দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
দেশবাসী এখন রাজনীতির চরিত্রহীনতা দেখে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত এবং সশঙ্কিত। তারা হয়তো এই ঐতিহাসিক সংবাদে উৎসাহিত হবার সুযোগ পাবে। আপাত-বিস্মৃত এই ঘটনার তথ্যাদি জেনে নতুন প্রজন্ম যদি উৎসুক হয়, তবে দেশের পক্ষে আশ্বাসের একটি নতুন মোড় নেওয়া অসম্ভব হবে না। সরকারের অন্য উদ্দেশ্য যদি থাকেও, প্রকারান্তরে সেটি আমাদের উপকারই করতে পারে।
পিঠোপিঠি আর একটি ঘটনা ঘটল। জাপান যখন ১৯৪৩ সালে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করে, তখন সেখানে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন। দ্বীপপুঞ্জটি ফৌজের হাতেই আসে, সুভাষচন্দ্র দ্বীপপুঞ্জটির কমিশনার করেন কর্নেল লোগানাধনকে। দ্বীপপুঞ্জটি প্রথম ভারতীয় মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হল।
সুভাষচন্দ্র এখানে দুটি দ্বীপের নামকরণ করেন—‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’। এই নামকরণ কোনও ভারতীয় সরকার এতদিন গ্রহণ করেনি। ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় পতাকা উড়েছিল। তারই সম্মানে গত ৩০ ডিসেম্বর দুটি দ্বীপের ‘শহিদ’ এবং ‘স্বরাজ’ নামকরণের ফলে বহুদিনের একটি প্রত্যাশিত প্রস্তাব গৃহীত হল। ওইসঙ্গে রস আইল্যান্ড নেতাজির নামাঙ্কিত হল। দেরিতে হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়কে স্মরণ করা হল। পূর্ববর্তী সরকারের অবহেলা ও অবজ্ঞা আর একবার পরিস্ফুট হল।
স্মরণ করা যাক, ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হয়। আগের দিন সুভাষচন্দ্র রাতভর ওই সরকারের ঘোষণাপত্রটি তৈরি করেন। সেদিনের সেই আবেগ, আশা, আলোড়নের অতুলনীয় আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছিল নিশ্চয়। এই প্রসঙ্গে ভারত-বিভাজনের পটভূমিকার শেষতম পর্যায়টি দেখে নেব।
১৯৩৭ সালে কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনের পরে কংগ্রেস (পড়ুন, নেহরু) মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট সরকার গড়তে চাইল না। ফলে, লিগ ক্রুদ্ধ হল এবং এতদিন না চাইলেও, এবারে লিগ বিভাজন চাইল। যাঁকে এখন ‘একতার প্রতিমূর্তি’ বলা হচ্ছে, সেই সর্দার প্যাটেল বললেন, লিগ যদি চাপ দেয় আলাদা হয়ে যাবার জন্য, তাহলে তাদের জোর করে এক হয়ে থাকার জন্য চেষ্টা করতে হবে না।
ব্রিটিশ অতিশয় ধূর্ত। স্বার্থের জন্য সে যে-কোনও দেশকে ভেঙে নিজেদের সুবিধে অর্জন করে নিতে পারে। এই উদ্দেশ্যেই ইংরেজ সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলেছিল। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন রণজিৎ সিং ভাসিন। তিনি বলেছেন, ১৯৪৭-এর দাঙ্গা ইংরেজরা চাপিয়ে দিয়েছিল, নয়তো দাঙ্গা-বিধ্বস্ত গ্রামগুলোয় সেনা পৌঁছতে দেরি হল কেন, যখন রাওয়ালপিন্ডির সেনানিবাস থেকে এক ঘণ্টায় পৌঁছনো যেত? ইশতিয়াক আমেদ লিখেছেন মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসার আগেই কৃষ্ণ মেনন দেশ বিভাজনের পরিকল্পনার ছক তৈরি করছিলেন কীভাবে? লর্ড ওয়াভেলের বিবৃতি থেকে জানা যায়, চার্চিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ প্রয়োগ করে ভারতে আরও কিছুকাল থেকে যেতে চেয়েছিলেন, যাতে যুদ্ধের বিপর্যয় থেকে পুনর্গঠন করার সময় মেলে। এটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, কারণ যুদ্ধের পরে ওই ক্ষুদ্র দ্বীপটিরই খাদ্য সমস্যা বাড়ছিল। ভারতে থাকতে পারলে অন্তত খাদ্য সংকট মোকাবিলা সহজ হবে। দেশ বিভাজনের হয়তো এইটাই মূল কারণ। এই জন্যই সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি ও দাঙ্গা ঘটানো। ভারতীয় নেতাদের ক্ষমতার লোভ তাতে সহায়ক হয়েছিল।
১৬ অক্টোবর, ১৯৪৯ নেহরু নিউ ইয়র্কের একটি সভায় বলেন, বিভাজনের ফলে এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি হবে যদি বুঝতে পারতাম, তাহলে কংগ্রেস দেশভাগে মত দিত না। তিনি একটা কথা চেপে গিয়েছিলেন, মাউন্টব্যাটেনের বিভাজন প্রস্তাব আলোচনার সময়ে গান্ধীজি একেবারেই মুখ খোলেননি। গান্ধীজির সুভাষ-বিরোধী মনোভাবের সুযোগ নিয়েছিল ইংরেজ। কংগ্রেস খুব তাড়াতাড়ি সব সেরে ফেলতে চাইছিল। তারা ভয় পাচ্ছিল যে, সুভাষচন্দ্র ফিরে এলেই ভারত বিভাজন ঠেকাবেন।
তাহলে বিয়াল্লিশের আগস্ট বিদ্রোহ নিয়ে যে এত ঢাক পেটানো হয়ে থাকে, তার কী হল? ‘ভারত ছাড়ো’ এই তোপ দেগে গান্ধীজি বললেন, ‘‘আমি স্বাধীনতা চাই এবং এক্ষুনি, ভোর হবার আগেই।’’ কিন্তু ভোরের আগে স্বাধীনতার পরিবর্তে এল পুলিসের গাড়ি। সমস্ত নেতা গ্রেপ্তার হলেন। গান্ধীজির জন্য প্রাসাদোপম গৃহে ‘বন্দিদশা’র আয়োজন হল।
১৯৪৪-এ মুক্তি পাবার পরে গান্ধীজি ঘোষণা করলেন, বিয়াল্লিশের আন্দোলন শুরুই করা যায়নি এবং এখন আর সেটা আরম্ভ করতেও তিনি পারবেন না। আমরা কিন্তু জানি দেশজুড়ে সেইসময় ব্রিটিশ-বিরোধী বহু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছিল। সেসবে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কে?
ওই সময়ে সুভাষচন্দ্র ভারতবর্ষ থেকে অন্তর্ধান করে বার্লিনে ভারতীয় সংগঠন গড়ে তুলছেন। তিনি ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে পুরোপুরি সমর্থন করলেন এবং বার্লিন থেকে বেতার ভাষণ দিয়ে তিনি ভারতের জনসাধারণকে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। বললেন, ভারতীয় জনতার লক্ষ্য হবে একটাই—‘এখনই, কিংবা কখনও নয়’ কিংবা ‘জয় অথবা মৃত্যু’। (ভারত ছাড়ো আন্দোলন, বেতার ভাষণ, ১৭ অগস্ট ১৯৪২)। বললেন তিনি—‘আমি সুভাষ বলছি’, বার্লিন থেকে আজাদ হিন্দ রেডিয়োতে। ‘‘১৯২১-৪০ পর্যন্ত প্রচার করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে এবং বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিচার করে, আমি আপনাদের কিছু পরামর্শ দিতে চাই। আমার বিশ্বাস, এইসব পরামর্শ আপনাদের সংগ্রামকে সার্থক করে তুলবে।’’
সুভাষচন্দ্র এক এক করে পনেরোটি নির্দেশনামা দিয়েছিলেন। প্রত্যেকটির মূল কথা ছিল, ভারতে ইংরেজ প্রশাসনকে দুর্বল করে দেওয়া, ইংরেজ আধিকারিকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া। যেমন (১) সংগ্রামকে ক্রমশ ছড়িয়ে দেওয়া; (২) কোনও পরিকল্পনাতেই সাধারণ মানুষদের যতটা সম্ভব কোনও ক্ষতি না হতে দেওয়া; (৩) প্রচার এবং কর্মধারা সবটা অস্ত্র-ছাড়া গেরিলা যুদ্ধে পরিবর্তিত করা; (৪) ভারতে ইংরেজের যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের কাজ ধ্বংস করা; (৫) বিবিসি-র প্রচার ভাষণগুলো নিয়মিত শোনা, সেগুলো ভারতীয় অবস্থার মধ্যে প্রয়োগ করা; (৬) ইংরেজদের পুরোপুরি বয়কট করা; (৭) সারা দেশে ভাইসরয় থেকে শুরু করে নীচের সারি পর্যন্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বাড়ি পর্যন্ত মিছিল করে গিয়ে তাদের পদত্যাগ দাবি করা; (৮) সকল প্রশাসনিক বিভাগগুলি দখল করে নেওয়া; (৯) সকল আইন অমান্য করা এবং (১০) যে ভারতীয় আধিকারিকরা ইংরেজের সমর্থক, তাদের সামাজিক বয়কট করা; (১১) কর দেওয়া বন্ধ করা; (১২) সব কাজেই দেখে নিতে হবে জনতা যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; (১৩) যেসব রাস্তায় পুলিস মিলিটারির আক্রমণ হতে পারে, সেগুলো অবরোধ করা; (১৪) যে আধিকারিকরা জনতার ওপরে অত্যাচার করতে উৎসাহী, তাদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা; (১৫) কারখানায়, বিশেষ করে যেখানে যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হয়, সেখানে ধর্মঘট করা; (১৬) ইংরেজকে বিব্রত করার জন্য ছাত্রদের দ্বারা নিত্যনতুন অন্তর্ঘাত করার সংগঠন গড়ে তোলা; (১৭) সরকারি অফিসে কেরানিদের অপটুভাবে কাজ করা; (১৮) ব্যবসায়ীদের ইংরেজ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ না-করা; (১৯) ইংরেজদের বাড়িতে কর্মরত ভৃত্যদের ছুতোনাতায় ধর্মঘট করা; (২০) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্ট্যাম্প, পতাকা, স্মারক ইত্যাদি নষ্ট করে দেওয়া; (২১) টেলিফোন, টেলিগ্রাফ পরিবহণের (ট্রাম, বাস) কাজে বাধা দেওয়া; বিশেষত যখন সেনাদল বা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে যাওয়া হবে—ইত্যাদি।
