সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
ঘটনা ১: কাকুর ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে গিয়েছিল অরুণিমা। সন্ধেবেলা, চারদিক প্রায় অন্ধকার। বাড়িও মোটামুটি ফাঁকা। কাকুকে ঘরে না দেখে দু’বার ডাকল সে। পিছন থেকে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎই। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে ইস্তক মুখে কথাটি নেই মেয়ের। প্রথমটা বাবা মায়ের চোখে পড়েনি বিষয়টা। কয়েকদিন পর আবারও কাকুকে চা দিয়ে আসতে বললেন মা। ডুকরে উঠল মেয়ে। সে আর যাবে না একা ও ঘরে। মায়ের জোরাজুরিতে কেঁদে ফেলল পনেরো বছরের অরু। সব কথা শুনতে শুনতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল মায়ের। এমন অপরাধের তো শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু কোন পথে এগবেন তাঁরা?
ঘটনা ২: মিঠির বাবারা চার ভাই। বড় একান্নবর্তী পরিবার ওদের। দাদা দিদিরা সকলেই পড়াশোনায় দারুণ। কেউ ডাক্তারি পড়ছে কেউ বা উচ্চমাধ্যমিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে কলেজে ঢুকেছে। মিঠির কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। রেজাল্টও আশানুরূপ হয় না কোনওবার। আর সেই কারণেই বড্ড হাসির পাত্র হয়ে গিয়েছে সে বাড়ির সকলের কাছে। তাকে দিয়ে ফাইফরমাস খাটায় বড়রা। জেঠিমা তো কথায় কথায় বলেন, ‘বাড়ির কাজগুলো মন দিয়ে শেখ মা, চাকরি-বাকরি না পেলে গায়ে গতরে খেটে অন্তত পুষিয়ে দিতে পারবি।’ মন খারাপ হয় মিঠির। আর সেই মনখারাপ মনেই পুষে রাখতে রাখতে কেমন যেন অবসাদে ভুগতে থাকে সে। কারও সঙ্গে কথা বলে না, হাসে না। বাড়িতে লোকজন এলে বাইরেও আসে না। মিঠির বাবার প্রথম নজরে পড়েছিল মেয়ের এই বদলটা। খাবার টেবিলে সবার সামনে এই নিয়ে প্রতিবাদ করলে ফল হিতে বিপরীতই হল। সকলে এবার প্রকাশ্যেই হাসাহাসি করতে লাগল মিঠিকে নিয়ে। কথায় কথায় খোঁটা দেওয়া বেড়েই যেতে লাগল। শেষপর্যন্ত আইনি পথের দ্বারস্থ হলেন মিঠির বাবা মা।
বাচ্চার উপর পরিবারিক অত্যাচার তা শারীরিক হোক বা মানসিক, নতুন কোনও ঘটনা নয়। আগেও হতো, এখনও হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা-মা লজ্জায় তা প্রকাশ্যে আনতে চান না। এই লোকলজ্জার ব্যাপারটা অবশ্য শারীরিক অত্যাচারের ক্ষেত্রেই বেশি। জানাজানি হলে মেয়েটাকেই বুঝি একঘরে করা হবে, এমন চিন্তা তাঁদের মনে ঘোরাফেরা করে সারাক্ষণ। কিন্তু যুগের বদলের সঙ্গেই পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চিন্তাধারা। আজকাল অনেক বাবা মা ভাবেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করা দরকার। ‘লোকে কি বলবে’ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা থাকে না। এরকম ক্ষেত্রে যদি কেউ এই নিয়ে প্রতিবাদ করতে চান? কোন পথে এগবেন তাঁরা? পরামর্শ দিলেন ফৌজদারি আইনজীবী সুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর কথায়, আমাদের রাজ্যের প্রতিটি জেলায় ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি’ বা সিডব্লুসি নামে একটা বডি রয়েছে। বাবা মা যদি বাচ্চার বিরুদ্ধে পারিবারিাক নির্যাতনের (শারীরিক বা মানসিক) অভিযোগ আনতে চান, তাহলে প্রথমেই সিডব্লুসি-এর দ্বারস্থ হতে হবে। তারা তখন আঞ্চলিক পুলিস স্টেশন বা থানায় খবর দেবে। পুলিস বিষয়টা শুনে তদন্ত শুরু করবে। যদি কোনও বাবা মা আগেই পুলিসের কাছে যান, তাহলে পুলিসই পুরো কেসটা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির কাছে রেফার করে দেবে। এরপর যে তদন্ত হবে তারও আবার কিছু ধাপ রয়েছে। প্রথমত পুলিস ঘটনাস্থলে যাবে এবং পুরো ব্যাপারটা বুঝে সেই বিষয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করবে। সেই রিপোর্ট জমা পড়বে সিডব্লুসি-এর অফিসে। তারা এই রিপোর্টের ভিত্তিতে একটা কেস সাজাবে এবং সেই কেস আদালতে উঠবে। এক্ষেত্রে আইনের ১৬৪ ধারা অনুযায়ী সিডব্লুসি পুলিসকে নির্দেশ দেবে অভিযোগকারীর জবানবন্দি নিতে। তারপর তা শুনে সিডব্লুসি-ই সিদ্ধান্ত নেবে তা আদালতে তোলা হবে কি না। অনেকক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমেও মীমাংসা করা হয়। তবে কোন ক্ষেত্র আলোচনায় মিটবে, কোথায় তার উপযুক্ত শাস্তি কোর্টে দেওয়া হবে— সেটা ঘটনার উপর নির্ভর করে। যদি কেস আদালতে ওঠে তাহলে যে বা যারা নির্যাতন করছে, তাদের আদালতে পেশ করা হবে এবং বিচারকের বিচার অনুযায়ী তাদের শাস্তি হবে। শাস্তির ধরন অবশ্যই দোষের উপর নির্ভর করবে। দোষের ধরনের উপর আলাদা আলাদা কেস করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী আদালতে দোষীর বিচার ও শাস্তি হবে। আইনজীবী বললেন, শারীরিক অত্যাচারের ক্ষেত্রে প্রমাণ দেখানো যতটা সহজ হয়, মানসিক অত্যাচারের ক্ষেত্রে তা হয় না। তখন অনেক সময়ই বাবা মাকে শাস্তির আবেদন করার আগে একজন ভালো মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলা হয়। তাহলে মনোবিদ রোগীকে দেখে তার মানসিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে পারেন এবং প্রয়োজনে তা আদালতে বা সিডব্লুসি-এর অফিসে জানাতে পারে।
শাস্তি তো না হয় হল, কিন্তু তার পরেও বাচ্চাটির মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসা একটা বড় ক্ষেত্র। এখানেও সিডব্লুসি-এর মতামত গুরুত্ব পায়। তারাই ঠিক করে দেয় বাচ্চাটির চিকিৎসার জন্য তাকে কোনও হাসপাতাল, হোম বা আশ্রমে পাঠানো হবে নাকি সে বাবা মায়ের কাছেই থাকবে। যদি বাবা মায়ের কাছে থাকে তাহলে সিডব্লুসি ক্রমাগত নজরদারি বজায় রাখবে। বাড়িতে বাচ্চাটির কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছে কি না, তার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্যরা ঠিক ব্যবহার করছে কি না, এগুলো সবই মনিটর করা হবে। আর যদি হোম বা আশ্রমে পাঠানো হয় তাহলেও সিডব্লুসি বাচ্চাটির উপর নজরদারি করবে। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে রেখেও বাচ্চার চিকিৎসা করাতে হয়, সেই ক্ষেত্রেও সিডব্লুসি-এর সিদ্ধান্তই সর্বাগ্রে গ্রহণযোগ্য। শিশুর উপর পারিবারিক নির্যাতন প্রসঙ্গে সুপ্রকাশবাবু বললেন, প্রতিবাদ না করলে সুস্থ সমাজ কখনওই গড়ে উঠবে না। ফলে লোকলজ্জার ভয়ে পিছিয়ে না থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সবসময়ই জরুরি। তাছাড়া সমাজের বদলের সঙ্গেই লোকের মনোভাবও বদলেছে। তবু আজও মেয়েদের দুর্বল ভেবে অত্যাচার চালানো হয়। এর প্রতিকারের প্রথম ধাপই প্রতিবাদ। ফলে অন্যায় সহ্য করবেন না।