বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
অনেকে অবশ্য বলছেন, যুদ্ধবন্দি নিয়ে জেনিভা চুক্তি অগ্রাহ্য করার সাহস পাননি বলেই ইমরান বন্দি ভারতীয় বায়ুসেনা অভিনন্দনকে মুক্তি দিয়েছেন। ওই চুক্তির দাপটেই ও দেশের সেনাও তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার বিশেষ সুযোগ পায়নি। পাক ভূখণ্ডে ধরা পড়ার সময় স্থানীয় লোকজনই মারধর যা করার করে নিয়েছে। জেরার সময় অভিনন্দনের বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি ও দৃঢ়তার সামনে পাক-সেনা অফিসারদের মর্যাদা বজায় রেখেই এগতে হয়েছে। সে কথা পরবর্তীতে অভিনন্দনও স্বীকার করেছেন। তাঁর পাঁজরে ও দেহের অন্যত্র যেসব আঘাতের চিহ্ন মিলেছে তার কারণ অবশ্য এখনও আমাদের অজানা। তার জন্য পাক-সেনার ভূমিকাও এখনও স্বীকৃত নয়। কিন্তু, একটা ব্যাপার পরিষ্কার, অভিনন্দনকে নিঃশর্তে ছেড়ে দিয়ে ইমরান খান আর কিছু না করুন যুদ্ধ বাধার উপক্রমটি অনেকটাই ফিকে করে দিয়েছেন। এখন যুদ্ধ বিরতি চুক্তি ‘লঙ্ঘন’ করে পাক গোলাগুলি বা তার জবাবে ভারতীয় সেনার পাল্টা সামরিক তৎপরতা যা ঘটছে সেসব ভারত-পাক সীমান্তের নিত্যদিনের ঘটনা। বছরের পর বছর ধরেই এসব চলছে আর তার জেরে মাঝেমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সীমান্ত সন্নিহিত সাধারণ জনজীবন বিপর্যস্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হয়েই চলেছে। পাক-গোলায় বাড়িঘর ধ্বংস থেকে নিরীহ মানুষজনের মৃত্যু সেকাল থেকে একাল এমনকী আজও কোনও নতুন ঘটনা নয় ভূস্বর্গে!
বরং, যেদিন থেকে কাশ্মীর নিয়ে দু-দেশের সামরিক সংঘাতে জঙ্গি-মাত্রা যুক্ত হয়েছে, সীমান্তে সামরিক গোলাগুলির রুটিন বিনিময় ছাপিয়ে উঠেছে জঙ্গি সন্ত্রাসের বীভৎসতা সেদিন থেকে মানুষের বিপন্নতাই কেবল বাড়েনি, তাঁদের মধ্যে বিশেষত, তাঁদের নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীর মধ্যে অস্তিত্ব সংকটের অস্থিরতাও প্রবল হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর আগে কাশ্মীরের মাটিতে বসে এমনই আক্ষেপ করছিলেন ওয়ানিসাব। নামটা বলছি না। শুধু এটুকুই বলছি, ওয়ানিসাব উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার ছিলেন, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। তিনি স্পষ্টতই বলেছিলেন, যতদিন কাশ্মীর সমস্যাকে একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখা হবে ততদিন এই সমস্যা বেড়েই চলবে। এবং কাশ্মীরি জনতাও রাজনীতির পাকেচক্রে পড়ে বিভ্রান্ত হবেন, দিকভ্রষ্ট হবেন, এমনকী দেশের ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সংহতির পরিপন্থীও হয়ে উঠতে পারেন কেউ কেউ!
