দীপাবলির আগে আলো ও ফুলের যুগলবন্দিতে সাজিয়ে তুলুন নিজের অন্দরমহল। কোন ঘরে কেমন সাজ? জানালেন মনীষা মুখোপাধ্যায়।

উৎসবের মরশুমে ঘর সাজানোর পালায় বাঙালি বরাবরই শৌখিন। ঘরের যে কোণে শুয়ে-বসে সময় কাটে, যে অলিন্দে প্রিয় লেখকের লেখা আর এক কাপ কফিতে ভুলে যেতে পারেন যাবতীয় দায়ভার, তাকে অগোছালো রাখলে চলে? পুজোর আবহে তাই ঘরের সাজও হওয়া চাই উৎসবসম! সৌন্দর্যের অভিধানে আলো ও ফুলের স্থান বরাবর শীর্ষে। বৈদিক যুগে নারীর অঙ্গসাজেও ফুলের ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। আর আলো তো সেই কোন সময় থেকেই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষ ঘর সাজানোর মাধ্যম। ঘরের সদর থেকে শুরু করে বারান্দাও সযত্ন সাজিয়ে তুলতে পারেন ফুল ও আলো দিয়ে। এমনকী, বাথরুমের সাজেও ভিন্ন মাত্রা যোগ করে এই দুই উপকরণ। কালীপুজোয় সৌরভে ও সৌন্দর্যে আপন ঘরের শোভা বাড়াতে আলো ও ফুলের সাজে বদলে দিন রোজনামচার চেনা ঘরকে। দীপাবলির বৈঠকী আড্ডায় বাড়িতে আসা বন্ধু-আত্মীয়রা চমকে যাবেন বইকি! 
প্রবেশপথের সাজ: বাড়ির সদরের সামনেই রাখুন মাটির প্রদীপ। আজকাল মাটির প্রদীপের মধ্যে বৈদ্যুতিক টুনি লাগানো থাকে। এতে হাওয়ায় আলো নিবে যাওয়ার ভয় নেই। বাড়ির বারান্দা জুড়ে একটানা ছোট মিনিয়েচার আলো বা বৈদ্যুতিক টুনি লাগাতে পারেন। ফুলের সঙ্গেও এমন দিনে আপস নয়। প্রবেশদ্বারের পাশে দেওয়াল জুড়ে রাখুন মাঝারি মাপের হ্যাঙ্গিং কিছু ফুলদানি। অতিথিদের আপ্যায়ণ করতে উজ্জ্বল রঙের ফুলের জুড়ি নেই। ফুলদানিতে তাই লম্বা ডাঁটির অর্কিড বা ছিমছাম গোলোপ, লিলি, গ্ল্যাডিওলাস ভালো মানাবে। কলাবতী ফুলের সাজও ভালো লাগবে। প্রবেশদ্বারের পরেই একফালি উঠোন থাকলে এথনিক প্রদীপ ও ফুল দিয়ে রঙ্গোলি করতে পারেন সেখানে। কুচো ফুল ও প্রদীপের আলোতেই হবে বাজিমাত।
ড্রয়িংরুমের সজ্জা: গোটা ঘর জুড়েই রঙিন মিনিয়েচার ঝোলাতে পারেন। আজকাল কাচের বয়ামে মিনিয়েচার ভরে রেখেও অনেকে ঘর সাজান। এতে বয়ামের কাচে আলোর প্রতিফলনে তা ছড়িয়ে পড়ে ঘরের চারপাশে। ঘরের জানালার গরাদেও জড়িয়ে রাখুন আলোর শিকল। ছোট  টুনি ও মিনিয়েচারের চেন রাখতে পারেন। নানা রকম এলইডি আলো দিয়েও ঘর সাজানো যেতে পারে। এখন নানা নকশার বাহারি গ্লাস লণ্ঠন পাওয়া যায়। সেগুলো দিয়ে গোটা ঘর সাজাতে পারেন। রঙিন কাচের নীচে এলইডি আলো বসানো থাকে। আলোর প্রতিফলনের বিজ্ঞান মেনে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়বে আলো। অথবা ঝাড়বাতি লাগিয়ে নিন সিলিঙে। বড় ছড়ানো ঝুলন্ত আলোর এই নকশায় সাজান ড্রয়িংরুমকে।
