বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
রবীন্দ্রনাথ মহাভারতকে দেখেছিলেন ‘একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস’ রূপে। সেই জাতি যদিও এই বহু সহস্র বৎসরের ব্যবধানে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরাজ করছে, তবু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির বিরাম নেই। মূলের সঙ্গে যুক্ত অথবা বিচ্ছিন্ন—সবার মধ্যে আজও মহাভারতকথার দুর্নিবার আকর্ষণ প্রবলভাবে রয়ে গেছে। তাই আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে যখন প্রথমবার টিভি’তে রাহী মাসুম রজার তৈরি স্ক্রিপ্টে মহাভারত দেখানো হচ্ছিল তখন কলকাতায় যেমন বাস-ট্রাম ফাঁকা চলত তেমনই খবর ছিল পাকিস্তানেও সেই সময়টায় পথঘাট জনবিরল হয়ে পড়ত। সবাই তখন নিবিষ্ট মনে টিভি’র পর্দায় এই বিশাল ভারতের নিতান্ত আপন সেই প্রাচীন কথার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত। মহাভারতের সেই পুরুষার্থ, স্বার্থ বা পরমার্থের কাহিনীর মধ্যে সবাই নিজের মতো, আপন করা কিছু খুঁজে পেত।
বহুচর্চিত ও বহুশ্রুত সেই মহাভারত কাহিনীর বিভিন্ন পর্বকে আমরা চিরকালই জীবনের নানা পর্যায়ে নানাভাবে ঘটতে দেখি। বর্তমানের এই ভোটযুদ্ধ, অর্থাৎ ভারত খণ্ডের সকল সাবালক মানুষকে যুক্ত করা এই যুদ্ধও তেমনই এক ঘটনা। সেই যুদ্ধের সলতে পাকানো শুরু হয়েছে বেশ কিছুকাল আগেই। মানুষ চিরকালের মতো আজও চায় স্বার্থ, শঠতা, চৌর্য, মিথ্যা ইত্যাদি যেন জয়ী না হয়। সততা ও পুরুষার্থের জয়ের মধ্যে আজও মানুষ নিজের জয়কে খুঁজে পায়, তাদের শুভবুদ্ধি আজও জানায় পরিবারের, সন্তানাদি সকলের শাশ্বত কল্যাণ, স্বস্তি ও সমৃদ্ধি নিহিত রয়েছে ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়ের মধ্যে। তবু দুর্যোধনের অন্নদাস বা হস্তিনাপুরের সিংহাসনের নিঃশর্ত রক্ষাকারী হিসেবে দ্রোণ, ভীষ্ম ইত্যাদির মতো মহাবীরেরাও যেমন একবস্ত্রা কুলবধূ দ্রৌপদীর রাজ্যসভা মধ্যে বস্ত্র হরণের সময়েও প্রতিবাদহীন হয়ে নপুংসকের মতো নিশ্চুপে বসেছিলেন তেমনই বর্তমান সমাজেও বহু মানুষ নানাবিধ দাসত্বের চাপে চারদিকে ঘটে চলা শত সহস্র অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার নিঃশব্দে দেখে যেতে বাধ্য হয়ে আছে। ত্রাস বা দাসত্ব, কারণ যাই হোক, অধিকাংশ মানুষই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সবাই এখন নীরব দর্শক, অপেক্ষা করে আছে সেই মহাক্ষণের যখন আসন্ন ভোটযুদ্ধে অংশ নিয়ে তারা নিঃশব্দে নিজেদের মতামত জানাতে পারবে, হয়তো বা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনও করতে পারবে।
মহাভারতে উল্লেখিত অধিকাংশ প্রধান রাজ্যগুলির অবস্থান ছিল বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরে এবং গাঙ্গেয় অববাহিকা ও তার পশ্চিমের অংশে। সে সব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম, সেচ ছাড়া ফসল ভালো হয় না। স্বাভাবিকভাবে জন্মানো তৃণের ওপর নির্ভর করে গো-পালন করা ছিল সেখানে এক গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা, যা আজও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গাভি ছিল অমূল্য। রাজা নহুষের এক উপাখ্যানে পাই মহর্ষি চ্যবনের মূল্য হিসেবে যখন তাঁর সমগ্র রাজ্যও অকিঞ্চিৎকর বিবেচিত হয় তখন এক তপস্বী বলেন গো এবং ব্রাহ্মণ উভয়ই অমূল্য। তাই মহর্ষির মূল্যস্বরূপ একটি গাভিই ঠিক বলে বিবেচিত হয়। রাজা নহুষও সমস্যামুক্ত হন। আজও গোধন সেই বলয়ের শ্রেষ্ঠ ধন। গোপালন করা এক গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা।
গোপালন এবং গোধন অপহরণের নানা ঘটনার কথা মহাভারতে রয়েছে, একেবারে সেই আদি পর্ব থেকেই। হস্তিনাপুরে গোধন চুরি নিয়ে রাজার কাছে অভিযোগের বর্ণনা আমরা পাই। বিরাট পর্বে গোধন অপহরণ এক বিরাট আকার পেয়েছে। মৎস্য দেশের অধিপতি অর্থাৎ বর্তমানে উত্তর-পূর্ব রাজস্থানের তৎকালীন রাজা বিরাটের ছিল বিপুল গোসম্পদ। প্রধানত সেই সম্পদের জোরেই তিনি ছিলেন কুবের তুল্য ধনী। তাঁর আশ্রয়েই পাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের এক বছর কাটিয়েছিলেন। তাঁদের অজ্ঞাতবাসের শেষ দিনটিতে মৎস্য দেশের পার্শ্ববর্তী ত্রিগর্ত্তদেশের রাজা সুশর্মা বিরাট রাজার গোধনের একাংশ হরণ করতে এসে বিরাট রাজার সাহায্যকারী পাণ্ডব ভাইদের বিক্রমে পরাজয় স্বীকার করে নতমস্তকে ফিরে যান। পরদিনই দুর্যোদন সপারিষদ বিশাল সৈন্যসহ বিরাট রাজার ষাট হাজার গাভি হরণ করলে যে যুদ্ধ হয় তাতে দুর্যোধনদের সকলেই হতচেতন হয়ে পড়ে। কর্ণের এক ভাইসহ অন্য বহুজনের মৃত্যুও হয়। হতচেতন কৌরবদের উত্তরীয়গুলি অর্জুন হরণ করে উত্তরার পুতুলের জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু হতচেতন কাউকে তারা হত্যা করে না। বর্তমানেও বেশ কিছুকাল ধরে সেই গোবলয় অঞ্চলে নানাসময়ে গোধন হরণ ও হরণকারীর নিগ্রহ বা মৃত্যুর খবর আমরা পাই। তবে পার্থক্য এই থাকে গোধন হরণকারীকে নিগ্রহ করলে বা তার মৃত্যু ঘটলে তার অদ্ভুত সব ব্যাখ্যা করা হয়। গোধন হরণকারী কোন সম্প্রদায়ের বা জাতির তার ওপরে প্রায়ই নির্ভর করে সেইসব আলোচনার তীব্রতা। সেই আলোচনায় মানুষের জীবিকা, অর্থনীতি বা চৌর্যদোষের কোনও স্থান থাকে না। এখন মানুষ যত সম্প্রদায়ে বিভক্ত মহাভারতের যুগে তা ছিল না। এখন যেমন স্বর্গলাভের প্রকৃষ্টতম উপায় হিসেবে অন্য মতাদর্শীদের হত্যা বা লুণ্ঠন শ্রেষ্ঠতম উপায় বলে একদল মানুষ প্রচার করছে, মহাভারতের যুগে সম্মুখ সমরে মৃত্যুকেই স্বর্গলাভের উপায় বলা হতো। যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মপরায়ণ মানুষও ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ বলার জন্য নরকে গমন করেছিলেন, সেই মানবধর্মের কথা আমরা জানি। দুর্যোধনাদির দুর্বৃত্ততার কথা তাঁর মাতা-পিতা সর্বদাই মানতেন ও নিন্দা করতেন। যুধিষ্ঠিরের সততা শত্রুপক্ষীয়দেরও প্রশংসার বিষয় ছিল। পুত্রস্নেহের বিবশতার কথা ধৃতরাষ্ট্রকে বহুবার স্বীকার করতে দেখা গেছে। তখন বলা হতো ‘শত্রোরপি গুণা বাচ্যা দোষা বাচ্যা গুরোরপি’ অর্থাৎ শত্রুরও গুণাগান করা উচিত এবং গুরু দোষযুক্ত হলে তা বলা উচিত। সেসব নীতিকথা এখন হালে পানি পায় না। এখন প্রতিপক্ষের গুণগান করার বা গুরু বা নেতার দোষ দেখার মতো লোক নেই। তারা সাহস, সততা সব হারিয়ে উলুখাগড়া হয়ে গেছে। ফলে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ার প্রাণ যাবেই, ‘নষ্টমেব হি’। ভোটযুদ্ধের উদ্যোগপর্বের প্রাণহানি শুরু হয়ে গেছে। নিশ্চয় তা প্রতিবারের মতো যুদ্ধ শেষ হলেও চলবে। এই প্রাণহানি রোধে বা দোষীদের শাস্তিবিধানে চিরকালীন দৃষ্টান্তে হয়তো এবারও ব্যর্থ হবে প্রশাসন।
গোবলয়ের অর্থনীতি এবারের ভারতযুদ্ধে এক নির্ণয়কারী ভূমিকা নিতে চলেছে। গোরক্ষকদের একদেশদর্শিতার কারণে বাস্তব ক্ষেত্রে গোপালকেরা ও কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে। গত কয়েকবছরে পশু খাদ্যের মূল্য প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। ফলস্বরূপ গো পালকেরা গোরু চুরির ভয় দূর হওয়ায় নিজেদের গোরুর পালকে মুক্ত করে দিচ্ছে যাতে তারা নিজেরাই চরে খায়। চারণভূমিই যেখানে নেই সেখানে কৃষকের শস্যক্ষেত্রে হামলা হচ্ছে। ফসল নষ্ট হচ্ছে। রাত জেগে কৃষকেরা ফসল পাহারা দিচ্ছে। দুর্ভাবনায় তাদের রাতের ঘুম চলে গেছে। আগে দুধ না দেওয়া গাভি বা অকেজো বলদকে গোপালকেরা অল্প মূল্যে বিক্রি করে দিয়ে সেগুলি পালন করার দায় থেকে মুক্ত হতো। সেই পশুগুলি স্বল্পমূল্যের মাংসের জোগান দিয়ে বহু মানুষকে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করত। ইদানীং সেই সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে।
সুখ-দুঃখের মতো জয়-পরাজয়ও চক্রবৎ পরিবর্তিত হয়। চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে। জগতে এ নিয়মের কোনও ব্যত্যয় নেই। শুধু কর্মটাই তো আমাদের আয়ত্তে থাকে, অধিকারে থাকে। ফল থাকে তো সেই ওপরওয়ালারই হাতে।