ঘুরে দাঁড়িয়েছে হিন্দি সিনেমা। করোনাকালে সেই যে চলচ্চিত্র দর্শক মোবাইলে সিনেমা দেখার মধ্যেই নিজেদের অভ্যস্ত করে নিয়েছিল, সেই পরিস্থিতির পর মাস, বছর কেটে গেলেও আর মানুষ সিনেমাহলমুখী হচ্ছিল না। মানুষকে টেনে নিয়ে আসার মতো সিনেমাও উপহার দিতে পারেনি বলিউড। সেই শূন্যস্থান দ্রুত পূর্ণ করেছিল হাই ভোল্টেজ ড্রামা, আন্তর্জাতিক মানের অ্যাকশন, ভি এফ এক্স এবং কখনও ধর্ম এবং সোশ্যাল ইস্যুর নিখুঁত মিশ্রণে একের পর এক দক্ষিণী সিনেমা। ধারণা হয়ে গিয়েছিল মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সম্ভবত সূর্যাস্ত আসন্ন। নতুন ভরকেন্দ্র দক্ষিণ। অন্যদিকে আবার সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যর পর প্রবল এক স্বজনপোষণ ও সেলেব্রিটি লবি মুম্বইকে শাসন করে অনৈতিকভাবে এই বিতর্ক। পাশাপাশি মাদক ব্যবসার অভিযোগ। সবদিক থেকেই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল মুম্বই। ২০২৩ সালে শাহরুখ খান দুটি ছবির মাধ্যমে মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে গভীর খাদ থেকে যেন ফিরিয়ে এনেছেন। আবার নতুন প্রজন্ম সিনেমা হলে যাচ্ছে। পাঠান ও জওয়ানের মতো না হলেও ডাঙ্কি বি গ্রেড শহরে মোটামুটি হিট করছে। যা ভালো লক্ষণ।
ঘুরে দাঁড়িয়েছেন রণবীর কাপুর। খান সাম্রাজ্যের পতনের পর আর কারও মধ্যেই সেই স্টারসুলভ স্পার্ক নেই এবং একা ইন্ডাস্ট্রিকে টেনে নিয়ে যেতে পারবে না এরকম জল্পনা রয়েছে। সাতের দশকে অমিতাভ বচ্চন যে ট্রেন্ড চালু করেছিলেন, সেই একই ফর্মুলা আজও সমানভাবে কার্যকরী। সেটি হল, একজন লার্জার দ্যান লাইফ নায়ক চাই। যিনি একাই সমাজের সব অন্যায়ের বদলা নেবেন এবং লড়াই করার ক্ষমতা রাখেন যে কোনও শক্তির সঙ্গে। শারীরিক ও অভিনয়গতভাবে যে চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। এরকম ফর্মুলাই আজও সলমন খান আর শাহরুখ খানেরা প্রয়োগ করে থাকেন। তাই পৃথ্বীরাজ কাপুরের বংশের নবীনতম উত্তরাধিকারীর কাছে ছিল চ্যালেঞ্জ যে, তিনি চকোলেট হিরোর চরিত্র করেই হারিয়ে যাবেন? নাকি ফিরতে পারবেন অন্য ভূমিকায়? অ্যানিমাল নামক যে ছবিটি রণবীর কাপুর করে ফিরে আসার বার্তা দিতে চাইলেন, সেই ছবি যে বিরাট কোনও নতুনত্ব বা উন্নত মানের মোটেই নয়। এই ছবির যে থিম, সেটাকে হিন্দি চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণে বলা হয় ‘ড্যাডি ইস্যু’। বহু পুরনো ফর্মুলা। বাবা ও পুত্রের মধ্যে লাভহেট একটা সম্পর্ক। সেই সম্পর্ককে ধরেই ছবি অগ্রসর হয় ক্লাইম্যাক্সের দিকে নানারকম উপকাহিনি নিয়ে। শেষমেশ দর্শক বুঝতে পারে যে দুজনে দুজনকে কতটা মন থেকে ভালোবাসে। এরকম বহু ছবি হয়ে গিয়েছে অতীতে। তাই ছবিটা বড় কথা নয়। রণবীর কাপুর একটি মারাত্মক হিংসাশ্রয়ী ছবিতে অভিনয় করে নিজের ইমেজ ভাঙার চেষ্টা ও সাহস দেখালেন। আগ্রহ নিয়ে মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। অনেকেই প্রবল অপছন্দ করেছে। আগামী দিনে বোঝা যাবে এই ইমেজ তাঁকে কোনও ডিভিডেন্ড দেবে কি না। কিন্তু তিনি মরিয়া এক চেষ্টা করেছেন হয়তো শেষবারের মতো।
ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ার বাজার এবং সোনার দাম। এরকম সর্বকালীন রেকর্ড যে এরকম শ্লথগতির অর্থনীতির মধ্যেও হতে পারে এটি অবিশ্বাস্য। আর সন্দেহও সেই কারণেই যথেষ্ট ছড়িয়েছে যে, এটা কি স্বাভাবিক নাকি কৃত্রিম। প্রশ্ন উঠছে, সাধারণ মানুষকে চাকরি ও স্থায়ী কর্মসংস্থান দিতে না পেরে এভাবেই একটি কৃত্রিম বেলুন ফুটিয়ে ট্রেডিংয়ে প্রচুর লাভ হবে, এই প্রলোভন দেখানোই উদ্দেশ্য নয় তো? তাহলে কী হবে? সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিপুল টাকা হঠাৎ বেশি বেশি করে মার্কেটে চলে আসবে। মুনাফার লোভে। আর ২০২৩ সালে সেবির রিপোর্টে দেখা গিয়েছে অবিকল তাই হচ্ছে। যেসব মানুষ শেয়ার বাজার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তাঁদের একটি বড় অংশ এখন প্রবলভাবে শেয়ার কেনেন এবং আইপিও এবং মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করেন। বিশেষত মিলেনিয়াল প্রজন্ম। যাঁদের জন্ম ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে। সমাজের এই অংশটির যে প্রবণতা ২০২৩ সালে আরও বেশি করে লক্ষ্য করা গিয়েছে, তা হল, এই অংশটি সরকারি সঞ্চয় ব্যবস্থায় আস্থাশীল এবং আগ্রহী নন। বেসরকারি সংস্থায় লগ্নিই তাঁদের কাছে সঞ্চয়। সিকিউরিটির তুলনায় বেশি রিটার্নে আগ্রহী নতুন যুগ। তাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী. এই বছরে হু হু করে ব্যাঙ্ক আমানত কমেছে। বেড়েছে মিউচুয়াল ফান্ড এসআইপি। ঠিক একইভাবে গোটা ভারতের একাধিক অসংগঠিত কর্মী সংগঠনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ২০২৩ সালে সবথেকে বেশি বেড়েছে ই-রিকশ, অটো এবং হকারের সংখ্যা। প্রতিটি শহরে এই চিত্রটি চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ সংগঠিত কর্মসংস্থানের পরিবর্তে, অসংগঠিত এবং অনিয়মিত কর্মসংস্থান বেড়ে চলেছে। কর্মসংস্থান ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
বছরের প্রথমার্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধ ছিল বিরোধীদের কাছে আশাব্যঞ্জক। হিমাচল প্রদেশ এবং কর্ণাটক , দুই রাজ্য থেকেই বিজেপি সরকারের পতন ঘটানো ছিল চমকপ্রদ সাফল্য। মনে করা হচ্ছিল, রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা সুফল দিচ্ছে। কিন্তু বছরের শেষে এসে সেই অগ্রসরমানতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেন রাহুল গান্ধী। শুধু ভোটে নয়। প্রোপাগান্ডা মেশিনারির লড়াইয়েও পিছিয়ে বিরোধীরা। কারণ, ২০২৩ সালে ভোটযুদ্ধের ফলাফল হয়েছে আসলে কিন্তু ড্র। কংগ্রেস তিন রাজ্যে জয়ী। বিজেপি তিন রাজ্যে জয়ী। কিন্তু বিজেপির প্রোপাগান্ডা মেশিনারি বিপুলভাবে প্রমাণ করে দিচ্ছে প্রচারের হাই ভোল্টেজ কণ্ঠস্বরে যে, বিজেপি অপ্রতিরোধ্য। কংগ্রেস ডুবন্ত। পক্ষান্তরে, এই যে তিনটি রাজ্যে কংগ্রেস জয়ী হল, সেই সাফল্যকে প্রচারের শিখরে তুলতেই পারেনি কংগ্রেস।
ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা। গবেষক, বিজ্ঞানী এবং টেকনোক্র্যাট মহল আমাদের একটি শিক্ষা দিয়েছে। প্রথম চন্দ্রযানের অসাফল্য তাঁদের হতাশ ও হতোদ্যম করেনি। বরং আরও বেশি করে শক্তিশালী হয়েছে তাঁদের লক্ষ্য। উদ্দেশ্যপূরণ ব্যর্থ না হলেও হাল না ছাড়ার শিক্ষা পাওয়া গিয়েছে। অবশেষে ভারতও চাঁদে চন্দ্রযান পাঠিয়ে লক্ষ্যপূরণ করেছে। ২০২৩ সালে এটিই সম্ভবত সর্বোত্তম এক কৃতিত্ব ভারতের।
আর মাত্র কয়েকদিন পর ২০২৪ সাল। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হতে চলেছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। হয়তো সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ বছর। একদিকে নরেন্দ্র মোদি নামক একটি অমিত শক্তিশালী ব্র্যান্ড এবং নতুন ভারতের হাতছানি। যে ভারতের চালিকশক্তি হবে হিন্দুত্ব। হিন্দুত্বকেই স্বদেশপ্রেমের আইডেন্টিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। যে কর্মসূচি শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের রাম রথযাত্রা দিয়ে। সেই কর্মসূচির শেষতম অধ্যায় ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি রামমন্দির প্রতিষ্ঠা। হিন্দুত্ব কি খারাপ? মোটেই নয়। প্রশ্ন হল, বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য কি ভালো? যদি ভালো না হয়, তাহলে এই দুটিকে ধ্বংস করতে কোনও দেশজুড়ে মহাযজ্ঞ দেখা যায় না কেন? সারা বছর জুড়ে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে এই দুটিকে নির্মূল করতে, এরকম কোনও প্রচার শোনা যায় না কেন? আমাদের ঘরে এসে সরকারের কোনও এক প্রতিনিধি প্রশ্ন করছেন না কেন যে, আপনাদের সংসার কেমন চলছে? আপনাদের ঘরে যোগ্য কোনও যুবক যুবতী কি আছে, যে কাজ পাচ্ছে না? এই সার্ভে হয় না কেন? ব্রিগেডে লক্ষ হাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে হবে?
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের পর ভারত কোনদিকে যাবে? সেকুলার, ডেমোক্রেটিক, সোশ্যালিস্ট এই শব্দগুলি সংবিধানে থাকবে? নরেন্দ্র মোদি ৬০ বছরের ইতিহাস বদলে দেবেন? বিগত ৬০ বছরের মধ্যে কোনও প্রধানমন্ত্রী তৃতীয়বারের জন্য আবার সরকারে ফিরতে পারেননি। শেষতম এই কৃতিত্ব ছিল জওহরলাল নেহরুর। মোদি কি প্রমাণ করতে পারবেন যে, তিনি নেহরুর মতোই শেষদিন পর্যন্ত জনপ্রিয়? নাকি ভারত জোড়ো যাত্রার দ্বিতীয় অধ্যায়ের পর জওহরলাল নেহরুর দৌহিত্র তাঁর দাদুকে লাগাতার অসম্মান করার মধুর প্রতিশোধ নিতে পারবেন। ২০২৩ ছিল অনেকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। ২০২৪ হতে চলেছে প্রমাণ করার লড়াই।