার পাণ্ডব যেখানে বন্দি ছিলেন সেটাই হল দেওরিয়াতাল। দেবতারা নির্দিষ্ট সময়ে স্নানও করতে আসেন এখানে। তাই তো নাম হয়েছে দেওরিয়াতাল। কাল গেলেই দেখতে পাবেন পবিত্র জলরাশি। তবে সকাল সকাল পৌঁছতে হবে। নাহলে কিন্তু অর্ধেক রোমাঞ্চই মাটি। তালের জলে পাহাড় চূড়ার ছবিই দেখতে পাবেন না।’ পরের দিন সকালে খুব তাড়াহুড়ো করেও ভোর ছ’টার আগে আমরা বেরতে পারলাম না।
হোটেলের সামনেই দেওরিয়াতাল প্রবেশদ্বার লেখা একটা বড় তোরণ। সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় চড়াই ভাঙা। কনকনে ঠান্ডার মধ্যে হাঁটতে মন্দ লাগছিল না। একটু পরেই গরম লাগতে শুরু করল। সোয়েটার জ্যাকেট চালান করতে হল পিঠের ব্যাগে। চারদিকে ছোটবড় গাছের প্রাচুর্য। পাখির ডাক অনুসরণ করলেই চোখে পড়ে রংবেরঙের সুন্দর সুন্দর পাখি। পাখিদের কলতানে যাত্রাপথ মধুর হয়। এখনও বেশ কিছু গাছে লাল রডোডেনড্রন ফুটে রয়েছে। আমরা তিনজন ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ছে না। হাঁটতে হাঁটতে একটা সমতল জায়গায় বিশ্রাম নিতে দাঁড়াই। উপর থেকে সারিগ্রামকে খুব সুন্দর লাগে। আশপাশের গাছগুলোতে প্রচুর পাখির দেখা মিলছে। বিভিন্ন জাতের পাখি। লাফিং থ্রাশ, হিমালয়ান বুলবুল আরও কত নাম। একদম মাথার উপর লাল রঙের একটা ঘর নজরে পড়ল। দু’-একজন মানুষও রয়েছে মনে হল। সুতরাং ওই ঘরটা পর্যন্ত উঠতেই হবে বুঝলাম। রাস্তা খুব দুর্গম নয়। পাথর বাঁধানো চওড়া পথ। তবে চড়াই খুব। দেখতে দেখতে লালরঙের ঘরটার সামনে পৌঁছে যাই। ঘরের মালিক সাদরে আমন্ত্রণ জানাল ভিতরে বসার জন্য। চা তৈরি করতে করতেই গল্প জমে ওঠে। এখনও পর্যটকদের আনাগোনা সেভাবে শুরু হয়নি। তবে শীতকালে ব্যবসা ভালোই হয়েছিল। আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যেই ট্যুরিস্টদের ঢল নামবে। বললেন, এখান থেকে দেওরিয়াতাল সামান্যই রাস্তা। সামনের পাহাড়টার মাথায় উঠেই ডানদিকের রাস্তা ধরে নামার পালা। ঘড়িতে দেখলাম প্রায় আটটা বাজে। যতই নামছি টলটলে জলভর্তি দেওরিয়াতাল স্পষ্ট হচ্ছে। প্রায় ৮০০০ ফুট উঁচুতে চতুর্দিকে ঢেউ খেলানো পাহাড় ঘিরে রেখেছে যেন এক অমূল্য রত্নকে। তালের জল স্পর্শ করে স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। এতদিনের জমানো স্বপ্নপূরণে মন প্রফুল্ল হয়। দূরে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে শৃঙ্গ সমেত পুরো চৌখাম্বা রেঞ্জ। আকাশ খুব পরিষ্কার থাকলে দেওরিয়াতালের জলে ওই পর্বতশৃঙ্গের পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তবে সেটা দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের ক্ষেত্রে ভাগ্য মোটেও সুপ্রসন্ন ছিল না। দু’বারই ওই দুর্লভ দৃশ্য দর্শনে বঞ্চিত হলাম। তবে মাঝে মাঝে ক্ষণিকের জন্য মেঘ সরে গেলে চৌখাম্বার উঁকিঝুঁকি মুগ্ধ করেছে। অপার বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছি সেই দিকে। কাঠঠোকরার ঠক ঠক শব্দে ঘোর ভেঙেছে। ভীষণ রঙিন একটা কাঠঠোকরা একমনে খাবারের খোঁজে ব্যস্ত।
লাফিং থ্রাশটা শিস দিতে দিতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল কে জানে কোন অচিনপুরে! মোহনচূড়াটা আবার আত্মপ্রেমে মগ্ন। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝেও নিজের মাথার ঝুঁটি সামলাতে ব্যস্ত। এসব দেখতে
দেখতে সময় কেটে যায় নিজের ছন্দে। প্রকৃতি যেন অবাধ সাম্রাজ্যবিস্তার করেছে এখানে। দেওরিয়াতাল দর্শন শেষে আমরা ফিরে চলি মায়ার সংসারে।
কীভাবে যাবেন: হরিদ্বার থেকে উখিমঠ বাসে/ভাড়ার গাড়িতে। উখিমঠ থেকে সারিগ্রাম। সারিগ্রাম থেকে দেওরিয়াতাল দেড়/দু’ ঘণ্টার হাঁটাপথ। বর্ষার দু’-একমাস বাদে সারা বছরই মনোরম।