ঠাকুর স্টার থিয়েটারে গৌরাঙ্গলীলা দেখতে এসেছেন। সেই প্রসঙ্গ চলছে। নিতাই নিমাইকে খুঁজছেন, নিমাইও নিতাইকে খুঁজছেন। এই নিমাই আর নিতাই-এর সম্বন্ধ, বৈষ্ণব ভক্তিশাস্ত্রে একটি বিশেষ ঘটনা। নিমাই সর্বভাবের আধার এবং সেই ভাবকে গ্রহণ করার মত অধিকারী হচ্ছেন নিতাই। গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সমাজে গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত—এই তিনটি নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। প্রেমের উৎস শ্রীগৌরাঙ্গ আর সেই প্রেম বিতরণ করছেন নিতাই। নিতাই যেন তাঁর ভাবের ধারক ও বাহক। অবতার যখন আসেন তাঁর কোন এক বিশেষ পার্ষদকে আশ্রয় করে তাঁরই ভিতর দিয়ে তিনি কাজ করেন। নিত্যানন্দ সেইরকম অদ্বিতীয় পার্ষদ আর অদ্বৈত আচার্য সম্পর্কে বলা হয় যে তাঁর আকুল আহ্বানে ভগবান আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই অদ্বৈত আচার্য হলেন ভগবানের অবতীর্ণ হবার বিশেষ কারণ। শ্রীগৌরাঙ্গ বলছেন, অদ্বৈত পূজারী, সে আবাহন করেছে। শ্রীরামকৃষ্ণের যুগেও আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীশ্রীমা এবং স্বামীজী—দুজনে দুদিক দিয়ে সেই সত্তার ধারক এবং বাহক অর্থাৎ একই সত্তার তিনটি বিকাশ। এখানে নিমাই নিতাইকে বলছেন ‘সার্থক জীবন’; কেন? তাঁর কি কোন অপূর্ণতা ছিল যা নিত্যানন্দ আসায় পরিপূর্ণ হল? অপূর্ণতা নয়, তিনি যে উদ্দেশ্যে দেহধারণ করে এসেছেন, সেই উদ্দেশ্য সফল হবে নিত্যানন্দের সহযোগিতায়। তাই বলছেন, ‘সার্থক জীবন’। আর বলছেন, ‘সত্য মম ফলেছে স্বপন।’ অর্থাৎ ঘনিষ্ঠ পার্ষদদের সঙ্গে অবতারের পূর্ব থেকে পরিচয় থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে এর প্রকৃষ্ট পরিচয় আমরা বহুবার দেখেছি। ঠাকুর বলছেন, কাকেও দেখলে হঠাৎ লাফিয়ে উঠি কেন জান? অন্তরঙ্গদের অনেকদিন পরে দেখলে যেমন লোকে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সেইরকম হয়। তিনিও প্রতীক্ষা করেছেন তাঁর লীলার সহচরদের জন্য। স্বামীজীকে প্রথম দেখেই চিনতে পেরে কত স্তবস্তুতি। এখানেও নিত্যানন্দের সঙ্গে নিমাই-এর মিলন হল। থিয়েটার চলছে। শ্রীবাস ষড়ভুজ দর্শন করলেন। ঠাকুরও ভাবাবিষ্ট হয়ে ষড়ভুজ দর্শন করছেন। গৌরাঙ্গের ভাব বুঝে নিতাই গাইলেন, ‘কই কৃষ্ণ এল কুঞ্জে প্রাণসই!’ শ্রীরাধিকার ভাব নিয়ে গৌরাঙ্গ দেহ ধারণ করেছেন। তাঁকে ‘রাধাভাবদ্যুতিসবলিততনু কৃষ্ণস্বরূপম্‌’ বলা হয়েছে। চৈতন্যাবতারের কারণ ব্যাখ্যা করে চৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে—শ্রীরাধার প্রেমের মহিমা কিরূপ, আমার যে মাধুর্য রাধাকে মুগ্ধ করে সেই মাধুর্য কিরূপ আর সেই মাধুর্য আস্বাদন করে শ্রীরাধা যে আনন্দ লাভ করেন সেই আনন্দই বা কিরূপ—এই তিন বাঞ্ছা পূর্ণ করবার জন্য স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার ভাবকান্তি অঙ্গীকার করে নবদ্বীপধামে অবতীর্ণ হলেন। এসব ভাবের কথা। আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের একটি কথা মনে করি। তিনি বলেছেন, দেখ, এর ভিতর (নিজেকে দেখিয়ে) দুটো আছে। একটি ভগবান আর একটি ভক্ত। অবতার চরিত্র সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না। একবার বলছেন, (নিজের দেহ দেখিয়ে), একে চিন্তা করবে। আবার কখনও কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছেন মা, এখনও দেখা পেলাম না বলে। এই দুই ভাবের একত্র সমাবেশ এখানেও হয়েছে।
স্বামী ভূতেশানন্দের ‘শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-প্রসঙ্গ’ (৪র্থ খণ্ড) থেকে