যে কোনও ব্যবসায় শুভ ফল লাভ। বিশেষ কোনও ভুল বোঝাবুঝিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। অর্থপ্রাপ্তি হবে। ... বিশদ
সুবর্ণরেখা নদীর ঘাটে শায়িত শতসহস্র শিলা, আর সেই থেকেই জায়গাটার নাম হল ঘাটশিলা। অন্তত জনশ্রুতি তাই বলে। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার ছোট্ট শহর এই ঘাটশিলা। ঘাটশিলা মানেই প্রকৃতির সঙ্গে লুকোচুরি, ঘাটশিলা মানেই সুবর্ণরেখা, ঘাটশিলা মানেই আদিবাসীদের সরলতা মাখানো হাসিমুখ। সর্বোপরি ঘাটশিলা মানেই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত বসতবাড়ি গৌরীকুঞ্জ।
ঘাটশিলার স্থানীয় ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, কয়েক শতাব্দী আগে রাজস্থানের ঢোলপুর থেকে এসেছিলেন জগন্নাথদেব নামে এক রাজপুত যুবক। কথিত আছে, খাতড়ার সুপুর পরগনার রাজা চিন্তামণি ধোপাকে হারিয়ে তিনি জগন্নাথ শাহজাদা ধবলদেব নাম নিয়ে ধলভূমের রাজা হন। তাঁর আমলে ধলভূমের রাজধানী হয় সুপুর। সেই ধলভূমই আজকের ঘাটশিলা।
হাওড়া জংশন থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেসে চেপে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ঘাটশিলায়। রিসর্ট বুকিং করা ছিল। সেখানে পৌঁছতেই ম্যানেজার আপ্যায়ন করে নিয়ে গেলেন। রুমের সামনেই ব্যালকনি। দূরে পাহাড়-টিলার মনোহর দৃশ্য এক লহমায় মনকে উড়িয়ে নিয়ে গেল অন্য এক জগতে। ফ্রেশ হয়ে সকলে বসলাম ব্যালকনির চেয়ারে। সামনেই রেললাইন। চারপাশে কাশফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য। হঠাৎ করে ঝিকঝিক আওয়াজ করতে করতে একটা মালগাড়ি ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে ছুটে চলে গেল। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-র অপু-দুর্গার রেল লাইনের ধারে দৌড়ে গিয়ে রেলগাড়ি প্রত্যক্ষ করার দৃশ্য। অনেক জায়গাতেই বেড়াতে গিয়ে রেলগাড়ির ছুটে চলার যান্ত্রিক আওয়াজ শুনেছি। কিন্তু এখানে এই মন কেমন করা শব্দ এক অনাস্বাদিত সুরসঞ্চার করল মনে।
প্রথমদিন বিকেলে পদব্রজে পৌঁছলাম ঘাটশিলা স্টেশনে। সেখানে গাড়ি ঠিক করে পরদিন সেই গাড়িতেই আমরা ঘাটশিলার ইতিউতি ঘুরে বেড়াব। সেই গাড়িতে ‘অপুর পথ’ পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত গৌরীকুঞ্জে। সাধারণত গ্রীষ্মাবকাশ ও পূজাবকাশে নিসর্গপ্রেমী সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্যে হাজির হতেন এখানে। কুটিরের অভ্যন্তরে লেখকের বিশ্রাম কক্ষ, শয়ন কক্ষ, রন্ধন কক্ষ। বিশ্রাম কক্ষের মধ্যে লেখকের ব্যবহৃত ধুতি, পাঞ্জাবি, লেখকের হাতের লেখায় চিঠির পাণ্ডুলিপি আর বই সযত্নে সংরক্ষিত। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য — এই বাড়িতেই বিভূতিভূষণ ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর অজানার দেশে পাড়ি দেন। কিছুটা দূরেই তিরতির করে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা। নদীর বুকে পাষাণসম অজস্র শিলাখণ্ড সূর্যের আলোয় দেদীপ্যমান। মাঝে মাঝে নদীর জল আছড়ে পড়ছে সেই দিগন্তবিস্তৃত উপল রাশির ওপর। কাছেই পঞ্চপাণ্ডব টিলা। এখানে প্রাকৃতিকভাবে পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাঁচজন পূর্ণাবয়ব মানুষের মূর্তি সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় মানুষজন মনে করেন এঁরা মহাভারতে বর্ণিত পঞ্চপাণ্ডব। কথিত আছে অজ্ঞাতবাসকালে পাণ্ডবগণ এখানে কিছুকাল ছিলেন।
এবার একটু প্রাকৃতিক রূপ-রস-গন্ধের স্বাদ নেওয়া যাক। আমরা উপস্থিত হলাম রাতমোহানায়। পাশাপাশি দু’টি ঝরনা উচ্ছ্বসিত নারীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে সুবর্ণরেখার দিগন্তবিস্তৃত চরাচরে। একসময় এই নদীর তটে সোনার দেখা মিলত, তাই এই নদীর নাম সুবর্ণরেখা। রাতমোহানা থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রমণীয় অভিজ্ঞতা স্মৃতির মানসপটে বহুদিন বাঁধিয়ে রাখার মতো।
পরের গন্তব্য ফুলডুংরি। ঘাটশিলা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ন্যাশানাল হাইওয়ের পাশে এই গোলাকৃতি পাহাড় বা টিলা। লাল নুড়ি বিছানো সর্পিল পাকদণ্ডী বেয়ে পাহাড়ের চূড়া বা টঙে উঠে যাওয়া যায়। শাল, পিয়াল, মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা বন্য প্রকৃতিতে আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম বিভূতিভূষণের অতি প্রিয় ফুলডুংরির চূড়ায়। নীচে আদিবাসীদের গ্রাম, আপন ছন্দে সরু সুতোর মতো বয়ে চলা সুবর্ণরেখা আর ঘাটশিলার টুকরো টুকরো ক্যানভাস। অনবদ্য দৃশ্যকে সঙ্গী করে পৌঁছে গেলাম ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘাটশিলা রাজবাড়িতে। কাছেই চিত্রকূট পাহাড়।
এরপর রিসর্টে ফিরে কিছুক্ষণ বিরতি। দুপুরের পালা প্রায় শেষ হতে আবার বেরিয়ে পড়লাম দ্বিতীয় পর্বের ভ্রমণের উদ্দেশে। ঘাটশিলা থেকে মোটামুটি ছ’কিলোমিটার উত্তরে বুরুডি লেক। যাত্রাপথটিও অসাধারণ। লাল মোরাম রাস্তা, কখনও কাঁচা সড়ক। রাস্তার দু’পাশে শাল, মহুয়া, মধ্যে মধ্যে আদিবাসীদের গ্রাম। দেখতে দেখতে পৌঁছলাম বুরুডি জলাধারে। তিনদিক পাহাড় পরিবেষ্টিত স্বচ্ছ, স্ফটিক জল। শুনলাম দলমা পাহাড় থেকে মাঝেমাঝেই হাতির পাল নেমে জলপানে। শালপাতায় পরিবেশিত সদ্য ভাজা পকোড়া সহযোগে পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে পাহাড়ের কোলে ঘুমাতে চলে গেল। এই হ্রদের পাড়ে প্রতি বছর অক্টোবরে পনেরো দিনের জন্য আদিবাসীদের বিন্দা মেলা হয়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। সময় থাকলে ধারাগিরি পাহাড় থেকে ২১ ফুট নীচে নেমে আসা ধারাগিরি জলপ্রপাতও তালিকায় রাখতে পারেন।
পরদিন গেলাম রঙ্কিনী দেবীর মন্দির দর্শনে। ঘাটশিলা থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে জাদুগোড়ায় অবস্থিত এই পবিত্র মন্দির। আগে জঙ্গলের মাঝে মন্দির ছিল, কিন্তু নগরায়নে জঙ্গলের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। আদিবাসীদের কাছে খুবই জাগ্রত উগ্ররূপা রঙ্কিনী মাতা। পরদিন ফেরার পালা। প্রকৃতি, সাহিত্য, ধর্ম, ইতিহাসকে সঙ্গী করে দিব্যি কেটে গেল কয়েকটা দিন।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে স্টিল এক্সপ্রেস/ ইস্পাত এক্সপ্রেস/জনশতাব্দী এক্সপ্রেস/ লালমাটি এক্সপ্রেস ইত্যাদি যে কোনও ট্রেনে ঘাটশিলা। সড়কপথে কলকাতা থেকে ঘাটশিলা সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা মতো।