বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
এইরূপ আবহে নির্বাচন কমিশন ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেছে। গত সপ্তাহ দুই ধরে কেন্দ্রীয় শাসক দলের ছোট বড় মাঝারি বিভিন্ন নেতা সেনা বাহিনীর এই বীরত্বকে তাঁদের সাফল্য হিসেবে প্রচার করে চলেছেন। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের বিরুদ্ধেও সেনা বাহিনীকে সামনে রেখে দলীয় প্রচারের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে কতজন জঙ্গি খতম হয়েছে সেই প্রশ্ন তুললেই বিরোধীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। বিজেপির কেউ কেউ আবার বিরোধীদের বিমানে চাপিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে ফেলে দিয়ে আসার কথা বলছেন—যাতে করে বিমান বাহিনীর ফেলা বোমার প্রভাব তাঁরা স্বচক্ষে দেখে আসতে পারেন! বিমান বাহিনীর আক্রমণে প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যে শাসকের কাছে একেবারেই নাপছন্দ তা তাঁরা নানাভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সামরিক অভিযান বা যুদ্ধের মতো বিষয়কে নিয়ে প্রশ্ন করা নতুন কোনও বিষয় নয়। ১৯৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধের পর ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তৎকালীন প্রস্তুতির খামতি নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসকের বিরুদ্ধে যথেষ্ট হইচই হয়েছিল। এমনকী, ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধেও গোলাবারুদ মজুদের অপ্রতুলতা নিয়ে বা নিহত সেনা জওয়ানদের জন্য কফিন কেনাকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে বা উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রবাসীদের একাংশের মধ্যেও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে সে-দেশে মিটিং মিছিলও সংঘটিত করেছিলেন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সমস্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয় না। এখানেই চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশের তফাত।
তবে, সমস্ত বিতর্ক সরিয়ে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রশ্ন হল—যুদ্ধের আবহ কি কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিকে নির্বাচনী বৈতরণী পেরতে সাহায্য করতে পারে? আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, ভারতীয় সেনা বাহিনীর এই সাফল্য বাস্তবে বিজেপিকে
নির্বাচনে কতটুকু বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিতে পারে?
এই প্রশ্নে সংবাদ মাধ্যম জুড়েই চলছে সমীক্ষার ফল। তাতে প্রশ্ন থাকছে—পুলওয়ামায় ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যুর ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি সরকার কি জবাব যথাযথভাবে দিতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন? ওই ঘটনা আগামী ভোটে বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা দেবে বলে কি মনে হয়? বলাই বাহুল্য, এই ধরনের প্রশ্নের অধিকাংশের উত্তর নরেন্দ্র মোদির সাফল্যের দিগ্নির্দেশ করছে।
একথা অনস্বীকার্য যে ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর এই প্রথম ভারতীয় বিমান বাহিনী সরাসরি পাকিস্তানের আকাশ সীমা অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদী শিবিরে আঘাত করে ফিরতে পেরেছে। ইজরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া ছাড়া বিমান বাহিনী দিয়ে অন্য দেশাভ্যন্তরের জঙ্গিশিবির গুঁড়িয়ে দেওয়ার উদাহরণ খুব বেশি নেই। সেনা বাহিনীর এই বীরত্বের পাশাপাশি এই প্রথম আন্তর্জাতিক দুনিয়া একজোট হয়ে সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। এমনকী, ভারত-পাকিস্তান এই দ্বন্দ্বে চীনও সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নিতে পারেনি। কূটনীতির জায়গা থেকে নিঃসন্দেহে এটি নরেন্দ্র মোদির একটি বড় সাফল্য। স্বভাবতই নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহরা চাইবেন সেনা বাহিনীর সাফল্যের পাশাপাশি কূটনৈতিক সাফল্যের উপর ভর করে নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিতে। যদিও এক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকছে যুদ্ধের ভাবাবেগ ভোটের রাজনীতিকে কতটুকু প্রভাবিত করতে পারে?
