রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে আসিবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। আমি তাঁহাকে কখনও দেখি নেই, তাঁহার বাণী কখনও শুনি নাই। তাঁহার সম্বন্ধে অপরের মুখে সামান্য কিছু শুনিয়াছি, এবং তাঁহার সম্বন্ধে অন্যের লেখা কিছু পড়িয়াছি। সুতরাং তাঁহার সম্বন্ধে নুতন কথা কিছু বলিবার সামর্থ্য আমার নাই। আমি কেবল তাঁহার অসাধারণ আধ্যাত্মিক প্রতিভা, তাঁহার অসাধারণ সাধনা ও তাঁহার অসাধারণ সিদ্ধির প্রশংসা করিতে পারি। কিন্তু যাঁহার গুণ-কীর্তন দেশবিদেশের বহু মনীষী করিয়াছেন, করিতেছেন, করিবেন, আমি তাঁহার প্রশংসা করি বা না করি, তাহাতে কিছুই ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। আমার যতদূর মনে পড়ে, তাঁহার বিষয় আমি প্রথম কিছু শুনিয়াছিলাম আমার ভক্তি ভাজন শিক্ষক স্বর্গীয় কেদারনাথ কুলভী মহাশয়ের মুখে। আমি তখন বালক, বাঁকুড়া জেলা স্কুলে পড়ি। কুলভী মহাশয় ব্রাহ্ম ছিলেন, পেন্সান লইবার পর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হইয়াছিলেন। তাঁহার কাছেই প্রথম পরমহংসদেবের ধূলা ও টাকার সমত্ববোধ-উৎপাদক সাধনার কথা শুনি। তাঁহার সম্বন্ধে আর একটি কথা কুলভী মহাশয়ের কাছে শুনিয়াছিলাম বলিয়া মনে হইতেছে। কিন্তু যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহা কোথাও লিখিয়া রাখি নাই। অর্দ্ধ শতাব্দীরও অধিককাল পূর্বে শোনা কথার অস্পষ্ট স্মৃতি হইতে বিশেষ কিছু বলা চলে না। কেবল আখ্যানটির উল্লেখ করা চলে। কুলভী মহাশয়ের কাছে একদিন শুনিয়াছিলাম মনে হইতেছে যে, একদা একজন অবৈধ ইন্দ্রিয়-সুখ ভোগাসক্ত ব্যক্তি পরমহংসদেবের নিকট উপদেশ লইতে যায়। তিনি তাহাকে তিরস্কার করেন নাই, নিবৃত্তিমূলক কথাও কিছু বলেন নাই। কেবল বলেন, তুমি যখন সুখভোগ করিবে, তখন সর্বদাই মনে রাখিবে, ভগবানই তোমাকে সেই শক্তি দিয়াছেন, যাহা তুমি সুখভোগের জন্য ব্যবহার করিতেছ। ইহা শুনিয়া সেই ব্যক্তির হৃদয়ের পরিবর্তন হয়, এবং সে পাপপথ পরিত্যাগ করে। অতি অস্পষ্ট স্মৃতি হইতে আমি এই কথাগুলি লিখিলাম। বাস্তবিকই আমি এইরূপ কিছু শুনিয়াছিলাম কিনা, নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না। পরমহংসদেবের উপদেশাবলীর যে সকল সংগ্রহ পুস্তক আছে, তাহার কোনটিতে এরূপ কোন আখ্যান ও উপদেশ থাকিলে আমার স্মৃতিভ্রম হয় নাই নিশ্চিন্ত মনে করিতে পারি। নতুবা আমার স্মৃতির অভ্রান্ততা সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিবে। স্বর্গীয় পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মডার্ণ রিভিয়ুর জন্য পরমহংসদেবের সম্বন্ধে ইংরেজীতে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ঐ বৎসর তাহা উহার নবেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ইহা তাঁহার প্রত্যক্ষ জ্ঞান হইতে লিখিত। পরমহংসদেব সম্বন্ধে আমার ধারণা প্রধানতঃ এই প্রবন্ধটি হইতে জন্মিয়াছে। শাস্ত্রী মহাশয় ইহাতে যাহা লিখিয়াছিলেন, তাহার কোন কোন অংশের মৎকৃত অনুবাদ দিতেছি। রামকৃষ্ণের সাধনা ও সিদ্ধি সম্বন্ধে শান্ত্রী মহাশয় বলেন:—
“পরমহংস রামকৃষ্ণ তাঁহার সাধনা সম্বন্ধে আমাকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার অনেক কথা আমার মনে আছে।…দৃষ্টান্ত স্বরূপ, এক হাতে কিছু ধূলা ও অন্য হাতে কয়েকটি মুদ্রা লইয়া তিনি নদীর ধারে বসিয়া ধ্যানস্থ হইতেন, এবং উভয়েরই সমান অকিঞ্চিৎকারতা উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করিতেন। তাহার পর তিনি পুনঃ পুনঃ বলিতেন “টাকা ধূলা, ধূলা টাকা, ধূলা টাকা,’ এবং এই সত্যের সম্পূর্ণ উপলব্ধি হইবার পর ধূলা ও টাকা দুই-ই নদীতে ফেলিয়া দিতেন।
‘ব্রাহ্ম ও খ্রীষ্টান অনুগামীদের চোখে শ্রীরামকৃষ্ণ’ থেকে