ফুলের বেলাতেও নানা হিসেব মাথায় রাখুন। ঘরের জানালা বড় হলে জানালার ধাপে লম্বা ডাঁটির ফুল রাখুন। ফুলদানি হোক চীনেমাটির বা কাচের। খুব ছিমছাম সাজ চাইলে বেত বা কাঠের ফুলদানিও রাখতে পারেন ফুল। বড় বড় সূর্যমুখী, উজ্জ্বল রঙের জারবেরা বা হলিহক রাখতে পারেন এখানে। সেন্টার টেবিলটি ফাঁকা রাখলে কিন্তু কুসুমসাজের পুরোটাই মাটি! তাই সেন্টার টেবিলের মাঝে একটি বড় পিতলের বা কাচের রেকাবিতে জল ভরে তার উপর ছড়িয়ে দিন গোলাপের পাপড়ি। রেকাবির চারপাশ ঘিরে দিন জুঁইয়ের মালা দিয়ে। ঘরের আয়তন দৈর্ঘ্যে বড় হলে ও আসবাব কম থাকলে দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে বড় মাটির ফুলদানিতে জারবেরা রাখতে পারেন। 
শোওয়ার ঘরে ফুল: এই ঘরের জন্য সাদা আলোর উপর ভরসা করুন। ছিমছাম মৃদু আলোর সজ্জাই শোওয়ার ঘরের মূল ইউএসপি। এই ঘরে আলাদা করে মিনিয়েচার বা এলইডি না লাগিয়ে অ্যাম্বিয়েন্ট আলো দিয়েই সাজাতে পারেন এই ঘর। অ্যাম্বিয়েন্ট আলো ইদানীং ইন্টিরিয়র ডেকরেশনে বহুল ব্যবহৃত। এই আলোর তীব্রতা বেশি, তাই ব্র্যাকেট করে এই আলোকে ঠাঁই দিন। এটিই ঘরের মূল আলো, সঙ্গে ডেকরেটিভ মোমবাতি বা ল্যাম্পও ব্যবহার করতে পারেন। 
শোওয়ার ঘরের ফুলের সাজ ব্যক্তির পছন্দবিশেষেই হওয়া উচিত। শোওয়ার ঘরের ফুলদানি হোক আকারে ছোট, গুচ্ছ ফুলের আধিক্য বেশি রাখুন এই ঘরে। সাদা ফুল পছন্দ করলে এই ঘরের জন্য সেটিই আদর্শ সাজ। সাদা লিলি অনেকগুলি রাখতে পারেন এই ঘরে। উৎসবের দিনে ঘরের সাজে খানিক কৌলীন্য যোগ করতে চাইলে বিছানার পাশে একটি ছোট রেকাবিতে অল্প জলে ভাসিয়ে দিন শিউলিদের। বাজার ঘুরে কপালজোড়ে অসময়ের কামিনী বা কেয়া পেয়ে গেলে তো কথাই নেই!  বেল ও জুঁই ফুলের মালা কিনে তাও ভিজিয়ে রাখতে পারেন অল্প জলে। অনেকই শোকের আবহে রজনীগন্ধার ব্যবহার বেশি বলে ঘরে এই ফুল  রাখতে চান না। আপনি সে দলে না পড়লে শোওয়ার ঘরের সাইড টেবিলে এক গোছা রজনাগন্ধাই রাখুন। এই ফুলের আবেদন অন্য সব ফুলের তুলনায় বেশি। 
খাবারঘরের ভোলবদল: সারা বছরের থোড় বড়ি খাড়া ছেড়ে ঘরকে মনের মতো করে সাজিয়ে তোলার খেলায় খাবার টেবিল ও খাবার ঘরের কোনাগুলিকে অবহেলা করলে চলবে না। সেখানে টুনি-আলোর তার দেওয়ালে টাঙিয়ে তার থেকে ফোটো ক্লিপের সাহায্যে নানারকম ফোটো ঝুলিয়ে ঘরকে দিতে পারেন আলাদা রূপ।
ডাইনিং টেবিলের মাঝে রাখুন পুরনো বোতল। বাড়িতেই নানা রকম রং দিয়ে তাকে সাজান। তারপর সেই বোতলে আলোর চেন ভরে সুইচ অন করলেই একেবারে অন্য রূপ হয়ে ধরা দেবে ডাইনিং টেবিল। অথবা মেঝে থেকে ৫ ফুট ওপরে ঝুলন্ত আলো রাখতে পারেন। সিলিঙের উচ্চতা বুঝে তেমন দৈর্ঘ্যের রড বা চেন লাগিয়ে নিন খাওয়ার ঘরে।
ফুলের ক্ষেত্রে অল্প রঙিন গ্লাডিওলাস রাখতেল পারেন খাবার টেবিলের মাঝে। খুব ঘরোয়া সাজ চাইলে মাধবীলতা হতে পারে আপনার অন্যতম পছন্দ। এই ঘরের দেওয়ালে হ্যাঙ্গিং ফুলদানিতে বোগেলভিলিয়ার ঝাড়ও ঝুলিয়ে দিতে পারেন অবলীলায়। আর ঘরের কোণগুলো ভরে দিন চেনা-অচেনা ছোট-বড় অর্কিড ও দোলনচাঁপায়। ঘরের সাজে খাবারের স্বাদও বেশি স্বাদু হয়ে ধরা দেবে অতিথির মনে। 
হেঁশেলের পুষ্পরাগ: রান্নার নিজস্ব এক হুড়োহুড়ি আছে, তাই এখানে এমন কোনও আলো লাগাবেন না, যা দেখতে সুন্দর হলেও সুরক্ষিত কম। তাই বাহারি মোম বা বাড়তি তার লাগানো টুনি এই ঘরের জন্য ভালো নয়। বরং এই ঘরের জন্য জোরালো ও ছিমছাম আলো বাছুন। সেক্ষেত্রে অ্যাম্বিয়েন্ট আলো লাগিয়ে নিতে পারেন।
রান্নাঘরেও রাখতে পারেন ফুল। এ ক্ষেত্রে ফুলদানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন রান্নার পুরনো বাসন। তা হতে পারে পুরনো সুগার পট, মিল্ক পট বা ছোট কেটলি। রান্নাঘরের জানালার তাকে এই ধরনের ফুলদানিতে রাখতে পারেন গন্ধরাজ, কাঞ্চন বা পারুল ফুল। ফ্রিজ ম্যাগনেট ফুলদানিরও এখন খুব চল। ফ্রিজের গায়ে ছোট্ট লতানে গাছ সঙ্গে ফুল রাখলে কিন্তু দিব্যি দেখাবে।
স্নানঘরে রকমফের: এলইডি ছোট ছোট আলোয় সাজান স্নানঘর। উৎস দেখা যাবে না, এমন কায়দায় আলোগুলো সেট করুন। এখানে জলের ব্যবহার বেশি, তাই খোলা তারজাতীয় আলো রাখবেন না। বাথরুমে সাদা ফুল রাখলেই ভালো। সঙ্গতে মানিপ্লান্ট। আয়নার সামনেও রাখতে পারেন ছোট্ট ফুলের তোড়া। 
অল্প আয়াসে ফুল দিয়ে ঘর সাজানোর পালায় ঘরের সঙ্গে মনও সেজে উঠবে। একটু যত্ন আর অল্প ভাবনায় নিরালা গৃহকোণ ভরে উঠবে অফুরান আনন্দে।