সত্যি বলতে কী, পুলওয়ামার ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা ও ৪৪ জওয়ান মর্মান্তিকভাবে শহিদ হওয়ার পর যখন ওই নারকী ঘটনায় যুক্ত জঙ্গিদের পিছনে স্থানীয় যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছিল তখন ওয়ানিসাবের ওই কয়েক বছরের পুরনো মন্তব্যটা ফের একবার ঝলকে উঠেছিল মনে! পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের পদক্ষেপে যুদ্ধ থেকে আপাতত অব্যাহতি পেয়েছে দুই দেশ কিন্তু, কাশ্মীরি জনতার মনের ক্ষতগুলো মুছতে না পারলে, রাজনীতির চশমা খুলে মানবিকতা ও সম্প্রীতির উদার চোখে তাঁদের সমস্যাগুলোকে দেখতে না পারলে ভবিষ্যতে যুদ্ধ কি ঠেকানো যাবে? যাঁরা ভাবছেন, পাক ভূখণ্ডের কটা জঙ্গি শিবির গুঁড়িয়ে দিলে বা মাসুদ আজাহারের মতো কটা জঙ্গি নেতা খতম হলেই জঙ্গিসন্ত্রাস শেষ হয়ে যাবে, কাশ্মীরের গুলবাগিচার হাসিতে ভরে উঠবে জনজীবন—তাঁরা কতটা ঠিক ভাবছেন তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, বিভিন্ন সময় নানা নিরাপত্তা এজেন্সির রিপোর্ট ও ঘটনাবলিই প্রমাণ করেছে স্থানীয় মাটির রস ও রসদ তাদের জঙ্গি ক্রিয়াকলাপ চালাতে সহায়তা করেছে এবং করছে।
এই রস ও রসদ জোগানের সাপ্লাই লাইন বন্ধ করার মূল উপায় যে উন্নয়ন, উন্নয়ন এবং উন্নয়ন—সার্বিক লাগাতার উন্নয়ন তা বলেছেন, আজও বলেন অনেক মহামুনিজন। তাঁদের মতে, উন্নয়নের জোয়ার উঠলেই অলস মস্তিষ্কে শয়তানের বাসাগুলো খান খান হয়ে যাবে—কাশ্মীরের নবীন প্রজন্ম জীবনের ইতিবাচক দিশা পাবে, জঙ্গিরা ভারতের মাটিতে রস-রসদের জোগানের অভাবে এমন বেমক্কা বজ্জাতির শক্তি-সাহসও অনিবার্যভাবেই অনেকটা হারিয়ে ফেলবে। এতে কাশ্মীর সমস্যা পুরোপুরি না মিটলেও কাশ্মীরি জনজীবন বাঁচার নতুন দিশা পাবে, জোর পাবে সাম্প্রদায়িক প্রীতি জাতীয় সংহতি। এখন কথা হল, ‘যুদ্ধ’ কি এক্ষেত্রে এই কাজটা করে দিতে পারে? পারে না যে তা এর আগে অনেকবার প্রমাণিত। কার্গিলের স্মৃতি এখনও বিশেষ ঝাপসা নয়—পেরেছে? পারলে পুলওয়ামা বা তার মতো মারাত্মক সব ঘটনা আজও ঘটে চলেছে কেন? ‘যুদ্ধ’ যখন একাধিকবার কাশ্মীরে জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ দেখা যাচ্ছে তখন সার্জিকাল স্ট্রাইকে জঙ্গি নিধন ও তাদের ঘাঁটি ওড়ানোর পরও কেন যুদ্ধের দিকে মুখ? ইমরানের চালে যুদ্ধটা আপাতত বাধল না বটে তবে ভবিষ্যতেও বাধবে না এমন গ্যারান্টি তো নেই। কিন্তু, কেন? আসলে, এক্ষেত্রে যুদ্ধটা তো সেই অর্থে সরাসরি কোনও দেশের সঙ্গে নয়, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে, জঙ্গি উৎখাতের জন্য। আর কে না জানে জঙ্গিদের কোনও দেশ নেই, জীবাণুর মতো তারা দুর্বল শরীরকেই আশ্রয় বানিয়ে তোলে। জয়েশ থেকে আইএস—একটু নজর করলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।
