বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
গল্পের পাতা

সেকালের ডুয়েল

অমিতাভ পুরকায়স্থ: ১৭৮০ সালের ১৭ আগস্ট। কলকাতার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। আলিপুরের এক নির্জন অংশে দু’জন বিদেশি একে অপরের দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে। তারপর ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে গুলির শব্দ— গুড়ুম! অনেকেই নিশ্চিত বলে দেবেন যে, হেস্টিংস বনাম ফ্রান্সিসের বিখ্যাত ডুয়েলের কথা হচ্ছে।  
ঔপনিবেশিক আমলের শ্বেতাঙ্গ সমাজে ডুয়েল জনপ্রিয় ছিল। তবে, তার আগে থেকেই প্রাচীন ভারত সহ অন্যান্য জায়গাতেও এই ধরনের দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রচলন ছিল। তবে সাহেবদের ডুয়েল শেখায় রেনেসাঁর ইতালি। ষোড়শ শতকে সেখানে ‘কোড অব অনার’ বা সম্মান রক্ষার নিয়ম নিয়ে এক মানদণ্ড গড়ে ওঠে। যা চালু ছিল উনিশ শতক পর্যন্ত। ইতালিয়ান ভাষায় একে বলা হতো ‘code duello’। তার থেকেই ইংরেজিতে আসে ‘ডুয়েল’ শব্দটি। 
ইতালিয়ানদের প্রচুর লেখালেখি পড়েও ‘সম্মান’-কথাটির অর্থ ও ব্যাপ্তি ঠিক নিশ্চিত করা গেল না। সামাজিক পরিসরে সম্ভ্রম আর ব্যক্তিগত স্তরে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও বিষয়টি ঘিরে ধোঁয়াশা রয়েই গেল। কোন অপমানে শুধু ক্ষমা প্রার্থনা করলেই হবে আর কোন ক্ষেত্রে একমাত্র রক্তক্ষয়ী ডুয়েলের মাধ্যমেই সম্মান পুনরুদ্ধার হবে, তার শ্রেণি বিভাগের চেষ্টা হলেও দেখা গেল যে, কোনও ধরনের মানহানির আভাস পেলেই অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে পড়তে পছন্দ করছেন ভদ্রলোকরা। ‘ভদ্রলোক’ বা ‘জেন্টেলম্যান’ কথাটার এখানে বিশেষ গুরুত্ব আছে। কারণ ভদ্র সমাজের রীতি ছিল ডুয়েলে। 
হেস্টিংস ও ফ্রান্সিসের বিবাদে যে গভীর রাজনীতি ও আহত আত্মসম্মান জড়িত ছিল, তার তুলনায় অতি সামান্য ঘটনাতেও ডুয়েল লড়া হয়েছে।  কোম্পানির সেনাবাহিনীতে জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব সামলানো স্যার জন হিয়ারসে নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, উনিশ শতকের প্রথম দশকে বারাসাতের সামরিক কলেজে প্রশিক্ষণ নিতে ঢুকেই কম বয়সি শিক্ষানবিশরা নিজেদের জেন্টেলম্যান ভাবতে শুরু করত। গুরুতর বিবাদ ছাড়াও সামান্য বচসাতেও ডুয়েল লড়া হতো। সন্ধ্যায় পড়ার সময় ইয়ার্কি মেরে সহপাঠীদের  বিরক্ত করার মতো ঘটনাও ডুয়েল লড়ার আহ্বানে শেষ হতো। ডুয়েলে গুরুতর আঘাত পাওয়ার পাশাপাশি এক ক্যাডেটের মৃত্যুর কথাও জানিয়েছেন হিয়ারসে। 
অস্ত্র হিসাবে তরোয়াল দিয়ে শুরু হলেও একসময় পিস্তল হয়ে উঠল ডুয়েলের একমাত্র অস্ত্র। ডুয়েলের জন্য বিশেষ ধরনের বন্দুক সেট বিক্রি হতো বাজারে। ডুয়েলের জন্য বিশেষভাবে তৈরি গুলি ও পিস্তল ছাড়াও নানা আনুষঙ্গিক জিনিস থাকত সেই সেটে। 