এসবে ইংরেজ বিব্রত হলেও ব্যতিব্যস্ত হয়নি। আইনশৃঙ্খলার বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এগুলোকে চালানো হচ্ছিল। তারপরে মূল লড়াইটা শুরু করলেন সুভাষ। তাঁর হাতে তখন অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক, লড়াকু সেনাদল। অবশ্য তাদের অসম যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। কুছ পরোয়া নেই, তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। সুভাষচন্দ্র চাইছিলেন এই ফৌজ যখন ভারতের মাটি স্পর্শ করবে, তখন ভারতের অভ্যন্তরে পরিপূরক সংগ্রাম শুরু করতে হবে। বারবার সেই ঘোষণা বেতারে করা হচ্ছিল। কিন্তু সম্ভবত সেই আহ্বান সুষ্ঠুভাবে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। ইংরেজ সুভাষচন্দ্রের বেতার ভাষণের সময়ে ঠিক ওইসব কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক বাধা সৃষ্টি করত। কংগ্রেস নেতারা অবশ্য যুদ্ধের অবস্থা জানতেন, কিন্তু খবরটা পুরোপুরি চেপে রেখেছিলেন, কারণ সুভাষকে তাঁরা উঠতে দেবেন না।
সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হল তাঁদের, যখন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাধ্যক্ষ ও সেনানীদের রাজদ্রোহের অপরাধে বিচার শুরু হল। এইখানেই তাঁদের চালে ভুল হয়ে গেল। ওই বিচারের সময়েই সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের দুর্ধর্ষ সাহসিকতা ও বীরত্ব সম্পর্কে সমগ্র দেশ সব অনুপুঙ্খ জানতে পারল। সুভাষের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল, ফৌজের প্রতি সকলে আবেগে অনুরক্ত, শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ। জনবিস্ফোরণ ঘটল, ইংরেজরা বুঝতে পারল এই আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না। যে নেতারা এতকাল সুভাষচন্দ্রের নিন্দা করে আসছিলেন তাঁরা এই বিচারের সময়ে ‘ডিফেন্স’ করতে নামলেন। জহরলালও ওকালতির গাউন চড়িয়ে আদালতে এলেন। তবে সব চিৎকার চেঁচামেচি যখন ফুরিয়ে গেল তখন জহরলাল, প্যাটেল স্বমূর্তি ধারণ করলেন। জহরলাল তো এত কাণ্ডের পরেও সুভাষচন্দ্রকে ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’ বলতে দ্বিধা করলেন না।
ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে সিপিআই মরিয়া হয়ে সুভাষচন্দ্রকে জাপানি প্রধানমন্ত্রী ‘তোজোর কুকুর’ বলে কার্টুন এঁকে ফেলেছিল। আসলে সিপিআই চিরকালই বিদেশি মুরুব্বিদের মুখাপেক্ষী পার্টি। তার এরকম আচরণ মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গান্ধীজি অবশ্য শেষকালে সুভাষচন্দ্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং সুভাষকে ‘Patriot of Patriots’ বলতে পেরেছিলেন।
আজাদ হিন্দ সরকারকে জার্মানি, রাশিয়া, ইতালি এবং পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। ওই হট্টগোলেও জাতীয় সঙ্গীত পর্যন্ত স্থির করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। ‘জনগণমন’-এর হিন্দুস্থানি অনুবাদ ‘শুভ সুখ চয়ন’ গানটি আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছিল। মজার কথা এই, পরবর্তীতে কংগ্রেস সরকার সংবিধান তৈরি করার সময় নেহরুও ‘জনগণমন’কে বেছে নিয়েছিলেন।
আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বছর পূর্তিতে কেন্দ্রের মোদি সরকার একটি নিয়মরক্ষার অনুষ্ঠান করেছে আসন্ন ভোটের দিকে তাকিয়ে। কোনও রাজ্য অবশ্য কিছুই করেনি। এমনকী পশ্চিমবঙ্গও এই বিষয়ে কোনও অনুপ্রেরণা পায়নি।
একদিকে দেশের নেতাদের একাংশের বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে ইংরেজ সরকারের ছলনা—সব মিলিয়ে উপমহাদেশের ভাগ্য ট্র্যাজিক হয়েই রইল। তথাপি ব্রিটিশ কর্তা এটলিকে স্বীকার করতে হয়েছে, সুভাষচন্দ্রের জন্যই দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে তাঁদের। কংগ্রেসের (পড়ুন, গান্ধীজি) ভূমিকা ছিল ‘ন্যূনতম’। ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না।
সুভাষচন্দ্রই ওই ফৌজি সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তাহলে তাঁকে কি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলা চলে না?