কিন্তু, মুশকিলটা হল, সার্জিকাল স্ট্রাইক থেকে সম্ভাব্য যুদ্ধ ব্যাপারটা এমনভাবে আমাদের মধ্যে প্রচারিত হয়েছে যাতে আমরা ধরেই নিয়েছি প্রতিপক্ষ পাকিস্তান (যে দেশের প্রতি দেশজনতার একটা অংশে বীতরাগ ও ক্ষোভ প্রবল) যুদ্ধই হোক, কী সার্জিকাল স্ট্রাইক—দুটোর লক্ষ্যই ওই প্রতিবেশী দেশ। পুলওয়ামার ঘটনার পর ‘পাকিস্তান জঙ্গিদের মদতদাতা আশ্রয়দাতা’—এমন অভিযোগ দেশের মানুষের একাংশ পাক-বিদ্বেষ আরও উস্কে দিয়েছে! এতটাই যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সার্জিকাল স্ট্রাইক ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য জানতে চাওয়ায় শাসকদল থেকে নেটিজেন বহুজনের বিরাগভাজন হয়েছেন, তাঁর নামে যা ইচ্ছে বলা হয়েছে, হচ্ছে! আমার বন্ধু প্রাক্তন সেনানী শ্যামলও পুলওয়ামার পর দোষীদের কঠোরতম শাস্তি দিতে রীতিমতো উত্তেজিত। অথচ, মজাটা এই—শ্রীলঙ্কায় শান্তি সেনা হিসেবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা বহু যুদ্ধের সক্রিয় সৈনিক শ্যামলের চোখেও জঙ্গি-বিরোধিতা পাক-বিরোধিতায় ফারাকটা নজরে আসছিল না! বলতে কী, পুলওয়ামার পর গোটা দেশে জেগে ওঠা টগবগে আবেগময় দেশপ্রেমে তাঁর মতো সচেতন যুদ্ধনিপুণ প্রাক্তন সেনাও কাবু হয়েছিলেন এতটাই যে, জঘন্য জঙ্গি আর প্রতিবেশী দেশ তাঁর চোখেও একাকার হয়ে গিয়েছিল! তাহলে সাধারণের মনের কী দশা হয়েছে ভাবুন!
হবে না কেন? গত ১৪ ফেব্রুয়ারির পুলওয়ামা কাণ্ডের পর থেকে কাগজে মিডিয়ায় সর্বত্র কেবল তো যুদ্ধ আর যুদ্ধ। হুমকি আর প্রতিহুমকি। এবং দেশপ্রেম, বন্যার মতো দিক ভোলানো দেশপ্রেমের আবেগ। আমার পরিচিত এক প্রবীণজনের উক্তি, তা বাপু, যুদ্ধ তো বুঝলাম কিন্তু এই ভরা ভোটবাজার ইস্যুগুলো সব গেল কোথায়! রাফাল, সিবিআই, ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি, আরবিআই নোটবন্দি—কোথায় সব? গেরুয়া শিবিরকে চাপে রাখতে এসব নিয়ে কত তোলপাড় শুরু হয়েছিল! গেল কই!! আগুস্তা হেলিকপ্টার, সারদা নারদা, ওয়াধেরা—সেসবই বা কোথায়! সত্যিই তো, ভোটবাজার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলকে কুপোকাত করতে বিরোধীদের ইস্যুগুলো সব গেল কোথায়! কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে মোদিজির শিবির থেকে তোলা অভিযোগ—সেসবই বা কোথায়? এখনও তো যেদিকে তাকাই যুদ্ধভাব আর আবেগে আপ্লুত দেশপ্রেম। অভিনন্দন ফেরার পর খানিকটা স্তিমিত হলেও পুরনো ইস্যুরা ফিরে আসার পথ এখনও পায়নি। একটি ইস্যুই এখনও সর্বব্যাপ্ত—দেশপ্রেম। আর তার জীবন্ত বিগ্রহ অভিনন্দন। দেশ জনতা এখনও তাতে আপ্লুত অভিভূত—সেনা গৌরবে গৌরবান্বিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিতে আচ্ছন্ন। বাজেটে ঢালাও সুবিধা দিয়ে, কী অন্য কোনওভাবেও তো দেশের মানুষের মন ফেরানো যাচ্ছিল না! কিন্তু, এবার? পুলওয়ামা ও সার্জিকাল স্ট্রাইক তো বিরোধীদের সব ইস্যু শেষ করে দিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিরোধী জোট ইস্যু খুঁজতে হয়রান হচ্ছেন! গেরুয়া শিবিরের আত্মতুষ্ট নেতানেত্রীরা এমনটা মনে করতেই পারেন। তবে কী, মানুষের মন তো! সবসময় গুনে দেখে না হয়তো, কিন্তু কম পড়লে ঠিক টের পায়। সেটাই সমস্যা।