অস্ত্রচালনায় নিপুণ সামরিক কর্মীরা ছিলেন ডুয়েলের প্রবল সমর্থক। কিন্তু  অসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই প্রথাটি। কলকাতার দুইটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক জে এইচ স্টকোয়েলার (দ্য ইংলিশম্যান) ও জে সিল্ক বাকিংহ্যাম (ক্যালকাটা জার্নাল) বেশ কিছু ডুয়েলে অংশ নিয়েছিলেন।  ১৮৩৭ সালে  স্টকোয়েলার নিজের কাগজে ক্যাপ্টেন সিওয়েলের তত্ত্বাবধানে থাকা সরকারি মেসে খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ করেন। পত্রিকা সম্পাদককে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলেন ক্যাপ্টেন। স্টকোয়েলার রাজি না হওয়ায় ক্যাপ্টেন তাকে ডুয়েলে আহ্বান করেন।  ক্যাপ্টেনের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে স্টকোয়েলার হাওয়ায় গুলি করে লড়াইয়ের ইতি টানেন। তবে দ্বিতীয় পক্ষ এই ভাবে আঘাত না করার সিদ্ধান্ত নিলে, গুলি ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হওয়া প্রথম পক্ষের জন্য যথেষ্ট  মনোকষ্টের কারণ হতো। 
ডুয়েলে নিহত হওয়ার খবর সংবাদপত্রের পাতায় মাঝে মাঝেই দেখা যেত। যেমন ১৭৮৪ সালের ২৯ জুলাইয়ের ক্যালকাটা গেজেট জানাচ্ছে যে, আগের দিন দুপুরে ডুয়েলে আহত হওয়া লেফটেন্যান্ট হোয়াইট পরের দিন মারা গিয়েছেন। এক প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু হলে অন্যজনের উপর খুনের মোকদ্দমা রুজু হওয়ারও বেশ কিছু উদাহরণ আছে ইতিহাসের পাতায়। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে শাস্তি হলেও সামান্য জরিমানার উপর দিয়েই খালাস পেতেন আসামি। সেটুকু ঝুঁকিও এড়াতে অনেকে ফরাসি উপনিবেশে গিয়ে ডুয়েল লড়তেন। ঘটনাস্থল ব্রিটিশ শাসনাধীন এলাকার বাইরে হলে মামলার ঝামেলাও থাকত না।
ওয়ারেন হেস্টিংস ও ফিলিপ ফ্রান্সিসের বহু আলোচিত ডুয়েলের প্রায় সমসাময়িক কলকাতার আরও একটি ডুয়েল নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। এদেশে কোম্পানির পরিচালন ব্যবস্থাই ছিল এক রণক্ষেত্র। একদিকে হেস্টিংস ও বারওয়েল আর অন্যদিকে ফিলিপ ফ্রান্সিস, জেনারেল মনসন ও জেনারেল ক্লেভারিং। এমন তিক্ততা থেকেই হেস্টিংস ও ফ্রান্সিসের ডুয়েলের মতো বারওয়েল ও ক্ল্যাভারিংয়ের সংঘাতেরও জন্ম।  
ঘটনার সূত্রপাত লবণ-মহল বণ্টনের দুর্নীতি থেকে। বারওয়েল সাহেব কয়েকটি সরকারি লবণ মহল দু’জন আর্মেনীয়কে লিজ দেন এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকার ঘুষের বিনিময়ে। তার পরেও একজন আর্মেনীয়কে তাড়িয়ে সেই জায়গায় আরও টাকা নিয়ে অন্য একজনকে বসান। সেই কেলেঙ্কারি কাউন্সিলের সামনে আসতেই বারওয়েলকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন ক্লেভারিং। তর্কাতর্কির সময় বারওয়েলের ব্যক্তি আক্রমণে জেনারেল ক্লেভারিংয়ের সম্মানে আঘাত লাগে। ফল দুই পক্ষের ডুয়েল। ক্লেভারিং প্রথম গুলি ছুড়ে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হন। আর বারওয়েল হাওয়ায় গুলি ছুড়ে লড়াইয়ের ইতি টানেন।। তবে এই ডুয়েলের উৎস হিসাবে অন্য একটি কারণের কথাও উঠে এসেছে নানা সূত্রে। সন্দেহজনক চরিত্রের মানুষ রিচার্ড বারওয়েল হঠাৎ ক্লেভারিংয়ের এক কন্যার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করায়, জেনারেল প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলেন। আর সেটাই ডুয়েলের কারণ। 
আবার অন্যদিকে বেশ কিছু উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে, বিবাদের সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষ ডুয়েল লড়ার মতো চরম পদক্ষেপ না নিতে চাইলেও আশপাশের লোকজন প্রায় জোর করেই দু’জনের হাতে পিস্তল ধরিয়ে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিত। সামরিক প্রশিক্ষণের বারাকে তাস খেলা নিয়ে দুই তরুণের ঝগড়াকে প্রায় জোর করেই ডুয়েলে বদলে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মিস্টার কিন। কিন্তু সূর্যাস্তের পর আয়োজিত সেই লড়াইয়ে দুই পক্ষই বুদ্ধি খাটিয়ে আলোর উৎসটিতে গুলি করে নিভিয়ে দিয়ে নিজেরা বেঁচে যান। তাই মনে হয় অনেক সময় কুশীলবদের থেকে লড়াই নিয়ে জনগণের বেশি উৎসাহ থাকত। 
সাহেবদের ডুয়েল নিয়ে বাঙালিদেরও উৎসাহ ছিল। খবরও ছাপা হতো বাংলা সংবাদপত্রে। ১৮২২ সালের ১৭ আগস্ট তারিখে সমাচার দর্পণে জনৈক  ডাঃ জেমেসন ও মিঃ বাকিংহামের মধ্যে পিস্তলের লড়াইয়ের খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে, কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু এই রীতি বাঙালিদের মধ্যে তেমন প্রভাবিত ফেলেনি। শ্রীপান্থ মনে করেছেন যে, দু-পাঁচ লাখ টাকার ব্যাপার না হওয়ায় বাবুরা তাতে মাথা ঘামাতেন না। তাই বাবুরা প্রতিযোগিতা করতেন  বিয়ে-শ্রাদ্ধ আর দুর্গোৎসবের খরচ নিয়ে। কথাটার অবশ্যই গুরুত্ব আছে। তবে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ লাগত প্রতিদিনের জীবনেও। যতীন্দ্রমোহন দত্ত তেমনই এক ঘটনার কথা শুনিয়েছেন তার বিখ্যাত যম দত্তের ডায়েরিতে। এক বাবুর নায়েব পাওনা আদায় করতে যাওয়ার সময় বাজারে একটি কুমড়ো পছন্দ করে রেখে গিয়েছিলেন ফেরার সময় নিয়ে যাবেন বলে। কিন্তু তার আগে অন্য এক বাবু এসে সেই কুমড়ো কিনতে চাইলেন। দোকানদার জানাল যে, জিনিসটি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সে কথা শুনে বাবুর রোখ চেপে গেল। তার সেই কুমড়ো চাই-ই। ইতিমধ্যে নায়েব মশাই ফিরে এসেছেন। দু’জনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা বেঁধে গেল। দু’জনেই সেই সামান্য কুমড়োর জন্য রীতিমতো নিলামের মতো দর হাঁকতে শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত নায়েব সেই কুমড়ো কিনলেন নগদ এক হাজার টাকা দিয়ে! গল্প এখানেই শেষ নয়। বাজারের ঘটনা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে নায়েব মশাই সেই কুমড়ো তার বাবুকে উপহার দিলেন। বাবু শুনে সম্মান রক্ষার্থে নায়েবের এমন লড়াইয়ের প্রশংসা তো করলেই তার উপর সেই কুমড়ো দিয়ে ব্রাহ্মণ ভোজনের ব্যবস্থা করলেন। হাজার টাকার কুমড়োর পেছনে আরও হাজার টাকার খরচ! এই হল বাঙালির ডুয়েল! 
3d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কারও কাছ থেকে কোনও দামি উপহার লাভ হতে পারে। অকারণ বিবাদ বিতর্ক এড়িয়ে চলুন। স্বাস্থ্য...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৬.১৮ টাকা৮৭.৯২ টাকা
পাউন্ড১০৬.২৮ টাকা১১০.০২ টাকা
ইউরো৮৮.১৫ টাকা৯১.৫১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা