পদার্থ ও রসায়নিক বিদ্যার অনুশীলনে বিশেষ উন্নতি।প্রায় সম্পূর্ণ কাজে বাধা আসতে পারে। বিকেল থেকে মানসিক ... বিশদ
তেমনই একটি দ্বীপের নাম শিকোকু। এই দ্বীপের ল্যা উপত্যকার ছোট্ট একটি গ্রাম নাগোরো। কিন্তু গোটা পৃথিবীর এই গ্রাম নিয়ে এত আগ্রহ কেন? উত্তর হল পুতুল! অবাক লাগলেও এই গ্রামের বাসিন্দাদের সিংহভাগই পুতুল। বস্তুত এই প্রাণহীন পুতুলরাই এই জাপানি গ্রামের প্রাণ। পুতুলে ছয়লাপ গ্রাম নাগোরো তাই পরিচিত ‘ভ্যালি অব ডলস’ বা পুতুল উপত্যকা নামে।
এককালে নাগোরো গ্রামের ৩০০টির বেশি পরিবার বসবাস ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা কুড়ির আশপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কেন গ্রামবাসীরা এলাকা ছাড়ছেন? পাঁচের দশকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে নাগোরো গ্রাম তীব্র জলসঙ্কটের মুখে পড়ে। বাধ্য হয়ে বেশিরভাগ মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যান। কয়েকটি পরিবার এখন বসবাস করলেও পানীয় জল, দোকানপাট, হাসপাতাল, রেল স্টেশনের মতো সাধারণ পরিষেবার জন্যও তাঁদের শহরে যেতে হয়। এভাবেই জনসংখ্যা কমতে কমতে আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে নাগোরা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই গ্রামে শেষ বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। আর গ্রামটিতে শেষবার কোনও শিশুর জন্ম হয়েছিল
২০০১ সালে।
কিন্তু প্রশ্নটা হল, এই গ্রামে এত পুতুল এল কীভাবে? সৌজন্যে সুকিমি আইয়ানো। একদা নাগোরো গ্রামের বাসিন্দা সুকিমি আইয়ানো উচ্চশিক্ষা ও পারিবারিক সূত্রে ওসাকায় বাস করতে শুরু করেন। ২০০২ সালে নিজের অসুস্থ বাবার পরিচর্যার জন্য তাঁকে গ্রামে ফিরতে হয়। কিন্তু তাঁর ছোটবেলায় ফেলে যাওয়া গ্রাম আর এখনকার গ্রামের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। তাঁর চেনা গ্রাম কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। বাবাকে সেবা করার পাশাপাশি পারিবারিক জমিতে সামান্য চাষবাস করতে থাকেন সুকিমি। অন্যদিকে, প্রায় জনশূন্য গ্রামটি পাখিদের আনাগোনার বিরাম ছিল না। আর পাখির অত্যাচারে কোনও গাছই বেশিদিন বাঁচত না। তিতিবিরক্ত সুকিমি একদিন একটি কাকতাড়ুয়া তৈরি করে জমির মাঝে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এভাবেই সূত্রপাত হয়েছিল আজকের পুতুল গ্রামের।
গ্রামের একাকিত্ব কাটাতে গ্রামেরই মৃত মানুষদের আদলে একের পর এক পুতুলগুলি বানাতে থাকলেন তিনি। প্রথম পুতুলটা তৈরি করেছিলেন নিজের ছোটবেলার খেলার সঙ্গীর অনুকরণে। তারপর যেখানে গ্রামের শেষ বিয়েটি হয়েছিল সেই পুতুল বর-বউ। ঠিক যেন পুতুলের বিয়ে। তারপর গ্রামের খালি দোকানগুলোতে বসিয়ে দেওয়া হল পুতুলদের। যেন তারা ক্রেতার অন্তহীন অপেক্ষায়। এভাবেই ধীরে ধীরে পুতুলে ভরে যেতে লাগল গ্রামটি। গ্রামের পরিত্যক্ত বিদ্যালয় ভরে গেল সুকিমির তৈরি পুতুল শিক্ষক, শিক্ষার্থীতে। সেগুলি তৈরি হয়েছিল সুকিমির পরিচিত সহপাঠী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার আদলে। যেন আদর্শ শান্ত বিদ্যালয়। এমনকী সুকিমির বাড়ির বারান্দাতে আছে তাঁর মায়ের আদলে তৈরি একটি পুতুল।
সুকিমির এই বিচিত্র শখ গ্রামবাসীদের কাছে একপ্রকার নিরীহ মনোরঞ্জন। ক্রমে পুতুল গ্রামের দৌলতে সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে কৌতূহলীদের কাছে বিশ্বব্যাপী পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন সুকিমি। কোলাহলের পৃথিবীতে এই নীরব গ্রাম যেন এক অন্য গ্রহ, যেখানে নিস্তব্ধতাই এর প্রাণশক্তি। ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবরে গ্রামের পুতুলদের নিয়ে আয়োজিত হওয়া বিশেষ প্রদর্শনী। যা দেখতে ভিড় জমান বহু পর্যটক। যেখানে খুব কাছ থেকে অনুভব করা যায় এই রোমাঞ্চকর ‘না-মানুষ’দের। ২০১৪ সালে জার্মান পরিচালক ফ্রিটজ স্কুম্যান এই গ্রামের উপর ‘ভ্যালি অব ডলস’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। এই তথ্যচিত্র গ্রামটিকে আরও পরিচিতি দেয়। পর্যটকরা ভিড় জমাতে থাকেন পুতুলদের জগতে। যেখানে মনে হয় সবটাই জীবন্ত। গ্রামের নিস্তব্ধতা আর যত্রতত্র পুতুলদের উপস্থিতি মিলে নাগোরো যেন এক অপার্থিব দুনিয়া।
পুতুল গ্রামের কয়েকটি বিশেষ দর্শনীয় স্থান হল— পুতুলদের বিদ্যালয়: পরিত্যক্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের আদলে বেশকিছু পুতুল রয়েছে। যেখানে আছে এক সামগ্রিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ।
কমিউনিটি সেন্টার: যেখানে পালিত হয় পুতুলদের জন্মদিন, বিয়ের মতো নানা সামাজিক অনুষ্ঠান। পুতুল বলে কি তাঁদের শখ আহ্লাদ নেই!
তাছাড়া গ্রামের বিভিন্ন জায়গা যেমন খেত-খামার, মাঠ-ঘাট, পাড়ায়, বাড়ির উঠোনে নানারকম পুতুল দেখতে পাওয়া যায়।
এই পুতুলগুলি তৈরি হয় তুলো, কাঠ, রোল পেপার, কাপড় বিবিধ উপকরণ দিয়ে। পাশাপাশি প্রতিবছর এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের প্রতি বুধবার সুকিমি আগ্রহী পর্যটকদের পুতুল বানানো শিখিয়ে থাকেন।
স্বাভাবিকভাবেই এরকম পরিবেশ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে বিস্তর অলৌকিক কিংবদন্তি। অনেকে মনে করেন, মৃতদের চেহারার আদলে পুতুল বানানোর ফলে তাঁদের মধ্যে বাস করে অশরীরীরা। এমনকী, ভূতের ভয়ে এই গ্রামের ভিতর দিয়ে খুব কমই বাস চলাচল করে। সন্ধ্যার পর আরও কমে আসে লোকচলাচল। হাওয়ায় ভাসে, রাতে পুতুলগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠার মতো নানান লোকশ্রুতি। তাছাড়া বিদেশি পর্যটকদের হঠাৎ জ্ঞান হারানো, একা একা পুতুলদের অবস্থান বদলের মতো নানা ঘটনা শোনা যায়। তবে এসব সত্য-মিথ্যার তর্কবিতর্ক সরিয়ে রেখে পুতুল গ্রামের জনপ্রিয়তা নিয়ে সবাই একমত।
নিজের একাকিত্ব কাটানো হোক বা নিছক শখের খেয়ালে সুকিমির একা হাতে পুতুল তৈরির কাজ যে আজ এক অন্যধারার নিঃশব্দ বিপ্লবের নামান্তর, তা অনস্বীকার্য।