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সে-দেশের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। অথচ, চার্চিল ১৯৪০-৪৫ এই সময়কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সফল হলেও যুদ্ধের অব্যবহিত পর জাতীয় রাজনীতিতে শ্রমিক দলের নেতা ক্লিমেন্ট এটলির কাছে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। যুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে রুজি-রোজগার, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মানুষের মূল চাহিদা পূরণের প্রশ্নে তাঁরা চার্চিল অপেক্ষা এটলির উপরেই ভরসা রেখেছিলেন।
আবার, ইতিহাসে একের পর এক উদাহরণ রয়েছে যেখানে যুদ্ধের থেকে উৎপন্ন জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ শাসক দলকে যুদ্ধ-পরবর্তী ভোট বৈতরণী পেরতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনী সরাসরি পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। সেনার এই সাফল্য ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বকে এমন এক উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠা করেছিল যে ভারতীয় সংসদে বিরোধী দলের তৎকালীন নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ি তাঁকে ‘দেবী দুর্গা’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ ১৯৭১-এর লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীকে বিপুল সাফল্য এনে দিয়েছিল। আবার, পূর্ণ যুদ্ধ না-হলেও কার্গিলের সীমিত যুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বীরত্ব তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়িকে ১৯৯৯-এর লোকসভা নির্বচনে বাড়তি সুবিধা না-দিলেও পূর্বের অবস্থা ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল। পাশাপাশি কার্গিল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাজপেয়ির নেতৃত্ব এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছিল যার ফলে ছোট বড় ২৪টি দলের সমর্থন নিয়ে তিনি কেন্দ্রে পাঁচ বছর সরকার চালাতে পেরেছিলেন।
ইতিহাসে আবার এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মানুষের ক্ষোভকে চাপা দেওয়ার জন্য বা অন্যত্র চালিত করার জন্য শাসক নিজেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধে জড়িয়ে জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ তুলে শাসক কখনও যেমন সফল হয়েছে তেমনি কখনও আবার ব্যর্থ হয়েছে, যুদ্ধ-পরবর্তী পর্যায়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরতে। যেমন আর্জেন্টিনার শাসক জেনারেল লিও পোলডো গলটিয়ারয় দেশের বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন ফকল্যান্ড দ্বীপে সেনা পাঠিয়ে আকস্মিকভাবে অধিগ্রহণ করেন। সেনা পাঠিয়ে আর্জেন্টিনা যে ফকল্যান্ড দখল করে নিতে পারে তা ব্রিটেনের ধারণার বাইরে ছিল। ব্রিটেন তড়িঘড়ি বিমান এবং নৌ বাহিনী পাঠিয়ে আর্জেন্টিনাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে ফকল্যানডের পূর্ণ দখল নেয়। ব্রিটেনের সঙ্গে আর্জেন্টিনার এই যুদ্ধে ২৫৮ জন ব্রিটিশ সেনা এবং ৬৪৫ জন আর্জেন্টিনার সেনার মৃত্যু ঘটে। ফকল্যান্ড যুদ্ধ জয়ের পর তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হলেও আর্জেন্টিনার স্বৈরাচারী শাসক গলটিয়ারের উপর সে-দেশের সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কয়েক গুণ বেড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে পদ ছাড়তে হয়।
অর্থাৎ, যুদ্ধ শাসককে নির্বাচনে কখনও জিতিয়েছে, কখনও-বা হারিয়েছে। চার্চিলের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতাকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিনের মানুষ সে-দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে প্রত্যাখ্যান করেছিল। শ্রমিক নেতা এটলির উপরে সাধারণ মানুষ ভরসা রেখেছিলেন। আসলে, জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ কতটুকু কাজ করবে তা নির্ভর করে সেই দেশের সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃবর্গের উপর সাধারণ মানুষের ভরসা বা বিদ্যমান শাসক দল ও তার নেতাদের কর্মপন্থার উপর। নরেন্দ্র মোদির সরকারের পাঁচ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা পরখ করার পাশাপাশি মানুষ কিন্তু বিরোধী নেতাদের উপর ভরসা রাখতে পারছে কি না সেই বিষয়টিও ভোটারদের কাছে গুরুত্ব পাবে। জাতীয়তাবাদী ভাবনা একটি স্তর পর্যন্ত মানুষকে প্রভাবিত করলেও নির্বাচনী সাফল্যের সঙ্গে সর্বদাই যে তার সরলরৈখিক সম্পর্ক থাকে ইতিহাস অন্তত তা বলে না। কর্মসংস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়গুলি শেষপর্যন্ত নির্বাচনের মূল ইস্যু হিসেবে উঠে আসতে দেখা গিয়েছে বার বার।
লেখক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক